হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে কৃত্রিম সুইটনার 'ইরিথ্রিটল': গবেষণা
স্বাস্থ্য সচেতনতার অংশ হিসেবে আপনি কি খাবারে চিনির বিকল্প হিসেবে কৃত্রিম চিনি বা সুইটনার ব্যবহার করে থাকেন? উত্তর হ্যাঁ হলে, আপনার জন্য একটু খারাপ সংবাদ রয়েছে।
নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতিতে প্রাপ্ত এবং কিটোজেনিক ডায়েটে ব্যবহৃত বিভিন্ন খাবারে মিষ্টি স্বাদ যুক্ত করতে ব্যবহৃত সুইটেনার (যা ইরিথ্রিটল হিসেবেই পরিচিত) স্ট্রোক, রক্ত জমাট বাঁধা এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক লার্নার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর কার্ডিওভাসকুলার ডায়াগনস্টিকস অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক এবং গবেষণার প্রধান লেখক ড. স্ট্যানলি হ্যাজেন বলেন, "ঝুঁকির মাত্রা কিন্তু একেবারেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো না।"
সোমবার নেচার মেডিসিন জার্নালে সমীক্ষাটি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, হৃদরোগের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে যেসব অসুখ, যেমন কারো যদি ডায়াবেটিস থাকে এবং তাদের রক্তে সর্বোচ্চ মাত্রায় ইরিথ্রিটল মেলে, তাহলে তাদের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ।
গবেষণায় আরও যে সব ল্যাব রিসার্চ এবং প্রাণী গবেষণা উপস্থাপন করা হয়েছে তা বলছে, ইরিথ্রিটল রক্তের প্লাটিলেটগুলোকে সহজে জমাট বাঁধায়।
"আর এটি অবশ্যই শংকার বিষয়", গবেষণার সাথে জড়িত না থেকেও এমন মন্তব্য করেছেন আমেরিকার ন্যাশনাল জিউয়িশ হেলথ নামে একটি হাসপাতালের কার্ডিওভাসকুলার প্রিভেনশান এবং ওয়েলনেস বিভাগের পরিচালক ডা. অ্যান্ড্রু ফ্রিম্যান।
ফ্রিম্যান বলেন, "ইরিথ্রিটলের ব্যবহারে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এর জন্যে আরও গবেষণার প্রয়োজন। তবে আপাত সতর্কতার অংশ হিসেবে ডায়েটে ইরিথ্রিটল সীমিত করাই উচিত হবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প সমিতি, ক্যালোরি কন্ট্রোল কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক রবার্ট র্যাঙ্কিন গবেষণার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, গত কয়েক দশকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিপরীতে ফলাফল প্রদর্শন করেছে এই গবেষণা। চিনির বিকল্প হিসেবে ইরিথ্রিটলের মতো কম ক্যালরির সুইটেনার নিরাপদ আর তাই বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে- এতোদিন এটিই জানা ছিল সবার।
এদিকে 'গবেষণাটি এখনও পর্যালোচনা করা হয়নি' জানিয়ে দ্য ইউরোপীয় অ্যাসোসিয়েশন অব পলিওল প্রডিউসারস সিএনএনের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
ইরিথ্রিটল কী?
সরবিটল ও এক্সাইলিটলের মতো ইরিথ্রিটলও এক ধরনের চিনিজাতীয় অ্যালকোহল (সুগার অ্যালকোহল) এবং এই কার্বোহাইড্রেটটি প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ফল ও সবজির মধ্যে খুব সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরিথ্রিটলের মধ্যে চিনির প্রায় ৭০ শতাংশ মিষ্টতা পাওয়া যায় এবং এটিকে জিরো-ক্যালরি হিসেবেই ধরা হয়।
কৃত্রিমভাবে বড় পরিসরে এটি উৎপাদন করা হয়; তবে ইরিথ্রিটলের কোনো দীর্ঘস্থায়ী আফটারটেস্ট (কোনোকিছু খাওয়ার পর মুখে তার স্বাদ লেগে থাকা) নেই। এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায় না এবং অন্যান্য সুগার অ্যালকোহলের তুলনায় এর রেচক প্রভাব কম।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের সেন্টার ফর মাইক্রোবায়োম অ্যান্ড হিউম্যান হেলথ- এর পরিচালক হ্যাজেন বলেন, "ইরিথ্রিটল আসলে চিনির মতোই দেখতে, খেতেও চিনির মতো এবং এটি দিয়ে বেকিংও করা যাবে।"
তিনি আরও যোগ করেন, "এটি এখন খাদ্য খাতের অন্যতম পরিচিত একটি উপাদান হয়ে গেছে। কিটো এবং অন্যান্য কম শর্করাযুক্ত (লো-কার্ব) খাবার এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বাজারজাত করা হয় এমন খাবারগুলোতে ইরিথ্রিটল একটি জনপ্রিয় সংযোজন। 'ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার' বলে আখ্যা দেওয়া কিছু খাবারে তো আমরা অন্যান্য আইটেমের চেয়ে ইরিথ্রিটলের পরিমাণই (ওজন অনুসারে) বেশি দেখতে পেয়েছি।"
'প্রাকৃতিক' স্টিভিয়া ও মংকফ্রুটের মধ্যেও ওজন অনুসারে অন্যান্য উপাদানের তুলনায় ইরিথ্রিটল সবচেয়ে বড় উপাদান। কারণ মংকফ্রুট এবং স্টিভিয়া চিনির চাইতে ২০০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি, তাই যেকোনো পণ্যে খুবই অল্প পরিমাণে দিলেই হয়। কিন্তু বেশিরভাগ উপাদানই থাকে ইরিথ্রিটল যা চিনির মতো স্ফটিক-সদৃশ চেহারা ও টেক্সচার দিতে সাহায্য করে, যা ক্রেতারা আসলে চান।"
অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার
ইরিথ্রিটল ও কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যাগুলোর মধ্যে যে যোগসূত্র রয়েছে তা অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আবিষ্কার হয়ে গেছে বলে জানান হ্যাজেন। তার ভাষ্যে, "আমরা এটা প্রত্যাশাই করিনি। আমরা আসলে এটা খুঁজছিলামই না।"
হ্যাজেনের গবেষণার লক্ষ্য ছিল খুব সাধারণ- ব্যক্তির রক্তের মধ্যে অচেনা কোনো কেমিক্যাল বা যৌগ খুঁজে বের করা যা হয়তোবা আগামী তিন বছরের মধ্যে তাদের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর সে উদ্দেশ্যেই হ্যাজেনের টিম ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছে এমন ১১৫৭ জন ব্যক্তির রক্তের নমুনা বিশ্লেষণ করা শুরু করেন। সেখান থেকেই তারা ইরিথ্রিটলের ভূমিকাটি খুঁজে পান।
"আমরা দেখতে পাই যে এই পদার্থটি একটি বড় ভূমিকা রাখছে, কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না এটা কী ছিল। পরে দেখলাম যে এটা আসলে ইরিথ্রিটল", বলেন হ্যাজেন।
যদিও মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ইরিথ্রিটল উৎপন্ন হয়, কিন্তু তারা যে মাত্রার ঝুঁকি খুঁজে পেয়েছেন তা তৈরি করার জন্য সেটুকু ইরিথ্রিটল দায়ী নয়।
গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য হ্যাজেনের দল যুক্তরাষ্ট্রে ২১০০'রও বেশি মানুষের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে। সেই সাথে ২০১৮ সালের মধ্যে ইউরোপে তাদের সহকর্মীদের দ্বারা সংগৃহীত অতিরিক্ত ৮৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে।
তাদের সংগৃহীত তিন ধরনের নমুনার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তির করোনারী রোগ বা উচ্চ রক্তচাপ এবং প্রায় এক-পঞ্চমাংশের ডায়াবেটিস ছিল বলে জানান। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিল পুরুষ এবং তাদের বয়স ছিল ষাট ও সত্তরের কোঠায়।
তিনটি আলাদা জনসংখ্যার নমুনার মধ্যেই গবেষকরা দেখেছেন যে, উচ্চ মাত্রায় ইরিথ্রিটল গ্রহণ করতে থাকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের কারণ খুঁজতে গবেষকরা প্রাণীদের দিয়ে ও ল্যাব টেস্ট করেছেন। তখনো দেখা গেছে যে ইরিথ্রিটল রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করছে।
মানুষের শরীরের জন্য রক্ত জমাট বাঁধারও প্রয়োজন আছে। তা নাহলে কোথাও কেটে গেলে শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যেত। হ্যাজেন বলেন, " আমাদের রক্তনালীগুলো সবসময় একটা চাপের মধ্যে থাকে, ছিদ্র খুলে গেলে রক্তের প্লাটিলেটগুলো সবসময় ছিদ্রগুলোকে বন্ধ করে দিতে কাজ করে।
কিন্তু প্লাটিলেট কতখানি রক্ত জমাট বাঁধাবে তা নির্ভর করে 'ট্রিগার' এর আকারের ওপর যা কোষগুলোকে উদ্দীপিত করে, বলেন হ্যাজেন। যেমন, ট্রিগার যদি মাত্র ১০ শতাংশ হয়, তাহলে শুধু ১০ শতাংশই জমাট বাঁধবে।
"কিন্তু আমরা দেখেছি যে ইরিথ্রিটলের উপস্থিতিতে প্লাটিলেটগুলো বেশি সাড়া দেয়", বলেন হ্যাজেন।
তিনি আরও বলেন, "যাদের রক্ত জমাট বাধা, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি আছে; কিংবা যাদের ইতোমধ্যেই কার্ডিয়াক রোগ আছে অথবা যাদের ডায়াবেটিস আছে- আমার মনে হয় তাদেরকে ইরিথ্রিটল থেকে দূরে থাকতে বলাই নিরাপদ- অন্তত যতদিন না পর্যন্ত এ নিয়ে আরো গবেষণা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলিভার জোনস এ প্রসঙ্গে বলেন যে গবেষকরা শুধু একটা সংযোগ আছে বলে প্রকাশ করেছেন, কার্যকারণ দেখাননি। তিনি বলেন, "গবেষকরা বলছেন যে তারা ইরিথ্রিটল ও রক্ত জমাট বাঁধার মধ্যে একটা সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন; তবে নিশ্চিত প্রমাণ নেই যে সংযোগ আছেই।"
৮ স্বেচ্ছাসেবক
গবেষণায় ৮ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেন, যাদের প্রত্যেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এদের প্রত্যেককে ৩০ গ্রাম ইরিথ্রিটল যুক্ত পানীয় দেওয়া হয়। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের পুষ্টি নিরীক্ষাকারী ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশন সার্ভে অনুযায়ী, দেশটির বহু লোক এই পরিমাণেই ইরিথ্রিটল গ্রহণ করে থাকে।
পরের তিনদিনের পরীক্ষায় তাদের রক্তে ইরিথ্রিটলের মাত্রা এবং জমাট বাঁধার ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ করা হয়।
হ্যাজেন বলেন, "রক্তে ইরিথ্রিটলের মাত্রা হাজারগুণ বেড়ে যাওয়ার জন্য ত্রিশ গ্রামই যথেষ্ট।"
পরের দুই-তিনদিনে ইরিথ্রিটলের মাত্রা এতই বেশি থাকে যে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকিও থেকে যায়।
এই ৩০ গ্রাম ইরিথ্রিটল আসলে কত? হ্যাজেন বলেন, এই পরিমাণ হলো কেবল এক পিন্ট কিটো আইসক্রিমের সমতুল্য (পিন্ট হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত তরলের ধারণক্ষমতার জন্য ব্যবহৃত একটি পরিমাপক)।
"অনেক কিটো আইসক্রিমের লেবেলেই 'স্বল্প চিনিযুক্ত' বা 'সুগার অ্যালকোহল' লেখা দেখতে পাবেন, যা আসলে ইরিথ্রিটলকেই নির্দেশ করে। সাধারণত এক পিন্টে ২৬ থেকে ৪৫ গ্রামের মতো ইরিথ্রিটল থাকে", যোগ করেন হ্যাজেন।
"আমার সহ-লেখক এবং আমি অনেকগুলো মুদি দোকানে গিয়ে লেবেল চেক করি। তিনি তো ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য বাজারজাত করা একটি কনফেকশনারিতে ৭৫ গ্রামও খুঁজে পান।"
ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এরিথ্রিটলকে নিরাপদ হিসাবে স্বীকৃত দিয়েছে। ইউরোপীয়ান ফুড সেফটি অথরিটিও এখন পর্যন্ত প্রতিদিন ইরিথ্রিটল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বেঁধে দেয়নি।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জিউয়িশ হেলথের ডা. অ্যান্ড্রু ফ্রিম্যান এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
তার মতে, "এই উপাদানটি বহুল ব্যবহৃত এবং এখন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। সত্যিই যদি এটা ক্ষতিকর হয়ে থাকে, তবে আমাদের তাড়াহুড়ো না করে এ বিষয়ে ভালোভাবে জানাই শ্রেয়।"