প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে উদযাপিত হলো রেকর্ড স্টোর ডে
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উদ্যাপিত হলো ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্টোর ডে। আজ ২৯ এপ্রিল শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটের ডেইলি স্টার ভবনের আর্ট গ্যালারিতে দিনব্যাপী গানের রেকর্ড প্রদর্শনী ও আলোচনার মধ্য দিয়ে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্টোর ডে উদ্যাপিত হয়।
সংগীতে ভাইনাল রেকর্ডের ব্যবহারকে আরও জনপ্রিয় করতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ। সকাল দশটায় প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বরেণ্য সংগীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। তিনি বলেন, '১৯৬৫ কি ৬৬ সালে জীবনের প্রথম রেকর্ড যখন বের হলো, তখন রেকর্ডটি হাতে নিয়ে ভাবলাম। কী অদ্ভুত বস্তু আমার হাতে! এর মধ্যে আমার গান আছে। সেই থেকে তিন-চারটি স্তর পার হয়ে আজকে আমরা উপস্থিত হয়েছি ইন্টারনেটের যুগে। এখন একটি বোতাম টিপলেই লক্ষ লক্ষ হাজার হাজার গান এসে হাজির। একটি কথা কি আমাদের ভাবার অবকাশ আছে? সেই সময় যারা গান করেছেন বা শুনেছেন তারা কত কষ্ট কত অপেক্ষা করে একটি গান করতে কিংবা শুনতে পারতেন। আমি যখন স্কুলে পড়ি, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পূজার সময় নতুন রেকর্ড কিনতাম। দুই পাশে দুটি গান। এই দুটি গানের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করতাম।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন কথা হলো, ইন্টারনেটের এই যুগে যেখানে বোতাম টিপলেই হাজার হাজার গান এসে হাজির হয়, সেখানে আরপিএম কিংবা ভাইনাল রেকর্ডের কী প্রয়োজন আছে? ইন্টারনেটে গান শোনা যায়, কিন্তু গ্রামোফোন রেকর্ডের কিংবা একটা এলপি রেকর্ডের শব্দের যে গভীরতা যে গাম্ভীর্য যে ডিটেইলস এটা মোটেই ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না। সেজন্য আমি বলি, সংগীতের অন্তর্নিহিত অবিমিশ্র আনন্দের সন্ধান যারা করেন, তাদের অবশ্যই গ্রামোফোন বা ভাইনাল রেকর্ডের দ্বারস্থ হতে হবে।'
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক হিসেবে ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি গান নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, '১৯৬২ সাল থেকে ঢাকায় বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেখানে গান একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। সে গান ছিল গণসংগীতমূলক, দেশের গান। রবীন্দ্র সংগীত হোক, নজরুল, রজনীকান্ত, আধুনিক হোক, আমাদের সকল অনুষ্ঠানে গানের বিষয় ছিল দেশের গান। এই গানের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সে সময় এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সেরা শিল্পীদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের কণ্ঠশিল্পীরা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এই যে রেকর্ড সংগ্রহ করা, এটা একটা পাগলামি। এরকম পাগল আছে বলেই সমাজ সুন্দর থাকে। এই রেকর্ড সংগ্রহ করার মাধ্যমে শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন। এই গান সংগ্রহ যদি আমদের মধ্যে বৃদ্ধি পায় তাহলে একটা ভালো কাজ হবে।'
অতিথি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, 'আমাকে যখন দাওয়াত দেয়া হয়, তখন আমার সত্যিই অবাক লাগল। ভাবলাম, মানুষ এই ধরনের কাজ করে বলেই তো সমাজ টিকে থাকে। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ।'
আরেক অতিথি লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন তার বক্তব্যে বলেন, 'ব্যক্তিগতভাবে যারা সংরক্ষণ করেছেন, সেটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সরকারি হোক বা অন্য কোনো সংস্থা হোক বা কোনো সহৃদয় ব্যক্তি যদি এর সঙ্গে জড়িয়ে একটা বড় স্টোর করতে পারেন, সেটা হবে দারুণ একটি উদ্যোগ। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, স্বাধীনতার পরপরই যে ঢাকা রেকর্ড থেকে একটা রেকর্ড করেছিলাম সেটি আর আমার কাছে নেই। এটি আমার দুর্ভাগ্য। আইসিআই কোম্পানি থেকে করেছিলাম। পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের গান এবং লালন ফকিরের গান। সেটিও আমার কাছে নেই।'
প্রতি বছর এপ্রিল মাসের তৃতীয় শনিবারে বিশ্বব্যাপী ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্টোর ডে উদযাপিত হয়। এ বছর দিবসটি উদযাপিত হয়েছে গত ২২ এপ্রিল। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর ও রমজানের কারণে ঢাকায় এক সপ্তাহ পিছিয়ে আজ ২৯ এপ্রিল শনিবার রেকর্ড স্টোর ডে উদযাপন করা হলো।
ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্টোর ডে, অনন্য ও অসাধারণ এই দিবসটির ধারণা প্রথম আসে আমেরিকার বুল মুজ মিউজিক-এর মালিক ক্রিস ব্রাউন এবং ক্রিমিনাল রেকর্ডস-এর মালিক এরিক লেভিনের মাথা থেকে। তাদের যৌথ চেষ্টায় ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ার্ল্ড রেকর্ড স্টোর ডে উদযাপিত হয়। বর্তমানে এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়।
২০০৭ সালে প্রথম রেকর্ড স্টোর ডে উদযাপিত হয়। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে সব মিলিয়ে রেকর্ড বিক্রি হয়েছিলো মাত্র দেড় মিলিয়ন। পরের বছর দ্বিগুণেরও বেশি রেকর্ড বিক্রি হয়। সংখ্যায় দাঁড়ায় সাড়ে তিন মিলিয়ন। এরপর বিস্ময়করভাবে প্রতি বছরই রেকর্ড বিক্রির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
২০২২ সালের হিসাব বলছে, বছরটিতে আমেরিকায় গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রির সংখ্যা ৪১ মিলিয়ন, যেখানে সিডি বিক্রির সংখ্যা ৩৩ মিলিয়ন। বলে রাখা ভালো, ১৯৭০-এর দশকে প্রথমে ক্যাসেট এবং পরে ১৯৮০-র দশকে সিডির আগমনে গ্রামোফোন রেকর্ড তার বাজার হারিয়ে ফেলেছিল।
গ্রামোফোন রেকর্ড-এর মাধ্যমে উপমহাদেশেও বাংলা, হিন্দি ও ঊর্দু গানের বড়সড় একটি বাজার ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেশিরভাগ গান প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে। ঢাকায় ছিল ঢাকা রেকর্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের প্রথম রেকর্ড গোপনে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই বের হয়েছিল বলে অনেকে ধারণা করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের বহু চলচ্চিত্র এবং আধুনিক গানের রেকর্ডও এই ঢাকা রেকর্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, যা এখন শুধুই ইতিহাস।
উল্লেখ্য, রেকর্ড স্টোর ডে উদযাপন শুরুর পর থেকে গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রচার ও প্রসার পুনরায় বাড়তে শুরু করে। যে কারণে ধরে নেয়া যায়, রেকর্ড স্টোর ডে উদযাপনের মধ্য দিয়ে সংগীতকে আরও শুদ্ধরূপে শোনার সুযোগ পাওয়া যাবে। একইসঙ্গে বিশ্ব সংগীতের রস আস্বাদনেরও সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক জিয়া আহমেদের স্বাগত বক্তব্য দেয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সঞ্চালনায় ছিলেন নাবিলা আনজুম। আলোচনা অনুষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা রেকর্ডগুলোর প্রদর্শনী হয়।