রপ্তানি বাণিজ্যে মানি লন্ডারিং ঠেকাতে চট্টগ্রাম বন্দরে বসছে নতুন কন্টেইনার স্ক্যানার
রপ্তানি বাণিজ্যে মিথ্যা ঘোষণা, ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি, মানি লন্ডারিং ও রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাতের মতো কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন দুটি রপ্তানি কন্টেইনার স্ক্যানার বসানো হচ্ছে।
২০১৭ সালে মার্কিন কোস্ট গার্ডের একটি প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের আগে স্ক্যানিং করার শর্ত দেওয়ার ৬ বছর পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি (আইএসপিএস কোড)- এর শর্ত অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের সকল গেটে কন্টেইনার স্ক্যানার স্থাপনসহ ১৬টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল মার্কিন প্রতিনিধি দল।
চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার স্ক্যানিং না হওয়ার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র তৈরি পোশাক, খাদ্যসামগ্রী, অ্যাগ্রো ফুডসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। হাজার কোটি টাকা পাচারসহ পণ্য রপ্তানিতে কোটি কোটি টাকার ক্যাশ ইনসেনটিভ আত্মসাৎ করে।
সম্প্রতি কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্তে ২৯টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে আরও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
বন্দরে স্ক্যানার বসানোর দায়িত্ব কাস্টমসের হলেও মার্কিন কোস্ট গার্ডের শর্ত পূরণে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে স্ক্যানার কেনার উদ্যোগ নেয়।
নির্দেশনার ৬ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৯০ কোটি টাকায় চীন থেকে কেনা দুটি স্ক্যানার আসছে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর।
চীনের কন্টেইনার স্ক্যানার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নাকটেক কোম্পানি লিমিটেড থেকে স্ক্যানার দুটি কেনা হচ্ছে। শীঘ্রই এগুলো বন্দরের কাস্টমস মোড় সংলগ্ন ৪ নম্বর গেট ও সিপিএআর গেটে বসানোর প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরে ১২টি গেটের মধ্যে বর্তমানে ৬টি গেটে ৫টি ফিক্সড এবং ২টি মোবাইল স্ক্যানার রয়েছে। নতুন দুটি স্ক্যানারের মধ্যে জিসিবি ৪ নম্বর গেইটে একটি স্থায়ী স্ক্যানার আছে। সেখানে রপ্তানি কন্টেইনার স্ক্যানারও বসানো হচ্ছে। এছাড়া, সিপিএআর গেটে নতুন করে বসছে রপ্তানি কন্টেইনার স্ক্যানার। অর্থাৎ, বন্দরের ১২টি গেইটের মধ্যে ৭টি গেটে সবমিলিয়ে স্ক্যানার সংখ্যা হবে ৯টি।
এরমধ্যে জিসিবি ১ নম্বর গেট এবং এনসিটি ৩ নম্বর গেটে দুটি নতুন স্ক্যানার বসানো হয় ২০২০ সালের ৪ মার্চ। বাকি ৫টি স্ক্যানার মেশিনগুলো বসানো হয় ২০০৯ সালে।
স্ক্যানার বসাতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণের কারণ সম্পর্কে বন্দর ও কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি, টেন্ডার এবং প্রক্রিয়াগত আনুষ্ঠানিকতার কারণে স্ক্যানার বসাতে বিলম্ব হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, "বন্দরে স্ক্যানার বসানোর মূল দায়িত্ব কাস্টমসের। আইএসপিএস কোডের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারি সিদ্ধান্তে বন্দর দুটি রপ্তানি কন্টেইনার স্ক্যানার বসাচ্ছে। আশা করছি আগামী দুই মাসের মধ্যে স্ক্যানার দুটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশনে যাবে বলে।"
গত ২৭ জুলাই সিআইআইডি'র মহাপরিচালক ফখরুল আলম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া এক চিঠিতে রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলেন, রপ্তানির মাধ্যমে সংঘটিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও রপ্তানি প্রণোদনা আত্মসাৎ প্রতিহত করা গেলে ট্রেড বেইজড (বাণিজ্যভিত্তিক) মানি লন্ডারিংয়ের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশই পোশাক পণ্য। এরমধ্যে ২৫ শতাংশের বাজার যুক্তরাষ্ট্র। যেসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পণ্য আমদানি করে সেসব বন্দরে আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে মার্কিন আগ্রহে।
বিজিএমএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, "রপ্তানি কন্টেইনার স্ক্যানার না হওয়ার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির কমার্শিয়াল এক্সপোর্টার রপ্তানি বাণিজ্যে জালিয়াতির আশ্রয় নিতো। আমাদের প্রত্যাশা চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টমস সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জালিয়াতি বন্ধ করবে।"
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এনবিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চট্টগ্রাম বন্দরে ৪টি ও ২টি স্থলবন্দরে ২টিসহ মোট ৬টি স্ক্যানার বসাবে। এ বিষয়ে চীনের নাকটেক কোম্পানি লিমিটেডের সাথে এনবিআরের চুক্তিও হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মুখপাত্র ডেপুটি কমিশনার ব্যারিস্টার মো. বদরুজ্জামান মুনশি বলেন, "আগামী অক্টোবরে নতুন ৪টি স্ক্যানার আসছে। সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন গেটে বসানো হবে।"