লিওনেল মেসি: সর্বকালের সেরা ফুটবলার
ক্লাব ফুটবলে যা কিছু জেতা সম্ভব তার কিছুই বাদ রাখেননি, ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিও এতোই ভারী যে তার হিসেব হয়তো নিজেই জানেন না। তবুও সর্বকালের সেরা প্রশ্নে দিয়েগো ম্যারাডোনা, পেলেদের সঙ্গে তার নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে কিছু মানুষের অনীহা থেকেই যেতো। কারণ? একটা বিশ্বকাপ জয়ের মেডেল যে তার নেই।
ক্লাব ক্যারিয়ারে জিতেছেন ৩৭ টি শিরোপা, ব্যক্তিগত অর্জনের খাতায় জমা আছে ৭ ব্যালন ডি'অর, ৬ টি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট। তবুও নাকি সর্বকালের সেরা নন মেসি, বিশ্বকাপই যে নেই তার!
কাতার বিশ্বকাপের পর সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মাঝারি গড়নের এই মানুষটি। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরে মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলেন, যদিও সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার, গোল্ডেন বল মেসিই জিতেছেন।
আট বছর পর, কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি আরেকবার হাতে নিলেন মেসি। এবার মাথা উঁচু করে, কারণ আসল শিরোপাটাও যে জিতেছেন তিনি। সর্বকালের সেরা হওয়ার প্রশ্নে যারা মেসির বিশ্বকাপ নেই বলে যুক্তি দেখাতেন, তারা এখন থেকে কী বলবেন!
তাও কোনোরকমে জিতে গেলে একটা কথা ছিল, কিন্তু মেসি যেভাবে নিজের স্বৈরাচারীতা দেখিয়ে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি হাতে নিলেন, তাতে সেই কথা বলার অবকাশও আর রাখেননি। ২৩,২৭ আর ৩১ বছরের তুলনামূলক তরুণ আর ক্ষিপ্র মেসি যা পারেননি, ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ, গতি হারানো মেসি সেটি করে দেখালেন।
কাতার বিশ্বকাপকে মেসির বিশ্বকাপ বললেও ভুল হবে না। এই এক বিশ্বকাপে যে কয়টি রেকর্ড গড়েছেন, সেগুলো আর কখনও ভাঙবে কিনা তা সন্দেহ। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে তিনি ছিলেন এই প্রজন্মের অনেক তরুণ তারকার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।
কাতার বিশ্বকাপে মেসি গোল করেছেন ৭ টি, যার মধ্যে শেষ ষোলোর ম্যাচ থেকে ফাইনাল পর্যন্ত সব ম্যাচেই গোল আছে মেসির। এই কীর্তি নেই আর কারোর। ৩ টি গোলে সহায়তাও করেছেন তিনি, যার মধ্যে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে মলিনাকে দেওয়া তার পাস নিয়ে কাব্য রচনা করা যাবে।
সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আলভারেজকে সহায়তা করার আগে গাভারদিওলের সঙ্গে যা করেছেন, তাতে ক্রোয়াট ডিফেন্ডারই বরং গর্বিত হবেন এই ভেবে, তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও মেসির কাছে নত হয়েছিলেন।
বিশ্বকাপে এখন সবমিলিয়ে ১৩ গোল মেসির, যা তাকে এগিয়ে দিয়েছে পেলের চেয়ে। আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল এখন তারই। সব মিলিয়ে সামনে এখন শুধু জার্ড মুলার, রোনালদো নাজারিও আর মিরোস্লাভ ক্লোসা।
অবশ্য বিশ্বকাপে আর খেলবেন না বলে ঘোষণা আগেই দিয়েছেন মেসি। তাই এই রেকর্ড আর ভাঙতে পারবেন না তিনি। ৮ গোলে সহায়তা করে দিয়েগো ম্যারাডোনার রেকর্ড ছুঁয়েছেন মেসি।
আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ডও এখন মেসির দখলে। তিনি ছাড়া আর মাত্র ৭ জন খেলোয়াড়ের আছে এই কীর্তি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ম্যাচ, মিনিট খেলা এবং সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ডও মেসিরই।
২০১৪ এবং ২০২২ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পেয়েছেন মেসি। বিশ্বকাপের সোনালী মেডেলও এখন তার সঙ্গী।
এই অর্জনের সঙ্গে ২০২১ সালে জেতা কোপা আমেরিকা আর তার ক্লাব ক্যারিয়ারের অর্জন গুলো মেলানোর পর, সর্বকালের সেরার প্রশ্নে তার থেকে উপরে কাউকে কীভাবে রাখা সম্ভব! তা রাখছেনও না ইংল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার এবং ১৯৮৬ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জয়ী গ্যারি লিনেকার, 'মেসিকে প্রায় দুই দশকের কাছাকাছি সময় ধরে দেখতে পারাটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। দিনের পর দিন সে আমাদেরকে অবিশ্বাস্য ফুটবল উপহার দিয়ে গিয়েছে। ঈশ্বরের পক্ষ থেকে সে একটা উপহার।'
ইংল্যান্ডের বর্তমান দলের মাঝমাঠের তারকা ডেক্লান রাইস বলেছেন, 'লিওনেল মেসি, সর্বকালের সেরা। আমরা আর কখনোই মেসির মতো কাউকে দেখতে পাবো না।'
পেলে-ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনায় এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন মেসি? ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলেকে ফুটবল মনে রাখবে তার জেতা তিনটি বিশ্বকাপের জন্য। যার মধ্যে অবশ্য ১৯৬২ বিশ্বকাপে মাত্র একটি ম্যাচই খেলেছিলেন পেলে। চোটে আক্রান্ত হয়ে দলকে আর সাহায্য করতে না পারলেও গারিঞ্চার কৃতিত্বে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। পেলেও দলের অংশ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের মেডেল পান।
ক্লাব ক্যারিয়ারে পেলে কখনোই ইউরোপে খেলেননি। বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসে, যদিও অনেকের দাবি, তখনকার সময়ে ইউরোপের লিগগুলোর মতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগও।
অপরদিকে দিয়েগো ম্যারাডোনা ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলেছেন বার্সেলোনা, নাপোলি এবং সেভিয়ার হয়ে। নাপোলির হয়ে দুইটি লিগ এবং একটি ইউরোপা লিগ জিতলেও কখনো চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জেতেননি তিনি। আর্জেন্টিনাকে প্রায় একা হাতে জিতিয়েছেন একটি বিশ্বকাপ এবং খেলেছেন আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনালে।
আর লিওনেল মেসি? ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে আধুনিক যুগে এসে জিতেছেন ৪ টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১১ টি ঘরোয়া লিগ, ৩ টি ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা সহ অসংখ্য ট্রফি। স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার যতো সাফল্য তার অধিকাংশই এসেছে মেসির হাত ধরে।
বাকি ছিল জাতীয় দলের হয়ে কিছু জেতা। ২০২১ কোপা আমেরিকা জিতে সেই অপবাদও ঘোচান মেসি। এই বছরের জুনে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে 'ফিনালিসিমা'ও জেতে আর্জেন্টিনা, যে ম্যাচে গোল পাওয়া ছাড়া বাকিসবই করেছেন মেসি। ইতালিয়ানদের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলেন নিজের জাদুর ঝুলি খুলে।
এতকিছুর পরেও বিশ্বকাপ না জিতলে পেলে-ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো তাকে মানা যাবে না, এমন তর্কের ভিত্তি কোথায়? বিশ্বকাপ জিতে সেই তর্কে এবার চিরদিনের জন্য সিলগালা করে দিয়েছেন মেসি।
ম্যারাডোনার সতীর্থ, ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয়সূচক গোল করা হোর্গে বুরুচাগা অবশ্য ম্যারাডোনা এবং মেসিকে রাখছেন একই কাতারে। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেই তিনি বলেছিলেন, মেসি জিতুন বা না জিতুন, তিনি ম্যারাডোনার চেয়ে কোনো অংশেই কম নন, 'মেসি আর ম্যারাডোনা সমান সমান। '
বুরুচাগার মতে ফুটবল ইতিহাসে নিজেদের সময়ের সেরা পাঁচজন খেলোয়াড়ের একজন মেসি, 'বিগত ৭০ বছরে যার যার নিজেদের সময়ে সেরা খেলোয়াড়রা হলেন দি স্টেফানো, পেলে, ইয়োহান ক্রুইফ, ম্যারাডোনা এবং মেসি। বিশ্বকাপ না জিতলেও মেসি এই তালিকায় থাকবেই। মেসি যদি বিশ্বকাপ নাও জিতে, এটি পরিবর্তন হবে না। তবে আমি চাই সে জিতুক।'
বুরুচাগা আর কোটি কোটি আর্জেন্টিনা ভক্তের আশা পূর্ণ করে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছেন লিওনেল মেসি।
'