রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ার পাশাপাশি মানুষের উচ্চ প্রত্যাশাও সামলাতে হচ্ছে ইউক্রেনের নেতাদের
বিশ্ব যখন ইউক্রেনের পালটা আক্রমণের অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, তখন ইউক্রেনের নেতাদেরকে রাশিয়ার বাধার পাশাপাশি আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হচ্ছে। তা হচ্ছে তাদের কাছ থেকে মানুষের, মিত্র দেশগুলোর নেতাদের তীব্র প্রত্যাশাকে মোকাবিলা করা।
ইউক্রেনের নেতারা বলছেন, রাশিয়াকে হটানোর এ অভিযান দ্রুত শেষ হবে না, বরং এটি অনিবার্যভাবেই কঠিন ও রক্তাক্ত একটি লড়াই হবে।
কিছুদিন আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করা মিত্র দেশগুলোর মনোভাব প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, 'অনেকে আছেন যারা সবকিছু হলিউড সিনেমার মতো চাচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবে তো সেরকম হয় না।'
'আমরা অবশ্যই বড় পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইব,' মন্তব্য করে জেলেনস্কি আরও বলেন, দ্রুত সাফল্যের প্রত্যাশা করা অবাস্তব।
মিত্রদেশগুলো হয়তো ইউক্রেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চেষ্টা করবে কিন্তু 'সবাইকে বিনীতভাবে বলতে চাই, কারও মতামতের ওপর কোনো কিছু নির্ভর করবে না,' বলেন জেলেনস্কি।
তিনি আরও বলেন, ইউক্রেন যেভাবে সর্বোত্তম মনে করবে, সেভাবেই যুদ্ধে এগোবে। সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনের পালটা আক্রমণের সাফল্য আন্দাজ করতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। তারাও মনে করছেন, এ যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি ও রক্তাক্ত হবে।
জেলেনস্কি জানেন, নিজের সেনা এবং বিদেশি সমর্থকদের অনুপ্রাণিত করতে হলে তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে হবে। কিয়েভের কর্মকর্তারা এবং তাদের অনেক বিদেশি সমর্থক পালটা আক্রমণের প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন না হলে তার প্রভাব কেমন হবে তা নিয়ে এখন আশঙ্কা করছেন।
তারা মনে করছেন, ইউক্রেন এ অভিযানে বিশেষ কিছু অর্জন করতে না পারলে দেশটির যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা পশ্চিমা মিত্ররা ধৈর্যহারা হয়ে উঠবেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য ইউক্রেনকে চাপ দিতে থাকবেন।
সেরকম কোনো আলোচনা হলে সেক্ষেত্রে রাশিয়া দখলকৃত ভূমির বিরাট অংশ নিজেদের আয়ত্তে রেখে দেবে বলেই ধারণা করা যায়।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারাও কয়েক সপ্তাহ ধরে বলছিলেন, তাদের পালটা অভিযানের গতি ধীরই হবে। কিয়েভের একজন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী হানা ম্যালিয়ার গত সপ্তাহে বলেছেন, দেশটির বাহিনী অনেকের প্রত্যাশার চেয়ে বেশ কম এলাকা পুনর্দখল করতে পেরেছে কিন্তু এটি 'ছোট ছোট পদক্ষেপে' এগিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের ভূমিরূপ কোনো আক্রমণমুখী দলের জন্য উপযুক্ত নয়। বড় বড় খোলা মাঠ আর অতি অল্প উচ্চভূমির কারণে রাশিয়ান বাহিনীর কাছ থেকে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। আর রাশিয়ানরা গত কয়েক মাস ধরে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যুহ তৈরি করে অবস্থান নিয়েছে।
রাশিয়ান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে মাইনফিল্ড, ট্যাংকবিরোধী গর্ত, পরিখা, কাঁটাতার, কংক্রিটের বাধা, বাংকার, মেশিন গান নেস্ট ইত্যাদি। এ দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে এগোতে বেগ পাচ্ছে ইউক্রেন সেনাবাহিনী।
যদিও ইউক্রেন এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করেনি, তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করতে গিয়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে কিয়েভের বাহিনী, সেই সঙ্গে ব্যর্থ হচ্ছে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানগুলোও।
ইউক্রেন বর্তমানে রাশিয়ান বাহিনীর দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যাতে রিজার্ভ সেনা ব্যবহার করে পরে সাঁড়াশি আক্রমণ করা যায়। কিন্তু এখনো রাশিয়ানদের প্রাথমিক প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করতেই বেগ পাচ্ছে এটি। রাশিয়ার এ প্রতিরক্ষা লাইন অনেক জায়গায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সেথ জোনস বলেন, 'ইউক্রেন এখনো তাদের বাহিনীর বড় অংশ মোতায়েন করেনি, তাই অগ্রগতির এ ধীর লয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই।'
'তারা যদি সর্বশক্তি ব্যবহার করে আক্রমণ করেও বিশেষ দ্রুত এগোতে না পারত, তাহলে তা সমস্যার কারণ হতো,' বলেন তিনি।
যুদ্ধের পুরোটা সময় ভূপাতিত হওয়ার ভয়ে ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি রুশ যুদ্ধবিমান ও অ্যাটাক হেলিকপ্টারগুলো। কিন্তু এখন খোলা ময়দানে এগুলো সহজেই ইউক্রেন বাহিনীর ওপর হামলা করতে পারবে।
গত সেপ্টেম্বরে উত্তরপূর্ব খারকিভ অঞ্চল ও দক্ষিণের শহর খেরসনের অনেক অংশ রাশিয়ানদের কাছ থেকে বেশ দ্রুতগতিতে উদ্ধার করতে পেরেছিল ইউক্রেন। কিন্তু তখন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এত শক্তিশালী রুশ প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর মোকাবিলা করতে হয়নি।
'খারকিভের মতো এবারও দ্রুত কিছু ঘটা অসম্ভব। কারণ এখানে ফ্রন্টলাইন, ভূমিরূপ, আবহাওয়া পরিস্থিতি সবকিছুই সম্পূর্ণ ভিন্ন,' গত সপ্তাহে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা লাইনের সবচেয়ে অভেদ্য অংশ সম্ভবত এর মাইনগুলো। আর রাশিয়ার কাছে 'মাইনের কোনো অভাব নেই' বলে দাবি করা হয়েছে ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি)-এর এক প্রতিবেদনে।