গুগল প্লে-তে বাংলাদেশী বালক রূপকথার গেম
রূপকথা কিংবা স্বপ্নপুরীর দেশের কোনো রাজকুমারের গল্প নয়; শতভাগ বাস্তব। একক প্রচেষ্টায় গেম বানিয়ে বিশ্বকে আবারো একবার তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ এই কম্পিউটার প্রোগ্রামার। স্পেস কলাইডার নামের এই গেমটি পিসি’র পাশাপাশি খেলা যাচ্ছে মোবাইল ফোনেও। আর এর মাধ্যমে প্রযুক্তি দুনিয়ার বিস্ময় বালক রূপকথার সফলতায় যুক্ত হলো আরো একটি পালক।
১৩ বছর বয়সী বাংলাদেশী বালক ওয়াসিক ফারহান রূপকথার তৈরি গেমটি এরই মধ্যে গুগল প্লে-স্টোর থেকে বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে ডাউনলোড হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি আফ্রিকা থেকেও। ভারত, সৌদি আরব, কুয়েত, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশংসিত হচ্ছে।
রূপকথা স্টুডিও থেকে প্রকাশিত গেমটি ডাউনলোড সংখ্যা সপ্তাহের ব্যবধানে ছাড়িয়ে গেছে দেড় হাজারেরও বেশি। ৪.৮ রেটিং নিয়ে টপ ডাউন স্পেস শুটার গেমের তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নেয়। একইসঙ্গে রঃপয.রড় -তে দিন দিন জনপ্রিয়তার তালিকায় শামিল হচ্ছে গেমটির পিসি সংস্করণ।
গ্রহ-উপগ্রহ থেকে ছুটে আসা উল্কা আর ভিনগ্রহের প্রাণী থেকে পৃথিবীকে সুরক্ষিত রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ইউনিটি প্লাটফর্মে সি শার্পে গেমটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জন্মগতভাবে মেধাবী রূপকথা। বয়সে কাঁচা হলেও চিন্তায় অগ্রজ এই শিশুর ভাবনায় সবসময় ঘুরপাক খায় আগামীর পৃথিবীকে মহাকাশের অনভিপ্রেত আক্রমণ থেকে রক্ষার।
সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কটুক্তি তার মনে ইতিমধ্যেই রেখাপাত রেখেছে। আলাপকালে সে জানালো, ভবিষ্যতে সাইবার হামলা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখা না গেলে অনেক ভালো কিছুই আর ভালো থাকতে পারবে না।
আরো জানালো, তার তৈরি গেমের পিছনের মহৎ উদ্দেশ্যের কথা। রূপকথা চায়, নতুন প্রজন্মের গেমাররা মানুষ হত্যার মতো নৃশংস গেম না খেলে পৃথিবীকে ভালোবাসুক। যুদ্ধ করুক- পৃথিবীকে বাঁচাতে।
অত্যন্ত মৃদুভাষী ও লাজুক স্বভাবের শিশুটির ভাবনার প্রায় পুরোটা অংশ জুড়েই কম্পিউটার থাকলেও প্রকৃতি প্রেম তার মধ্যে প্রবল। বৃষ্টি শুরু হলে জানালার ফাঁক গলে হাত ভেজানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। অবসরে পিএস ফোর-এ গেম খেলে।
অবশ্য স্পেস কলাইডার গেম তৈরি করেই কিন্তু থেমে নেই রূপকথা। একক পরিকল্পনা ও চেষ্টায় এখন ডেভেলপ করছে নতুন আরেকটি গেম ডিফেন্ড দ্য আর্থ। গেমের কাজ প্রায় শেষ। রিভিউ করে দু-একদিনের মধ্যেই তা প্রকাশ করবে গুগল প্লে-স্টোরে।
রূপকথার মা সিনথিয়া ফারহিন রিশা জানালেন, সাত মাস বয়স থেকেই কম্পিউটারের প্রতি তার ঝোঁক। ওই বয়স থেকেই ওকে কম্পিউটার ছাড়া খাওনো যেত না। অল্পদিনের মধ্যেই দেখা গেলো সে কি-বোর্ড ব্যবহার করতে চেষ্টা করছে। এরপর থেকে ওর ধ্যান-জ্ঞান এই কম্পিউটার নিয়েই। শৈশবেই চিটকোড ব্যবহার করে খেলতো। কঠিন কঠিন গেম শেষ করতো একটানে। অল্পদিনেই কম্পিউটার ওর কাছে খেলনায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, বয়স এক বছর হওয়ার আগেই কম্পিউটার নিয়েই ও তার নিজস্ব জগত তৈরি করে ফেলে। কারো কাছ থেকে এ, বি, সি, ডি- শেখে নি। রিড ইট, উইকিপিডিয়া, ইউকি হাউ সহ বেশ কিছু ওয়েবে সে নিয়মিত পড়া-শোনা করে। এখনো যা করছে নিজের প্রচেষ্টায়। ২০১৪ সাল থেকে এ বছরের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রোগ্রামারদের গেমিং প্লাটফর্ম রোবলক্সে কয়েক ডজন গেম বানায়। লুআ ল্যাংগুয়েজে সে এই গেমগুলো তৈরি করলেও তা সাধারণেরা খেলতে পারতো না। ফলে চলতি বছরের রোজার ঈদের আগ থেকেই ইউনিটি-তে গেম তৈরির কাজ শুরু করে।
অবশ্য এর আগে ছয় হবার বয়স হবার আগেই বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রোগ্রামারের খেতাব পায় রূপকথা। যাচাই বাছাই করে তাকে ২০১২ সালে এই খেতাব দিয়েছিলো রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট। তাকে স্বীকৃতি দেয় গোল্ডেন বুক অব রেকর্ডস। এরই মধ্যে যে কোনো প্রোগ্রামিং ভাষা কিংবা ট্রাবলশ্যুটিংয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে। এ সবকিছুই সে শিখছে নিজের মতো করে।
তাই বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে শৈশবেই। তার এই গৌরব গাঁথা স্থান পেয়েছে দেশের জাতীয় পাঠ্যপুস্তকেও। নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নিতে না হলেও, ২০১৩ সাল থেকেই ইংলিশ ফর টুডে পাঠ্যপুস্তকে অষ্টম শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীই রূপকথা-কে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পড়ছে।
সব মিলিয়ে অলৌকিকতাকেও ছাড়িয়ে গেছে রূপকথার অর্জন। কেননা, চার বছর বয়সেই ইম্যুলেটর ব্যবহার করে গেমের ক্যারেক্টার পরিবর্তন করেছে। ছয় বছরে ক্যাম স্টুডিও এবং হাইপারক্যামে কাজ করার পাশাপাশি চওঠঙঞ-এ অ্যানিমেশন তৈরি করতো। এর পরের বছরেই সে সি ++ এ দক্ষ হয়ে ওঠে। তখন ওয়ার্ল্ড নিউজ এজেন্সি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
এরপর ২০১৩ সালে ঝটঝঊ স্টুডিও ব্যবহার করে একটি সম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে। এরই ফাঁকে ৫-৬ বছরের মধ্যেই ১০০০টির বেশি গেম খেলে ফেলে। খেলার পাশাপাশি উইকিপিডিয়া সম্পাদনা এবং তৈরিতে তার দক্ষতা দেখায়। মহাজাগতিক বিষয়ে লাভ করে বিস্তর জ্ঞান।
সাম্প্রতিক সময়ে খেলার প্রতি তার ঝোঁক আর আগের মতো নেই। অন্যের তৈরি গেম খেলায় মত্ত থাকে না, গেম বানানোর কাজ নিয়েই দিনের বেশিটা সময় ব্যয় করে। উদ্ভাবন আর গবেষণায় ডুব দিয়েছে। তার ভাবনা জুড়ে কেবলই পৃথিবী আর মহাকাশ। মানবকল্যাণে কী ভাবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে সময় কাটছে।
রূপকথার সঙ্গে কথা বলে ও তার কাজ দেখে বোঝা যায়, কম্পিউটারে কোডিং করা কিংবা কোনো কিছু লেখার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের মতো তার বেশ বুদ্ধি ও দক্ষতা রয়েছে। কোনো বিশেষ চিন্তা- ভাবনা ছাড়াই সে কোডিং লিখছে। আবার নিজের তৈরি গেমের জন্য চমৎকার একটি ট্যাগ লাইনও লিখে ফেলছে- “ডিফেন্ড দ্য আর্থ ইউ আর ব্রেভ এনাফ, ম্যানকাইন্ড’স ফেট ইন ইউর হ্যান্ড”।
রূপকথা জানালো, প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা তার দ্বিতীয় গেমটি (দ্য আর্থ ডিফেন্ডার) হবে সিরিজ গেম। প্রথম সিরিজে থাকবে স্পেস ডিফেন্ড এবং দ্বিতীয়টি মার্সকে নিয়ে। এই গেমে নাসা মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠিয়ে হোস্টাইল অ্যালিয়েনদের আক্রমণ প্রতিহত করবে। এজন্যই সে ভবিষ্যতে টাইম মেশিনে জার্নি করার পথ খুঁজছে। একইসঙ্গে মানবদেহ ক্লোনিং করার বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছে।