খুলনায় লোডশেডিংয়ে জনভোগান্তি, প্রভাব শিল্প ও কৃষিতে
কয়েকদিন ধরে তীব্র তাপদাহ চলছে খুলনা বিভাগে। গরমের কারণে বেড়েছে বিদ্যুৎচালিত পাখা ও এয়ার কন্ডিশনারের (এসি) ব্যবহার। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও জাতীয় গ্রিড থেকে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় বেড়েছে লোডশেডিং।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি)-এর পাবলিক রিলেশন অফিসার এ. বি. এম. বদরুদ্দোজা খান বলেন, 'কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই কয়েকটি অঞ্চলে লোডশেডিং আছে।'
খুলনা শহরে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)।
ওজোপাডিকোর তথ্যমতে, বুধবার (১৯ এপ্রিল) খুলনা শহরে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৭৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫২ মেগাওয়াট। বাকি ৫২ মেগাওয়াটের লোডশেডিং রয়েছে।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার শহরে, ৩৭টি পৌরসভায়, দুটি সিটি কর্পোরেশনে ও ২১টি উপজেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওজোপাডিকো। বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকায় খুলনা শহরের মতো অন্যান্য জেলায়ও ধারাবাহিকভাবে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে।
ওজোপাডিকো'র প্রধান প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'ওজোপাডিকো'র আওতাধীন এলাকায় দুপুরে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৯৬ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ৬০১ মেগাওয়াট। অর্থাৎ লোডশেডিং রয়েছে ৯৫ মেগাওয়াটের।'
অন্যদিকে খুলনার উপজেলাগুলোতে বিদ্যুৎ বিতরণ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, 'বর্তমানে আমাদের দিনের বেলা প্রায় ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা আছে। চার থেকে পাঁচদিন আগে আমরা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ পেয়েছিলাম। তাই গ্রামে বেশি লোডশেডিং হয়েছে।
'তবে গতকাল আমরা ৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ায় লোডশেডিং কমাতে পেরেছি। আজও প্রায় আট থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং থাকবে।'
তিনি জানান, খুলনার মতো বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও দিনে আট থেকে ১৫ মেগাওয়াটের লোডশেডিং রয়েছে।
এ. বি. এম. বদরুদ্দোজা খান বলেন, 'বৃষ্টি না হলে এ পরিস্থিতির উত্তরণ হবে না।'
তীব্র জনভোগান্তি
প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে লোডশেডিং থাকায় খুলনাঞ্চলে বেড়েছে জনভোগান্তি। খুলনা শহরের হাফিজ নগর এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আলী বলেন, 'একদিনে অন্তত আটবারও লোডশেডিং হচ্ছে। যার প্রত্যেকটির ব্যাপ্তি ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত।'
'খুলনাতে গরমেও রেকর্ড করেছে, সাথে লোডশেডিংয়েও রেকর্ড করেছে। এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিদ্যুৎ যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে আসছে!' খেদোক্তি করেন শহরের ইকবাল নগরের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের সিনিয়র আবহাওয়া কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে খুলনাঞ্চলের প্রত্যেক জেলায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়ার ওপরে তাপমাত্র বিরাজ করছে। এছাড়া আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় শরীরে অস্বস্তিকর অনুভূতি বেশি হচ্ছে।
ক্ষতিতে রপ্তানিমুখী মৎস্য খাত
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)-এর পরিচালক এস. হুমায়ুন কবীর জানান, পচনশীল পণ্য হওয়ায় চিংড়িকে সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এছাড়া চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতি ধাপে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, 'চিংড়ি ঘেরের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে সারাক্ষণ বিদ্যুৎচালিত অ্যারেটর (বায়ুবাহক) ব্যবহার করতে হয়। লোডশেডিং হলে চিংড়ির উৎপাদন কমে যায়, কখনো কখনো সব মাছই মারা যায়।'
হুমায়ুন কবীর বলেন, 'একটি কারখানায় বরফ জমাতে একটানা ১৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দরকার হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর ব্যবহার করে বরফ তৈরি করতে হচ্ছে। ফলে বরফের দাম অনেক বেড়ে গেছে।'
বাংলাদেশে মোট ১০৫টি হিমায়িত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত করা হয় খুলনার বিভিন্ন কারখানায়।
বিএফএফইএ-এর পরিচালক জানান পল্লী বিদ্যুতের আওতাভুক্ত কারখানাগুলোতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা এবং ওজোপাডিকো'র আওতাভুক্ত কারখানায় সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে উৎপাদন হ্রাস
খুলনা শহরের শেখপাড়া এলাকায় গড়ে উঠেছে হালকা প্রকৌশল খাত। দিনের বেলায় বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হওয়ায় ক্ষতিতে পড়েছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
শরিফুল নামক এক ব্যবসায়ী বলেন, 'লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পারছি না। দৈনিক কাজের সময়ের তিনভাগের দুইভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না।'
লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে খুলনাঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও। শহরের সোনাডাঙ্গা এলাকায় অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল তৈরি করেন মোদাচ্ছের আলী।
তিনি বলেন, অ্যালুমিনিয়ামের পাত কাটা, তা থেকে পাতিল তৈরি করার জন্য যে মেশিন ব্যবহার করা হয়, তা বিদ্যুৎ ছাড়া চালানো যায় না।
ঈদের আগে কাজের প্রচুর চাপ রয়েছে খুলনার দর্জির দোকানগুলোতে। লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে সেখানেও।
শহরের আফতাব চেম্বারের দর্জি শরিফুল বলেন, 'আমার দোকানে এখনো ১,৮০০টি শার্ট, প্যান্ট ও স্যুটের অর্ডর রয়েছে। ২০ জনের মতো দর্জি পোশাক তৈরি করছেন। তবে এখন সেলাই মেশিনগুলো বিদ্যুতে চলে। তাই লোডশেডিংয়ের কারণে সঠিক সময়ে পোশাক সরবরাহ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।'
এছাড়া লোডশেডিংয়ের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তরমুজ চাষিরাও। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে খুলনায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে তরমুজ চাষিরা ক্ষেতে পর্যাপ্ত পানি দিতে পারছেন না।
দাকোপের কৌলাসগঞ্জ এলাকার কৃষক নরেন্দ্র মণ্ডল বলেন, 'দিনের বেলা কোনো কোনো দিন আট ঘণ্টাও লোডশেডিং হয়েছে। ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করতে খরচ বেশি হয় বলে বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে সেচ দেই।'