বেদের বহর, সাপের বাজার; দুর্লভ ‘শিশু’ অজগর
বর্ষাকালে শীতলক্ষ্যা চলে আসত একেবারে ঘরের দুয়ারে। কোনো কোনো সকালে ঘুমভাঙা চোখ নিয়ে বাড়ির উত্তর দিকে তাকাতেই দেখতে পেতাম অদ্ভুত সুন্দর সারি সারি নৌকা ভেসে আছে নদীর জলে। আনন্দে নেচে উঠত মন, এগুলো বেদের নৌকা। লোকে বলতো 'বাইদ্যার বহর'। বাড়ির পাশে বেদের বহর আসলে আমার বেশিরভাগ সময় কাটত বহরের দুরন্ত বালকদের সঙ্গে। পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে সারা দিন তারা গুলতি নিয়ে গ্রামের ঝোপ-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। এয়ারগান হাতে আমিও তাদের সঙ্গে থাকতাম। ওইসব খুদে শিকারিদের লক্ষ্যভেদ দেখে আমি হতবাক হয়ে যেতাম। নিপুণ লক্ষ্যভেদ।
শিকার শেষে বিকেল বেলা ব্যাগভর্তি পাখি নিয়ে ওরা যখন নদীর ধারে এসে দাঁড়াত, তখন ছোট ছোট কোষা নৌকা এসে তাদের বহরে নিয়ে যেত। ওদের সেই জীবন আমাকে এতটাই রোমাঞ্চিত করেছিল যে রাতে শুয়ে মনে মনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতাম, পরজন্মে তিনি যেন আমায় বেদে বালকরূপে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। নৌকায় করে আমি দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়াব, পড়ালেখার কোনো চিন্তা থাকবে না, থাকবে না স্কুলে যাওয়ার তাড়া; সারাদিন শুধু গুলতি নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো। আহা কী শান্তির জীবন!
চমৎকার শিল্পশৈলীর ছোঁয়া ছিল বহরের নৌকাগুলোতে। সামনে-পেছনে দরজা, দুপাশে বেশ কয়েকটি জানালা, উপরে টিনের সমতল ছাদ। ঠিক যেন এক ভাসমান বসতবাড়ি। কোনো কোনো নৌকার গইলুয়ে দেখা যেত অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি চকচকে নকশা। প্রত্যেক নৌকার দিকে তাকালেই আসলে বসতকারীর অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝা যেত। সবচেয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত সাজে দেখা যেত সরদারের নৌকা, যার গলুইয়ে ফুটে থাকত কাঠের নকশাকাটা অতিকায় ময়ূরের মাথা—এ যেন এক ময়ূরপঙ্খী নাও।
বহরের নৌকাগুলোতে সাপ ছাড়াও বহু ধরনের বৈচিত্র্যময় জিনিস লক্ষ করা যেত। এগুলোর মধ্যে লড়াকু জাতের লাল ঝুঁটিওয়ালা বিশাল আকৃতির মোরগ, ডাহুক, কোড়াসহ নানাজাতের শিকারি পাখি, পাখি ধরার বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, মাছ শিকারের কয়েক ধরনের টেটা এবং কোচ, পোষা উদবিড়াল, খেলা দেখানো বানর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসবের আকর্ষণে তখন আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল বহরে।
বেদের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক আমাকে দারুণভাবে চিন্তিত করে তুলত। তাদের সাপ ধরা, সাপ পোষা এবং সাপকে আহার করানো এসব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমার প্রধান কাজ। গোখরা এবং দাঁরাশকে তারা যেভাবে বেদে বালকদের শিকার করা দোয়েল, বুলবুলি কিংবা শালিক খাওয়াত সে দৃশ্য এখনো চোখে ভেসে আছে। সাপের মুখ ফাঁক করে আস্ত পাখি ঢুকিয়ে দেওয়া হতো সেটার ভিতর, পাখির কিছু অংশ মুখের মধ্যে যাওয়ার পর কাঠি দিয়ে খুচিয়ে সেটাকে গলা পর্যন্ত নামানো হতো। তারপর হাত দিয়ে পাখিটাকে তারা টেনে নামিয়ে দিত সাপের পাকস্থলী পর্যন্ত। এভাবে আহার করানোর পর তারা বেশ কিছুক্ষণ সাপের মুখ চেপে ধরে রাখত। কারণ অনেকসময় এই অনিচ্ছুক আহারক্রিয়া সাপের মধ্যে বমির উদ্রেক করত। এভাবে সাপকে খাওয়ানোর ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই পাশবিক লাগত।
জীবিকার সন্ধানে গ্রাম আর হাটবাজারে ঘুরে বেড়ানো বেদে আর বেদেনীরা শেষ বিকেলে ফিরে আসত বহরে। সন্ধার সময় বহর যেন প্রাণ ফিরে পেত। বেদেনীরা নৌকার গলুইয়ের পাশে চুলা জ্বালিয়ে রাতের রান্নার আয়োজনে বসে পড়ত। পশ্চিম আকাশের টকটকে লাল আভার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্বলে উঠত তাদের চুলার আগুন। নদীপাড়ে এসে আমি আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ওই ভাসমান জনপদ আমাকে চুম্বকের মতো কাছে টানত। কী অপার বৈচিত্র্যে ভরা মানুষগুলোর জীবন; নৌকায় জন্ম, নৌকায় মৃত্যু। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাট, এক বন্দর থেকে আরেক বন্দর, আমৃত্য জলের বুকে ঘুরে বেড়ায় তারা। এমন সার্থক জন্ম কজনার হয়। অন্তত একটা রাত বহরের কোনো নৌকায় কাটানোর বড় সাধ ছিল আমার। রাতে আমার ঘুম আসত না। অপূর্ব এক আবেশ নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকতাম। শিশুদের কান্নার আওয়াজ, বেদেনীদের উচ্চকিত হাসির শব্দ, উদাস কোনো বেদে যুবকের বাঁশির সুর, মাঝেমধ্যে বহর স্তব্ধ করে দেয়া সরদারের গর্জন—এসব আমার ঘুম কেড়ে নিত।
এরপর কোনো এক সকালে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখা যেত, খাঁ খাঁ করছে নদীর বুক। চলে গেছে বহর, অন্য কোনো ঘাটের উদ্দেশ্যে, অন্য কোন বন্দরে। এভাবে প্রতি বর্ষায় বহরের আগমন আর প্রস্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত আমার মনের মিলন আর বিরহের খেলা। তারপর আমি লক্ষ করতে লাগলাম, ক্রমেই কমে আসছে বহরের আগমনের মাত্রা।
শীতলক্ষ্যা এখনো প্রতি বর্ষায় যৌবনবতী হয়ে আছড়ে পড়ে আমাদের উঠানের পাশে, কিন্তু বহর আর আসে না। ঐতিহ্যবাহী সেসব বেদে নৌকা চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে জলের বুক থেকে। আধুনিক সভ্যতার চাপে বেদে সম্প্রদায় আজ কোণঠাসা। জলের কোমল বুক ছেড়ে এখন তাদের ঠাঁই হয়েছে ডাঙার কঠিন জমিনে।
বেদে সম্প্রদায়ের অন্য নাম হচ্ছে 'মানতা'। এটি বহুল প্রচলিত না হলেও বেদেরা নিজেদের এই নামে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। বেদে অর্থাৎ মানতা সম্প্রদায় আদিকাল থেকে বিভিন্ন গোত্র বা উপগোত্রে বিভক্ত। প্রধান তিনটি গোত্র হচ্ছে: মাল মানতা, বাজিকর মানতা এবং সান্দর মানতা। মাল মানতা গোত্রটি সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। এদের জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণই সাপনির্ভর। এরা সাপ ধরে, সাপের খেলা দেখায়, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করে এবং সাপ নিয়ে নানারকম ব্যবসায়িক কাজকর্ম করে থাকে। বাজিগর মানতারা হাটবাজারে জাদুমন্ত্র দেখিয়ে তাবিজ-কবচ বিক্রি করে থাকে, এরা নাচ-গানে বিশেষ পারদর্শী। সান্দর মানতা নামের উপগোত্রটি আবার লাওয়ার এবং গায়েন নামে বিভক্ত। লাওয়ারদের পেশা মাছ শিকার। ওরা সাধারণ জেলেদের মতো জাল দিয়ে মাছ ধরে না। মাছ শিকারে ওরা ব্যবহার করে বড়শি এবং ট্যাঁটা। দিনের বেলায় হাজার ফুট লম্বা বড়শি ফেলে রাখে নদীর তলদেশে, যা লড়বড়শি নামে পরিচিত। ছোট আকৃতির মাছ থেকে শুরু করে বিশাল বোয়াল কিংবা চিতল পর্যন্ত লড়বড়শিতে আটকা পড়ে। লাওয়াররা রাতের বেলা নৌকার সামনে হ্যাজাকের আলো জ্বেলে ট্যাঁটা নিয়ে মাছ শিকারে বের হয়। আমি বহুবার যেমন তাদের সঙ্গে মাছ শিকার গিয়েছি, তেমনি অসংখ্যবার বিস্মিত হয়েছি জলের ৮-১০ ফুট গভীর থেকে ওদের ট্যাঁটাবিদ্ধ মাছ নৌকায় তুলে আনা দেখে। অতল জলে এমন নিপুণ লক্ষ্যভেদকারী শিকারি পৃথিবীর আর কোথায় আছে! সান্দর মানতাদের গায়েন নামে অন্য গোত্রটির নারী-পুরুষ আলাদা আলাদা পেশায় জড়িত। নারীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাচের থালা-বাসন বিক্রি করে আর পুরুষেরা তালা-চাবি ঠিক করার কাজ করে থাকে। তবে এরা বিশেষভাবে মনিহারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।
দিন যায়, দিন আসে, বেদের কথা ভুলতে পারি না। সময় তখন ২০০৭, সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় তিন লক্ষ মানুষের বাস। এদের একটা বিরাট অংশ বসবাস করত ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভারের পোড়াবাড়ি, বক্তারপুর, ওমরপুর ও কাঞ্চনপুর এলাকাজুড়ে। সমস্ত এলাকায় ছিল প্রায় ৮০০-র অধিক বেদে পরিবারের বাস। ওদের সঙ্গে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাভারের পোড়াবাড়ির সেই আশ্চর্য সাপের বাজারের কথা আমার জানা ছিল। কিন্তু কোনো সময় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই এক সকালে ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বাসে উঠে রওনা দিলাম সাভারের উদ্দেশে। ঘণ্টা দেড়েক পর বাস আমাকে নামিয়ে দিল সাভার বাজারে। একটা রিক্সা নিয়ে পশ্চিম দিকের নামা বাজার পার হয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম পোড়াবাড়ি গ্রামে। ওখানে নেমে প্রথমেই খোঁজ করলাম আব্বাস লস্করের। একসময় তার সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রায় এক যুগ আগে এক নৌবহরের সর্দার ছিল আব্বাস লস্কর। আমি যেমন বহুবার তাকে সঙ্গে নিয়ে শিকারে গিয়েছি, তেমনি সে-ও সাপ ধরার উদ্দেশ্যে বহু জায়গায় আমাকে নিয়ে গেছে, শেখানোর চেষ্টা করেছে সাপ ধরার কৌশল। আমি জানতাম সেই বহর বিলীন হয়ে যাওয়ার পর লস্কর এখন স্থায়ীভাবে পোড়াবাড়িতে বসবাস করে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর জানতে পারলাম লস্কর এখন গ্রামে নেই। লোকজন নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে গাওয়ালে গেছে। গাওয়াল হচ্ছে জীবিকার অন্বেষণে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। এ সময়টাতে তারা খোলা জায়গায় পলিথিনের তৈরির তাঁবু পেতে রাত্রি যাপন করে।
তবে লস্করকে খুঁজে না পেলেও আজবাহার আলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সাপ ধরায় ওস্তাদ এই মাল মানতা বহরের সঙ্গে বহুবার আমাদের এলাকায় গিয়েছে। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও পরিচয় ছিল। আমাকে দেখে বেশ অবাক হলো, পাশাপাশি সব ধরনের সাহায্য করার আশ্বাস দিল। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম পোড়াবাড়ি বাজারের দিকে। একসময় দূর থেকে বাজারটাকে দেখতে পেলাম। বাজারের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা সড়কের দুপাশে সাজিয়ে রাখা সারি সারি ছোট-বড় কাঠের বাক্স আমার নজর কেড়ে নিল। একসময় পা রাখলাম পোড়াবাড়ির বিখ্যাত সেই সাপের বাজারে, যেখানে আলু-পটলের মতো বিক্রি হয় সাপ। বাক্সভর্তি সাপ নিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। বড় আকারের বাক্সগুলির কোনোটায় অজগর, কোনোটায় অনেকগুলো করে সাপ। আসছে ক্রেতা, চলছে দরদাম। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী যেসব বেদেরা হাটবাজারে মজমা জমিয়ে সাপের খেলা দেখায়, তারাই মূলত এখানকার প্রধান ক্রেতা। প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্র এবং গবেষকরাও সাপ কিনতে আসে এখানে। এছাড়াও এখানে এক ধরনের ক্রেতা আসে যারা সাপ কিনে নিয়ে বিক্রি করে বিদেশিদের কাছে, সাপের মাংস যাদের কাছে অতি উপাদেয় খাদ্য।
বিস্ময়কর এই সাপের বাজারে শুধু সাপ বেচাকেনা হয় না, চলচ্চিত্র এবং নাটকের জন্য সাপ ভাড়াও দেওয়া হয়। ভাড়া করা সাপের সঙ্গে একজন প্রশিক্ষিত বেদেও থাকে। তাকে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক প্রদান করতে হয়। এখানকার সাপের বাজারে যে সাপটির সবচেয়ে বেশি চাহিদা তার নাম হচ্ছে কালনাগিনী। বলতে গেলে এটা হচ্ছে বাংলাদেশের সুন্দরতম সাপ। খেলা দেখানোর ছলে এই সাপের বাহারি রঙের সুবিধা নিয়ে বেদেরা নানা ভয়ংকর গল্প ফেঁদে বসে। হালকা বিষধর এই সাপ তখন দর্শকদের কাছে হয়ে ওঠে এক ভয়ংকরের প্রতিমূর্তি। অন্যান্য ব্যবসার মতো এখানেও সাপের মূল্য ওঠানামা করে আমদানি ও চাহিদার উপর। যেকোনো পূর্ণবয়স্ক একটি বিষধর গোখরা কেনা যায় মাত্র ১ হাজার টাকায়, ছয় ফুট দাঁড়াশের মূল্য খুব বেশি হলে ৬০০ টাকা। কালনাগিনী সাপের এত যে চাহিদা, তবু এর মূল্য কখনো ৭০০ টাকার ওপরে উঠে না।
আজবাহার আলী আমাকে একটা নতুন তথ্য দিল। জানলাম পোড়াবাড়িতে রয়েছে একাধিক সাপের আড়ত। বেদেরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাপ ধরে এনে তা প্রথমে বিক্রি করে আড়তদারদের কাছে। খুচরো বিক্রেতারা সাপ সংগ্রহ করে এসব আড়তদারদের কাছ থেকে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে আজবাহার আলী একটি আড়তে গেল। সাপ ব্যবসায়ীরা নিজেদের বসতবাড়ির যেকোনো একটি ঘরকে আড়ত হিসেবে ব্যবহার করে। দেখা গেল ঘরভর্তি ছোট-বড় বাক্স। আজবাহার আলীর অনুরোধে আড়তদার আমাকে বাক্সগুলো খুলে দেখাতে রাজি হলো, তবে একটা শর্ত—ছবি তোলা যাবে না। রাজি হয়ে গেলাম। একের পর এক বাক্স খোলা হলো। বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল মন। কী নেই এখানে—রাজগোখরা থেকে শুরু করে কুকরি, অজগর থেকে বৃহৎ দুমুখা সাপ। এত প্রজাতির সাপ দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। একটাই কষ্ট শুধু মনে, ছবি তোলা গেল না।
আড়ত থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটছিলাম বেদে পল্লীর একটা গলি দিয়ে। তরুণী বেদেনীরা নির্দিষ্ট তালে হেঁটে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে, ওদের হাঁটার ভঙ্গিকে একমাত্র তুলনা করা চলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্যাটওয়াকের সঙ্গে। ওদের কয়েকজন এতটাই সুন্দরী, বারবার মনে হচ্ছিল এজন্যই হয়তো আগেকার রাজপুত্ররা বেদেনীর প্রেমে পাগল হয়ে ঘর ছাড়ত। যাক সে কথা, হাঁটতে হাঁটতে আজবাহার আলী একসময় আমাকে বলল, মাল মানতা শহিদুলের বাড়িতে একটা সাপ কয়েকটা বাচ্চা দিয়েছে। কথাটা শোনার পর আমি ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। কারণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাপই ডিম পাড়ে, সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে এমন সাপের সংখ্যা খুবই কম। তাই দেরি না করে প্রায় রুদ্ধশ্বাসে ছুটলাম শহিদুলের বাড়ির উদ্দেশে।
ওখানে পৌঁছে শহিদুলকে বাড়িতে পাওয়া গেল। জানা গেল সাপটি সে সংগ্রহ করেছে সিরাজগঞ্জের এক প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। আমাদের অনুরোধে সাপের বাক্সটা সে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। বাক্স খুলে আড়াই ফুট লম্বা নাদুসনুদুস আকৃতির মা সাপটিকে বের করার পর আমি খুব সহজেই তাকে চিনতে পারলাম। এই সাপ দেখতে হুবহু অজগরের বাচ্চার মতো, অনেকের কাছে তাই এরা শিশু অজগর নামে পরিচিত। বালুবোরা কিংবা তুতুর নামেও অনেকে চেনে। তবে বালুবোরা নামটি সর্বাধিক প্রচলিত। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় ঝধহফ ইড়ধ. এরা খুবই বিরল প্রজাতির সাপ। এই সাপের প্রথম জীবন্ত নমুনাটি সংগৃহীত হয়েছিল আমারই হাত দিয়ে। ২০০২ সালের ৩ ডিসেম্বর নরসিংদীর চরসিন্দুর থেকে সাপটিকে উদ্ধার করে গাজীপুরের শালবনে অবমুক্ত করা হয়। এই সাপের শিকার ধরার কৌশল অনেকটা অজগরেরই মতো। ঘাপটি মেরে বসে থাকে শিকারের অপেক্ষায়। শিকার নাগালের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে ধরে পেঁচিয়ে হত্যা করে গলাধঃকরণ করে। এমনিতে এরা স্বভাবের দিক দিয়ে খুবই শান্ত।
মা সাপটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণের পর বাক্স থেকে বাচ্চাগুলোকে বের করতে বললাম। একে একে শিশু অজগরের পাঁচটি বাচ্চাকে বের করে রাখা হলো মায়ের পাশে। ওরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে এক অবাক করা দৃশ্য, যেকোনো বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রীর জন্য এক বিরল মুহূর্ত। একের পর এক ক্যামেরার শাটার চেপে গেলাম। অন্যদিকে দুর্লভ এক আলোকচিত্র ক্যামেরাবন্দি করার প্রশান্তিতে ভরে গেল মন।