এখনো কেন কেউ কেউ ঢাকার হাতে তৈরি জুতা পরতে পছন্দ করেন
প্রায় ১০ বছর ধরে রাজধানীর স্থানীয় জুতার দোকানের নিয়মিত গ্রাহক মির্জা জাকারিয়া ব্যাগ। ৫২ বছর বয়সী এই উদ্যোক্তা একজন ভ্রমণ পিপাসুও বটে। সাধারণত তিনি নেপালের মতো দেশে ট্রেকিং করতে যান।
ট্রেকিং বা ঘুরাঘুরির সময় তিনি উডল্যান্ড, টিম্বারল্যান্ড এবং নর্থ ফেসের মতো নামিদামি ব্র্যান্ডের জুতা ব্যবহার করেন। তিনিই আবার ধানমন্ডির ঈদগাহ রোডের দোকানে কারিগরদের হাতে তৈরি জুতাও পরতে পছন্দ করেন।
জাকারিয়া বলেন, 'ধানমন্ডিতে স্থানীয় কারিগরদের হাতে তৈরি জুতার মান দেশের শীর্ষ ব্র্যান্ডের তুলনায় অনেক ভালো।' ধানমন্ডিতে আসার আগে তিনি তার নিজ শহর ফরিদপুরে কারিগরদের দিয়ে জুতা তৈরি করতেন।
জাকারিয়া একা নন, অনেকেই অর্ডার দিয়ে এভাবে স্থানীয় কারিগরদের হাতে নিজের পছন্দ মতো তৈরি করা জুতা পরতে পছন্দ করেন। আগ্রহীরা চাইলে জুতা অর্ডার করতে পারে এবং নিজের পছন্দ মতো রঙ, আকার ও ডিজাইন বাছাই করতে পারে।
পশ্চিম ধানমন্ডির ঈদগাহ রোডের প্রায় ছয়টি দোকানে জুতা তৈরির অর্ডার নেওয়া হয়। জুতার দোকান মালিকরা জানান, ঢাকায় এমন শতাধিক দোকান রয়েছে। ওয়ারীর জয়কালী মন্দির এলাকায় এবং মিরপুর স্টেডিয়ামের পেছনে কিছু দোকান আছে।
জুতার দাম জুতার মানের উপর নির্ভর করে। সাধারণত, কারিগররা প্রতি জোড়া জুতার জন্য ১০০০ থেকে ৩০০০ টাকা এবং কখনও কখনও আরও বেশি নিয়ে থাকেন।
২০১৯ সালে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জুতার অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার ছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। পাদুকার অভ্যন্তরীণ চাহিদা বছরে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি জোড়া।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে পাদুকা থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২৫.৬৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালে রপ্তানি হয় ১.০২ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে হয় ১.২৮ বিলিয়ন ডলার। তারমধ্যে ৭৯৫.৫৩ মিলিয়ন ডলার এসেছে চামড়ার জুতা রপ্তানি থেকে।
এই বৃদ্ধি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বিশ্বের দুটি শীর্ষস্থানীয় স্পোর্টসওয়্যার জায়ান্ট-যুক্তরাষ্ট্রের নাইকি এবং জার্মানির অ্যাডিডাস- বাংলাদেশে শোরুম খোলার ঘোষণা দিয়েছে।
কিন্তু জাকারিয়ার মতো গ্রাহকরা স্থানীয়ভাবে কারুকাজ করা জুতা পছন্দ করে, আমাদের অর্থনীতিকে প্রসারিত করে, কারিগরদের সহায়তা করে এবং আমাদের সংস্কৃতি রক্ষায় সহায়তা করে। জাকারিয়া বলেন, 'চামড়া আমাদের; কারিগররা আমাদের এবং তারা সেলাইয়েও ভালো। এই জুতাগুলো আমার পায়ে ভালো মানায়।'
একজন হাইকার হিসেবে, জাকারিয়া অনেক রানিং এবং ট্রেকিং জুতা অর্ডার করেন। তিনি স্থানীয় কারিগরদের নিজস্ব ডিজাইন দেন এবং তারা সফলভাবে সেরকম জুতা তৈরি করে দেয়। এই জুতাগুলো অন্যান্য নামিদামি ব্র্যান্ডের জুতার তুলনায় সস্তা এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
তিনি বলেন, উদাহরণস্বরূপ, আমি ব্র্যান্ডের এক জোড়া জুতা কিনেছি ১২ হাজার টাকায়। স্থানীয় দোকানে একই ডিজাইনে এই জুতা বানানো যাবে ৩ হাজার টাকায়। সমস্যা হলো, মানুষ বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয় আর ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকে।
মোহাম্মদ মাজহারুলও ১০ বছর ধরে ধানমন্ডি এলাকায় দোকানগুলোতে অর্ডার করেন। তারজন্য অর্ডার করে জুতা বানানো একরকম বাধ্যতামূলক। কারণ তিনি পোলিওতে আক্রান্ত এবং এটি তার পায়ে প্রভাব ফেলে। তিনি আগে রেডিমেড জুতা পরতেন, কিন্তু এতে তার অস্বস্তি এবং ব্যাথা হয়। এ কারণে, মাজহারুলকে পায়ের জন্য উপযোগী করে জুতা বানানোর পরামর্শ দেন তার চিকিৎসক। যা এখন তার অনেক কাজে দিচ্ছে।
মোহাম্মদ মাজহারুল ও মির্জা জাকারিয়া বেগ আরো অনেকের মতো বাবুল শু স্টোরের নিয়মিত গ্রাহক। এটি ঈদগাহ রোডের সবচেয়ে পুরনো জুতা তৈরির দোকান।
দোকানের বর্তমান মালিক গণেশ রবি দাস জানান, মুক্তিযুদ্ধের পরপর ১৯৭২ সালে এই দোকান চালু হয়। তার মামা দোকানটি চালু করেন এবং ব্যবসা করতেন।
দোকানের দেয়ালে বিভিন্ন ডিজাইনের জুতা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে আছে চেলসি শু থেকে শুরু করে অক্সফোর্ডস, ব্রোক শু, পাম শু, লোফার এবং কাবলি। দোকানের ডিসপ্লেতে থাকা সবচেয়ে বড় মাপের জুতার সাইজ ৪৭। এখানে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কেডস বা কনভার্স তৈরি করেন না। নারীদের বা ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের জুতার অর্ডার নেন না।
গণেশ রবি দাস ব্যাখ্যা করে বলেন, নারীদের জুতা নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। যেমন রং ও ডিজাইন মেলানো কঠিন।
ওয়্যারেন্টি এবং সুবিধা
গ্রাহকরা ১,০০০ টাকার জুতা অর্ডারের জন্য আট মাসের ওয়ারেন্টি, ২,০০০ হাজার টাকার জুতার ক্ষেত্রে এক বছরের ওয়ারেন্টি পাবেন। ওয়্যারেন্টি বেশ কয়েকটি বিষয় কভার করে- যদি সোলের ক্ষতি হয়, বা যদি আঠা বা সেলাই চলে যায় ইত্যাদি। তবে কিছু শর্ত আছে। যেমন- যদি পায়ের পাতা হাঁটতে গিয়ে ক্ষয় হয়ে যায়, তবে কোনও ওয়ারেন্টি নেই।
এসব দোকানের প্রধান গ্রাহক চাকরিজীবী এবং ছাত্ররা। আবার তাদের মধ্যে অনেকে এমন আছেন যারা ব্র্যান্ডের দোকানে নিজেদের সাইজের জুতা খুঁজে পান না।
গ্রাহকরা প্রধানত তিনটি কারণে জুতার অর্ডার দেন। প্রথমত, কিছু গ্রাহক একজোড়া জুতা পছন্দ করেন কিন্তু তারা জুতার রঙ পছন্দ করেন না। এ অবস্থায় ক্রেতারা পছন্দের রং দিয়ে জুতা তৈরি করিয়ে নেন। দ্বিতীয়ত, কিছু গ্রাহক ইন্টারনেট থেকে পাওয়া ডিজাইন নিয়ে আসে, দোকানগুলো সে অনুযায়ী জুতা তৈরি করে। তৃতীয়ত, যাদের পায়ের সাইজের জুতা ব্র্যান্ডের শোরুমে মিলে না। যদিও কিছু শোরুম আছে যেগুলো বড় আকারের জুতা সরবরাহ করে। গ্রাহকরা সাধারণত ডিজাইনগুলো পরতে আরামদায়ক বলে মনে করেন না।
গণেশ রবি দাস বলেন, আমরা তাদের জন্য সঠিক মাপের জুতা তৈরি করি। আমরা ৪৬, ৪৭ বা ৪৮ সাইজের মতো বড় মাপের জুতা তৈরি করতে পারি। বড় সাইজের জুতার দাম তিন হাজার টাকার বেশি বলে জানান এই দোকান মালিক।
একজন ক্রেতার অর্ডার সম্পূর্ণ করতে দোকানে কারিগরদের এক সপ্তাহ সময় লাগে। গণেশের কারখানায়, আটজন কারিগর আছেন যারা জুতার উপরের অংশে কাজ করেন এবং চারজন নীচের অংশ তৈরি করেন।
তিনি বলেন, আমাদের কারিগররা হাতে জুতা তৈরি করে, ফলে সময় লাগে।
জুতার সোল চীন থেকে আমদানি করা হয় এবং চামড়া ঢাকার বিভিন্ন ট্যানার থেকে কেনা হয়। তারা সাধারণত উচ্চ-মানের চামড়া দিয়ে জুতা তৈরি করেন না। এসব দোকানে তৃতীয়-শ্রেণীর চামড়া ব্যবহার করে। এই চামড়ার মানও ভালো এবং এটি বেশি ব্যবহারেও অন্তত এক বছর টেকসই থাকে। উন্নতমানের চামড়া সাধারণত রপ্তানি করা হয় এবং ওইসব চামড়া দিয়ে এক জোড়া জুতা তৈরি করতে খরচ হয় ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।
শহরে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের দোকান থাকতে মানুষ কেন তাদের কাছে আসে, জানতে চাইলে গণেশ রবি দাস বলেন, আমি মনে করি, তারা সন্তোষজনক ডিজাইন খুঁজে পায় না; ফলস্বরূপ তারা আমাদের কাছে একটি ডিজাইন নিয়ে আসে। আমাদের জুতা দীর্ঘদিন টেকে। পরেও স্বাচ্ছন্দ্য। কর্পোরেট চাকরির গ্রাহকরা আমাদের বলেন যে এক জোড়া জুতা অনেক বেশি ব্যবহারের পরেও ছয় মাস স্থায়ী হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে, অর্ডারের সংখ্যা কমেছে; দোকানটি সাধারণত গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি অর্ডার পায়। বিশ বছর আগেও দোকানে জমজমাট ব্যবসা ছিল। বছরের পর বছর ধরে চাহিদা কমে গেলেও, তাদের এখনও একটি বড় ও অনুগত গ্রাহক গ্রুপ আছে।
গণেশ রবি দাস বলেন, যারা আমাদের জুতা পরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তারা এখনও নিয়মিত আমাদের কাছে আসে। আমি বিশ্বাস করি তারা ভবিষ্যতেও আসতে থাকবে।