বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে ঢাকায় ই-টিকেটিং ব্যবস্থা
ইলেকট্রনিক টিকেটের (ই-টিকেট) মাধ্যমে ভাড়া আদায় আধুনিকীকরণ, স্বচ্ছতা বাড়ানোসহ রাজধানী ঢাকার বাস ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে শুরু হওয়া ই-টিকেটিং ব্যবস্থা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ায় এখন বাস কর্মচারী ও যাত্রীদেরও এই ব্যবস্থার উপর অনাগ্রহ জন্মেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস চালক এবং হেলপাররা নতুন এই ব্যবস্থাকে তাদের জন্য অলাভজনক হিসেবে দেখছেন বিধায় এক্ষেত্রে তাদের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। ব্যবস্থাটির সাফল্যের পিছনে এটি অন্যতম বাধা বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
এদিকে বাসের কর্মীরা বলছেন, ভিড়ের সময় পয়েন্ট অফ সেল (পিওএস) মেশিন ব্যবহার করে টিকেট বিক্রি করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়; ফলে এই ব্যবস্থা তাদের জন্য সুবিধাজনক নয়। এমনকি, মেশিনগুলোতে তারা প্রযুক্তিগত ত্রুটির অভিযোগও করেছেন, যা ভাড়া আদায়ে সমস্যা তৈরি করছে।
এছাড়া, যাত্রীরা ই-টিকেট চান না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে কন্ডাক্টররা এই ব্যবস্থার প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছেন।
বৃষ্টি দে নামে এক যাত্রী বলেন, "আমি যেরকম ভাড়া জানি, সে অনুযায়ী টাকা দিই। তাই মাঝে মাঝে টিকেট নেই না।"
তবে জাহাঙ্গীর আলম নামে মিরপুর থেকে আসা আরেক যাত্রী বলেন, আগে যাত্রীদের ই-টিকেট দেওয়া হলেও এখন অনেক বাসের কন্ডাক্টররা টিকেট দিতে চান না।
তিনি আরও বলেন, "আমরা যখন টিকেট চাই, তখন কন্ডাক্টর চুপ থাকে কিংবা বলে যে মেশিন কাজ করছে না বা আজ মেশিন নেই। অনেক সময় টিকেট নিয়ে কন্ডাক্টরদের সাথে যাত্রীদের ঝগড়াও হয়।"
শিকর পরিবহনের কন্ডাক্টর মোঃ রফিক বলেন, "বাসে যখন ভিড় বেশি থাকে, তখন সময় লাগে বলে আমরা পিওএস মেশিন ব্যবহার করতে পারি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীরাও টিকেট নিতে আগ্রহী হন না। তবে কোনো যাত্রী টিকেট চাইলে আমি টিকিট দেই।"
মিডলাইন পরিবহনের কন্ডাক্টর মোঃ রুবেল বলেন, "মাঝেমধ্যে পিওএস মেশিনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়, তাই আমরা টিকেট দিতে পারিনা। এছাড়া, এই মেশিন সব সময় গলায় ঝুলিয়েও রাখা যায় না।"
গত বছরের ১৩ নভেম্বর সিটি বাস সার্ভিসের জন্য চালু করা হয় ই-টিকেট সিস্টেমের। ঢাকা ও এর আশেপাশের শহরতলীতে চলাচলকারী বাসগুলোয় অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে প্রাথমিকভাবে ৩০টি কোম্পানির ১,৬৪৩টি বাসে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়।
পরবর্তীতে, পর্যায়ক্রমে এটি বস্তাবয়ন করা হয়। শহরের মোট ৭৯টি রুটের ৫,৬৫০টি বাসের মধ্যে ৬৫টি রুটে ৪,০০০ বাসে এটি কার্যকর হয়।
বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা পর্বেক্ষণের সময় দেখা যায়, প্রায় সবখানেই টিকেটের মাধ্যমে ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থাটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। পর্যবেক্ষণ করা বাসগুলোর মধ্যে মিডলাইন পরিবহন, তরঙ্গ পরিবহন, রমজান পরিবহন, বিহঙ্গ পরিবহন, বিকাশ পরিবহন ও শিকার পরিবহনে কম টিকেট ইস্যুতে করতে দেখা গেছে।
এছাড়া, অন্যান্য বাস যেমন- স্বাধীন পরিবহন, লাব্বাইক পরিবহন, লাভলী পরিবহন, বিকাশ পরিবহন, আজমেরী পরিবহন, গাজীপুর পরিবহন, ঠিকানা পরিবহন এবং সাভার পরিবহনেও এ সমস্যা দেখা গেছে।
আবার জরিপ করা অনেক বাসেই ছিল না পয়েন্ট অফ সেল (পিওএস) মেশিন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, "ই-টিকেট ব্যবস্থাটি নতুন, তাই এতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা সেগুলো সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করছি।"
"মেশিনটি কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়ে আমরা কন্ডাক্টরদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, কিন্তু তারা এটি ব্যবহারে আগ্রহী নয়। এটি ব্যবহার করে তারা সুবিধা করতে পারছে না বিধায় কর্মীদের মধ্যে মেশিন ব্যবহারে অনাগ্রহ বেড়েছে। মূলত এখানে বেশি টাকা আদায়ের বিষয়টি জড়িত, মেশিন ব্যবহার করলে যা সম্ভব হবে না। এ কারণে এই ব্যবস্থায় আগ্রহ নেই বাস কর্মীদের," যোগ করেন তিনি।
"তবে, আমরা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছি। আমরা নতুন সিস্টেমের ব্যবহার পর্যবেক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি টিম গঠন করেছি," জানান তিনি।
এদিকে কিছু চালক ও হেলপারদের অভিযোগ, যানবাহন মালিকরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক বাস ভাড়া দেন। এ কারণে তাদের ই-টিকেটিং ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি অনাগ্রহ জন্মেছে।
অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে মাহবুবুর রহমান বলেন, "আমাদের কাছে এমন অভিযোগ এসেছে এবং আমরা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি। আমরা পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বসেছি।"
"তাদেরকে সমস্যাগুলো সমাধান করতে এবং চুক্তিভিত্তিক গাড়ি ভাড়া বন্ধ করতে বলা হয়েছে। আমরা তাদের সতর্ক করেছি, ভবিষ্যতে আমরা নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, যাত্রী সার্ভিস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি ই-টিকেটিং সিস্টেমের জন্য পিওএস মেশিন ভাড়া দিচ্ছে। তারা প্রতিটি বাস থেকে প্রতি মেশিনের জন্য প্রতিদিন মোট আয়ের দেড় শতাংশ করে চার্জ নেয়।
যাত্রী সার্ভিস লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট গোলাম ইশফাক বলেন, "আমরা এখানে বিনিয়োগ করেছি, এবং টিকেট পার্টনার হিসেবে বাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। আমরা বিক্রি হওয়া টিকেটের একটি অংশ পাচ্ছি। তাই তারা মেশিন ব্যবহার না করলে আমরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হই। তবে আমরা জানি, হঠাৎই কোনো পরিবর্তন আসে না।"
"ই-টিকেটের ব্যবহার বাড়াতে আমরা সবচেয়ে বেশি পিওএস মেশিন টিকেট ইস্যু করা বাসগুলোকে প্রণোদনা দিচ্ছি। আমরা এ ব্যাপারে বাস হেল্পারদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। আমাদের অপারেশন টিমও বিষয়টি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে," যোগ করেন তিনি।