সবার খাদ্যের যোগান দিতে এই মহাদুর্যোগেও মাঠে কাজ করছেন কৃষক
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের কৃষক মো. বাবলু। তিনি এবার দুই বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করছেন। এছাড়া পিঁয়াজ চাষ করেছিলেন এক বিঘা জমিতে। ফলনও ভালো হয়েছে। জমি থেকে কয়েকদিন আগেই তুলেছেন পিঁয়াজ।
এছাড়া জমিতে তার লাউ ও বেগুন আছে। রয়েছে পানের বরজও। বুধবার দুপুরে এই প্রতিবেদক যখন তার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন তখন তিনি জানান, 'এইমাত্র পানের বরজে পানি সেচ দিয়ে বাড়িতে আসলাম। প্রতিদিনই মাঠে যেতে হয়। জমিতে সেচ না দিলে, নিড়ানি, সার ও কীটনাশক না দিলে তো ফসল হবে না। যতই দুর্যোগ থাকুক আমাদের মাঠে যেতেই হয়।'
'এখন যতটুকু সতর্কতা মেনে কাজ করা যায় আর কি। আর ফসল যেসব উৎপাদন করি, সেসব তো শুধু আমি পরিবার নিয়ে একাই ভোগ করি না। নিজেদের খাওয়ার জন্য আর কতটুকু লাগে। সবই বিক্রি করি। যেসব থেকে অন্য মানুষরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।'
রাজশাহীর তানোরের কৃষক লুৎফর রহমান। তার বাড়ি উপজেলার চিমনা গ্রামে। তিনি ৩০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ করেছেন। তিনি জানান, 'করোনার এই দুর্যোগেও প্রতিদিন আমাদের মতো কৃষকদের মাঠে যেতে হচ্ছে। মাঠে না গেলে ফসল উৎপাদন হবে কীভাবে? ফসল উৎপাদন করতে হলে মাঠে তো যেতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই।'
'এই দুর্যোগে শ্রমিক পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও কিছু শ্রমিক নিয়ে কাজ করছি। তাদের সবাইকে মাস্ক ও সাবান কিনে দিয়েছি। আমার শ্রমিকরা সবাই মাস্ক পড়ে সামাজিক দূরত্ব মেনেই কাজ করছেন।'
শুধু বাবলু বা লুৎফরই না, তাদের মতো প্রায় ৭৭ লাখ কৃষককে করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগকালীন মুহূর্তেও প্রতিদিন মাঠে যেতে হচ্ছে। চাষাবাদ করতে হচ্ছে ফসল। তাদের এই উৎপাদিত ফসল দিয়েই চলে সব মানুষের খাদ্যের যোগান।
কথা হয় রফিক ও ইয়াকুব নামের কৃষকদের সঙ্গে। তারা বলেন, 'এখন যতটুকু সম্ভব সুরক্ষা মেনেই কাজ করছি। মাঠ থেকে কাজ শেষে বাসায় গিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে বাসায় ঢুকে যাচ্ছি আর বের হচ্ছি না। আগে যেমন সন্ধ্যার পর বাজারে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতাম আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না।'
মোহনপুরের কৃষক আলী ইদ্রিস বলেন, 'এত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করি। কিন্তু বিক্রির সময় নায্যমূল্য পাই না। এখন করোনার কারণে সেই দুর্যোগ আমাদের কাছে মড়ার উপর খাড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। শাকসবজির দাম হু হু করে কমছে। তারপরও আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। সবার জন্য ফসল উৎপাদনে ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছি।'
সারাদেশের চিত্রই এমন। করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগকালীন সময়ে চিকিৎসক, নার্স, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও সাংবাদিকদের মতো সবার খাদ্য নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন কৃষকরাও।
করোনা ভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে যখন ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে তখন সারাদেশের মতো রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ৭৭ লাখ কৃষকদেরও প্রতিদিন যেতে হচ্ছে মাঠে। কাজ করতে হচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি।
রাজশাহী অঞ্চলে এখন মাঠজুড়ে বোরো ধানের চাষাবাদ হচ্ছে। গম কাটা প্রায় শেষের দিকে। গত কয়েকদিন আগে মাঠ থেকে তোলা সম্পূর্ণ হয়েছে আলু। জমি থেকে পিঁয়াজও তোলার কাজ চলছে। এছাড়া শাকসবজি তো রয়েছেই। তাই দিনের বেশিরভাগ সময় মাঠেই থাকতে হচ্ছে কৃষকদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানা যায়, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ৭ লাখ ২৮ হাজার ৯৫৮ হেক্টর। তিন ফসলি হিসেবে তা দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৮ হেক্টর। মোট কৃষক পরিবার আছেন ১৫ লাখ ২১ হাজার ৭৮৭ টি। গড়ে প্রতিবারে ৫ জন করে সদস্য ধরলে কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত লোকজন হচ্ছে প্রায় ৭৭ লাখ। রাজশাহী অঞ্চলের এক কোটি জনসংখ্যার মধ্যে এই ৭৭ লাখ মানুষকে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোনভাবে মাঠে যেতে হয় কৃষি কাজ করতে। তাদের উৎপাদিত ফসল থেকেই চলে সবার খাদ্যের যোগান।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল হক জানান, কৃষকদের সবাইকেই প্রতিদিন মাঠে যেতে হচ্ছে ফসল পরিচর্যার জন্য। যতই দুর্যোগ থাকুক তাদের ফসলের পরিচর্যার জন্য যেতেই হবে। তাই তাদের আমরা বলেছি যতটুকু পারা যায়, মাঠে সামাজিক দূরত্ব মেনে যেন তারা কাজ করেন। এছাড়া বাসায় ফিরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও মাস্ক পরে মাঠে কাজ করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কৃষকদের ফসল চাষাবাদের কারণে সবার খাদ্যের যোগান দিয়ে ফসল উদ্বৃত্ত করাও সম্ভব হচ্ছে বলে জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ের উপ-পরিচালক খয়ের উদ্দিন মোল্লা। তিনি জানান, রাজশাহী অঞ্চলে এবছর আউশ ও আমন মৌসুমে তিন লাখ মেট্রিক টন ধান উদ্বৃত্ত হয়েছে। বোরো ধান ও ভুট্টা ঘরে উঠলে এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ লাখ মেট্রিক টনে।