ফিলিস্তিনের পক্ষে সব ধরনের বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করল ফ্রান্স
গাজার ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ ও চলমান সংঘাতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষের সব ধরনের বিক্ষোভ-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে ফ্রান্স সরকার। খবর বিবিসির।
দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়ে সবাইকে এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন। একইসাথে এই নিয়ম না মানলে বিদেশী নাগরিকদের 'পরিকল্পিতভাবে' ফ্রান্স ত্যাগ করানো হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলো ব্রাভারম্যানও ব্রিটেনের রাস্তায় ফিলিস্তিনি পতাকা প্রদর্শনের বিষয়ে পুলিশ প্রধানদের একটি সতর্কতা জারি করেছেন। গত মঙ্গলবার ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের প্রধান কনস্টেবলদের উদ্দেশ করে একটি চিঠি দেন তিনি।
বিশ্লেষকদের মতে, চলমান সংঘাতকে কেন্দ্র করে ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ বৃদ্ধির আশঙ্কায় সরকারগুলো এই পদক্ষেপ নিচ্ছে। যদিও গতকাল (বৃহস্পতিবার) ফ্রান্স সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজধানী প্যারিসে বিক্ষোভে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ।
বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে 'ফিলিস্তিনের জয় হবে' ও 'ইসরায়েল হত্যাকারী' ইত্যাদি নানা স্লোগান দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত টিয়ার গ্যাস ছুড়ে ও জলকামান ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় ফ্রান্সের দাঙ্গা পুলিশ। একইসাথে কমপক্ষে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
অন্যদিকে ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ চলমান সংকটে নিজ দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডারমানিন বলেন, "যারা নির্দেশ অমান্য করে বিক্ষোভ করবে, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। কারণ তাদের এমন কাজের ফলে জনশৃঙ্খলা ব্যাহত হতে পারে।"
কিন্তু ফিলিস্তিনপন্থী গোষ্ঠীরা মনে করে যে, ফ্রান্স সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাক-স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। একইসাথে তারা ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থনে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শার্লট ভাটিয়ার নামের এক ফ্রান্স নাগরিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, "আমরা নাগরিকেরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। সকলের বিক্ষোভ করার অধিকার রয়েছে। সেক্ষেত্রে এক পক্ষকে অনুমতি দিয়ে আরেক পক্ষকে নিষিদ্ধ করা খুবই অন্যায্য।"
অন্যদিকে জার্মানির রাজধানী বার্লিনেও প্যালেস্টাইন-পন্থী বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দেশটির ধারণা, এতে করে ইহুদি বিদ্বেষ এবং সহিংসতার সৃষ্টি হতে পারে।
এক ভিডিও বার্তায় ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ হামাসকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একইসাথে গোষ্ঠীটি ইসরায়েলি জনসাধারণের মৃত্যু কামনা করে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
চলমান পরিস্থিতিতে নিজ দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে মাখোঁ বলেন, "আসুন, আন্তর্জাতিক বিভাজনকে কেন্দ্র করে নিজ দেশের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি না করি।"
ইসরায়েলে হামাসের হামলায় প্রায় ১৩ জন ফ্রেঞ্চ নাগরিক নিহতের খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। একইসাথে ১৭ জন ফ্রেঞ্চ নাগরিক নিখোঁজ হয়েছেন; যাদের মধ্যে চারজন শিশু। ধারণা করা হচ্ছে যে, হামাসের নিকট জিম্মিদের মাঝে নিখোঁজ ব্যক্তিরা থাকতে পারে।
মাখোঁ বলেন, "নিখোঁজ নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ফ্রান্স সরকার ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ করছে। এছাড়াও অংশীদারদের পাশাপাশি আমাদের যা যা করা সম্ভব, তার সবই করা হচ্ছে।"
মাখোঁ আরও বলেন, "সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে। কিন্তু বেসামরিকদের জীবন রক্ষা করতে হবে। কেননা এটা গণতন্ত্রের কর্তব্য।"
ফ্রান্সে প্রায় ৫ লাখ ইহুদি লোকের বসবাস; যা একক দেশ হিসেবে ইউরোপে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে ইউরোপে মুসলমানদেরও সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক বাস করে ফ্রান্সে; যা প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি।
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডারমানিন গতকাল (বৃহস্পতিবার) আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, ইহুদি স্কুল ও সিনাগগগুলিকে যাতে পুলিশের উপস্থিতিতে পাহাড়া দেওয়া হয়।
ফ্রেঞ্চ রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডারমানিন জানান, গত শনিবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরুর পর থেকে দেশটিতে প্রায় ১০০ টি ইহুদিবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে গ্রাফিতিতে 'ইহুদিদের মৃত্যু' কিংবা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইন্তিফাদের আহ্বান অন্যতম। এছাড়াও কেউ কেউ স্কুল ও সিনাগগে ছুরি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার কারণেও গ্রেফতার হয়েছেন।
ফ্রেঞ্চ পুলিশের পক্ষ থেকে দেশটির ন্যাশলান অ্যাসেম্বেলির প্রেসিডেন্ট ইয়ায়েল ব্রাউন-পিভেট ও এমপি মায়ার হাবিবের বাসায় গার্ড হিসেবে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারা দুজনেই ইহুদি।
প্রয়োজনে রাজনৈতিক এই দুই নেতার বাড়িতে আরও বেশি নিরাপত্তা জোরদার করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। মূলত মাখোঁর রেনেসা পার্টির সদস্য ব্রাউন-পিভেট হত্যার হুমকিপ্রাপ্ত হওয়ায় এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের ছাপ যেন ফ্রান্সের রাজনীতিতেও পড়েছে। যদিও বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই গত শনিবারের হামাসের আক্রমণকে 'সন্ত্রাসী হামলা' বলে অভিহিত করেছেন। একইসাথে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের পাল্টা হামলাকে যুক্তিসঙ্গত বলে অবস্থান নিয়েছেন।
দেশটির বামপন্থী নেতা জিন-লুক মেলেনচনের রাজনৈতিক দলটি যেন আরও শক্ত ভাষায় বক্তব্য প্রদান করে। দলটির বিবৃতিতে হামাস আক্রমণকে 'ফিলিস্তিনি বাহিনীর একটি সশস্ত্র আক্রমণ' হিসাবে হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এদিকে হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজার ওপর খাদ্য, পানি ও বিদ্যুতের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারমধ্যেই অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে একের পর এক বোমা ফেলছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান।
ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি গতকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ৬ হাজার বোমাবর্ষণের কথা জানিয়েছে। গত ছয়দিনে এসব বোমা ফেলা হয়েছে। এ ধরনের হামলা চলতে থাকলে, অত্যন্ত ঘনবসতির গাজা উপত্যকায় বিপুল প্রাণহানি হবে, এতে হাসপাতালগুলোর মর্গে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গাজায় আল জাজিরার প্রতিবেদক জামিলেহ আবু জানুনা বলেছেন, "আল শিফা হাসপাতালের (গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল) বাইরে আমরা সারি সারি মরদেহ রাখার ভিডিও দেখতে পাচ্ছি। কারণ, ভেতরে আর রাখার জায়গা নেই। মর্গ ভরে ওঠায় দুদিন আগেই তারা হাসপাতালের চত্বরে তাবু খাটিয়ে লাশ রাখা শুরু করেছিল। এটা হৃদয়বিদারক দৃশ্য।"