মেহেদি, দান, প্রার্থনা ও উৎসবের রঙে রাঙা ঈদ
পরিষ্কার, কোনো প্রকার ভাঁজ ছাড়া পোশাক গায়ে দেওয়া, মসজিদে নামাজ, মেহেদির রঙে হাত রাঙানো, কুরবানি দেওয়ার পর মাংস প্রস্তুত করে প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া, আর বাড়িতে বাড়িতে সুস্বাদু রান্নার সুগন্ধ...পবিত্র ঈদুল আজহার অতি পরিচিত দৃশ্য এটি।
বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মধ্যে ঈদুল আজহার উদযাপনে কিছু সাদৃশ্য চোখে পড়বেই, তা যে অঞ্চলেই হোক না কেন। পবিত্র জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার ভিত্তিতে বাংলাদেশে আগামীকাল (২৯ জুন) উদযাপন হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই আজ (২৮ জুন) উদযাপিত হচ্ছে ঈদ।
ঈদ মানেই বাড়তি খুশি, তা তো সবারই জানা। কিন্তু ঈদুল আজহা মুসলমানদের জন্য ত্যাগের উৎসব। হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। এসময় হজ পালন করতে প্রতিবছর হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ছুটে যান সৌদি আরবে।
কোরবানির ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা। হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানির জন্য মহান আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ পেয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)–এর সুন্নত অনুসরণ করেই সারা বিশ্বের মুসলমানরা ১০ জিলহজ কোরবানি দিয়ে থাকেন। মুসলমানরা গরু, ছাগল, দুম্বা, ভেড়া ইত্যাদি কুরবানি দেওয়ার মাধ্যমে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করেন।
তবে সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন মুসলিম দেশে ঈদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি প্রচলিত হয়েছে, যেগুলো শুধুই তাদের। ধর্মীয় নিয়মকানুন এবং আঞ্চলিক রীতির সংমিশ্রণে তারা নিজেদের মতো করে ঈদ পালন করে থাকেন। বিভিন্ন অঞ্চলের ঈদুল আজহা উদযাপনের তেমনই কিছু চিত্র তুলে ধরা হলো এখানে:
মধ্যপ্রাচ্য
ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, ঈদের সময় মিষ্টান্ন এবং নানা মুখরোচক খাবার তৈরি করা ছাড়া যেন ঈদ পূর্ণতা পায় না মধ্যপ্রাচ্যে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব জলখাবার এবং ভারি খাবারের রেসিপি, যেগুলো শুধুমাত্র ঈদের দিনই প্রস্তুত করা হয়।
বাহরাইনের রাজধানী মানামায় রাস্তার পাশের দোকানে তাকালেই দেখা যাবে টানানো রয়েছে ঐতিহ্যবাহী পোশাক জালাবিয়া। আবার লিবিয়ার ঘোড়সওয়াররা আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরে, ঘোড়ায় চড়ে প্রথাগত উপায়ে উদযাপন করেন ঈদ। ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সবাই নিজেদের সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটিই বেছে নেন ঈদের দিনে।
এশিয়া
আগরবাতি জ্বালানো, সুগন্ধি আতর মেখে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া, ঈদের দিন সকালে মিষ্টিমুখ, মেহেদি দেওয়া... পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ঈদ মানেই যেন এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে ইদের আগেরদিন রাতে মেয়েদের হাতে মেহেদি দেওয়ার দৃশ্য অতি পরিচিত। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরাও হাতে মেহেদি দেন ঈদ উপলক্ষ্যে।
আফ্রিকা
আইভরি কোস্ট থেকে শুরু করে কেনিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের আরও অনেক মুসলিম দেশে ঈদুল আজহার দিন জনসমক্ষে পশু কোরবানি করা হয় এবং ঈদের দিন সকালে এই দৃশ্য দেখার জন্যই আশেপাশে ভিড় জমে যায় ছেলেবুড়োদের।
ঈদের সময় ঐশ্বর্য প্রদর্শনে কোনো কমতি থাকে না, তবে দানও করা হয় প্রচুর। নাইজেরিয়ায় কানোর আমিরকে স্বাগতম জানানোর অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকায় অসংখ্য এনজিও ঈদের সময় সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাদের মধ্যে খাবার বিতরণ করে।
লাতিন আমেরিকা
পিউ রিসার্চ সেন্টার এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকায় প্রায় ছয় মিলিয়ন মুসলিম রয়েছেন; যদিও তারা বলেছে যে এই সংখ্যা বেশিও হতে পারে। দেশটির আদিবাসী ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঈদ উদযাপন করে থাকেন; তবে মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘু।
যেমন, মেক্সিকোতে ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মুসলিম জনগোষ্ঠী ০.২ শতাংশেরও কম। অভিবাসী এবং অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত হওয়া মানুষেরা মিলেই মেক্সিকোর মুসলিম সম্প্রদায়।
ঈদের দিন খাওয়াদাওয়া, প্রার্থনা এবং পরিবারকে সময় দেওয়ার মাধ্যমেই উদযাপন করেন তারা।
উত্তর আমেরিকা
পিউ রিসার্চ সেন্টার এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় চার মিলিয়ন মুসলিমের বসবাস।
কানাডা সরকারের ২০২২ সালের ডেটা অনুযায়ী, দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ১.৭ মিলিয়ন। এই দুটি দেশে প্রচুর অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায় থাকায় ঈদ উদযাপনও হয় বর্ণিল। ঈদের দিন সকালে মসজিদে নামাজ পড়তে যান তারা এবং ঈদ আনন্দ উদযাপন করেন।
ইউরোপ
অভিবাসী ও শরণার্থীদের মিলিয়ে ইউরোপেও মুসলিমের সংখ্যা কম নয়। আফ্রিকা, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ এলাকা থেকে ইউরোপে চলে আসা প্রচুর মুসলিম রয়েছেন যারা এখানে ঈদ উদযাপন করবেন। আর সাহায্যকারী গোষ্ঠীগুলোকে ধন্যবাদ দিতেই হয় তাদের সহায়তার জন্য।
গতবছর ইউক্রেনে মুসলিম যোদ্ধারা ঈদের সময় যুদ্ধ থেকে বিরতি নিয়ে আসতে পেরেছিলেন পরিবারের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে।
অস্ট্রেলিয়া
২০২১ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ায় ৮০০,০০০ এরও বেশি মুসলমানের বসবাস। এদের অনেকেই অভিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
ঈদের সময় দেশের দোকানগুলোতে পাওয়া যায় সুন্দর সব জামাকাপড়, সজ্জিত হয়ে ওঠে সিডনি এবং স্থানীয় মুসলিমরা অতিথি ও নব্য রূপান্তরিত হওয়া মুসলিমদের স্বাগত জানান উদযাপনে অংশ নিতে।