ডেঙ্গুর প্রকোপ: প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়েছে ৩-৪ গুণ, সংকট ব্লাড ব্যাগের
ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় ব্লাড ব্যাংকগুলোতে প্লাটিলেটের চাহিদা তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। এদিকে প্লাটিলেটের চাহিদা বাড়ায় ত্রিপল ব্লাড ব্যাগ, প্লাটিলেট কিটের সংকট দেখা দিয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকে।
তবে রোগীর স্বজনেরা প্লাটিলেট নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন হওয়ায় প্লাটিলেটের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু হলেই অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট না দেয়ার পরামর্শ তাদের।
ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে ১৭০-১৮০ ব্যাগ করে প্লাটিলেটের চাহিদা পাচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ব্লাড ব্যাংক। অন্যান্য সময় যার চাহিদা ছিল ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ ব্যাগ। প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী, প্লাটিলেট সরবরাহ করতে পারছেনা ব্লাড ব্যাংকটি।
কোয়ান্টাম ল্যাবের সংগঠকদের একজন শামীমা নাসরিন মুন্নি বলেন, "জুন মাসের শেষ থেকে হঠাৎ করে প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে গেছে, যাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু রোগী। অন্যান্য সময় ক্যান্সার, অ্যানিমিয়া রোগী, নিউ বর্ন বেবিদের জন্য প্লাটিলেটের চাহিদা আসে। সেটি কখনই ৫০ থেকে ৭০ ব্যাগের বেশি ছিলো না।"
''যারা অর্ডার করছে তাদের সবাইকে একইদিনে প্লাটিলেট দিতে পারছিনা, অন্তত ২০% কে পরদিন প্লাটিলেট দিতে হচ্ছে। কিন্তু এখন এমন অনেক রোগী আসছে যাদের হাতে একদমই সময় নেই। এসব ক্ষেত্রে আমরা ডোনার পাচ্ছিনা, রেয়ার গ্রুপ হলে সংকট আরো বেড়ে যায়", বলেন তিনি।
এক ইউনিট প্লাটিলেট কনসেনট্রেটের জন্য চারজন ডোনার প্রয়োজন, যা অনেক রোগীর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না। আবার এফারেসিস প্লাটিলেটের (একজন থেকে এক ইউনিট) জন্য ভালো ডোনার পাওয়াও যায় না। এর খরচ বেশি। কোয়ান্টাম ল্যাবে র্যান্ডম ডোনার প্লাটিলেটের মূল্য ৫,৯৬০ টাকা এবং সিঙ্গেল ডোনার প্লাটিলেটের মূল্য ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা।
হাসপাতালগুলোতে রক্তের একটি বড় চাহিদার যোগান দেয় রেড ক্রিসেন্টের ব্লাড ব্যাংক। প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্লাড ব্যাগের সংকট দেখা দিয়েছে সেখানেও।
রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ ডা. জাহিদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল থেকে আমরা প্লাটিলেটের বেশি চাহিদা পাচ্ছি। তবে প্লাটিলেটের চেয়ে আমাদের উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখন পর্যাপ্ত ব্লাড ব্যাগ নেই। যারা আমদানি করে তাদের কাছেও ব্লাড ব্যাগ নেই। র্যানডম প্লাটিলেট তৈরির জন্য ত্রিপল ব্লাড ব্যাগ লাগে, সেই ব্যাগ এখন বাজারে নেই। এখনো আমরা প্লাটিলেট সরবরাহ করতে পারছি কিন্তু ব্লাড ব্যাংক সংকটের কারণে চার-পাঁচ দিন পর কী হবে এখনো বুঝছিনা।"
রেড ক্রিসেন্টে র্যানডম ডোনার থেকে এক ইউনিট প্লাটিলেটের দাম পড়ে ৪৪০০ টাকা আর সিঙ্গেল ডোনারের প্লাটিলেটের দাম ১৮৬০০ টাকা। গত বছর এটি ১২০০০ টাকা ছিল।
কিটের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবার প্লাটিলেটের দামও বেড়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও হাসপাতালগুলোতে সিঙ্গেল ব্যাগ প্লাটিলেটের বড় যোগান দেয় পুলিশ হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংক।
এ ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ উপপরিদর্শক একেএম সিদ্দিকুল ইসলাম বলেন, "এখন দিনে ২৫-৩০ ব্যাগ প্লাটিলেটের চাহিদা আসছে অন্যান্য সময় যা ৪-৫ ব্যাগ ছিলো। যখন ডেঙ্গু থাকেনা তখন ক্যান্সার, কিডনি রোগীদের মাঝে মাঝে প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয়।"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আসাদুল ইসলাম বলেন, "আগে দিনে ৫-৬ ব্যাগ প্লাটিলেটের চাহিদা আসতো। এখন ১৫ ব্যাগ প্লাটিলেট লাগছে। প্লাটিলেটের চাহিদা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিএসএমএমইউ বছরের শুরুতে ব্লাড ট্রান্সফিউশনের কিট ও ব্লাড ব্যাগ কিনে রেখেছে তাই আমাদের ব্লাড ব্যাগের সংকট নেই।"
অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট না দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়। প্লাটিলেট কমে গেলে রক্তক্ষরণ হয়। প্লাটিলেট ২০ হাজারের কম হলে রোগীকে বাড়তি প্লাটিলেট দিতে হয়। তবে রোগীর স্বজনদের উদ্বেগের কারণে অপ্রয়োজনে প্লাটিলেটের ব্যবহার বাড়ছে, যা বন্ধের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এমএইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার ধর বলেন, "চিকিৎসক ও রোগী সচেতন থাকলে ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার হয় না। সাধারণত ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নামলে আমরা অ্যালার্ট হই। এটা ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। কারো প্লাটিলেট ১৫ হাজারে নামলেও যদি ব্লিডিং না হয়, তাহলে প্লাটিলেট না দিলেও কোন সমস্যা হয় না।"
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, "ডেঙ্গু হলেই রোগীর স্বজনেরা ডোনার প্রস্তুত রেখে প্লাটিলেট দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের চাপ দিচ্ছে। চিকিৎসকেরাও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেনা। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোও লাভের জন্য প্লাটিলেট দিচ্ছে।"
"৯০% ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট দেওয়া হচ্ছে। রক্তের রিপোর্ট দেখে রোগীর চিকিৎসা না দিয়ে রোগী অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। অযাচিত রক্ত দিতে গেলে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। হাসপাতালগুলো অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট দিচ্ছে কিনা তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনিটর করা উচিত", যোগ করেন তিনি।