চট্টগ্রাম বন্দরে ওয়েবার সনদ প্রাপ্তির জটিলতায় বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজ
বাধ্যতামূলক ওয়েবার সনদ প্রাপ্তির জটিলতায় ভুগছে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ও সেখান থেকে ছেড়ে যাওয়া কার্গো বহনকারী বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলো।
ফলস্বরূপ, শিপিং কোম্পানি এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা প্রায়ই তাদের কার্গো না নিয়ে বন্দর ছাড়ছে বা বিলম্বের শিকার হচ্ছে এবং একইসঙ্গে গুনছে জরিমানা।
ফিডার ভেসেল অপারেটররাদের মতে, গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে চলাচলকারী অন্তত পাঁচটি জাহাজ বিলম্বের কারণে কার্গো লোড না করেই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়েছে। মালামাল লোড বা আনলোড না করেই জাহাজগুলোকে বহির্নোঙ্গরে স্থানান্তর করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক ফিডার অপারেটর 'এক্স-প্রেস ফিডারস' জানিয়েছে, চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে চলাচলকারী তাদের জাহাজ এক্সপি ধৌলাগিরি, এসওএল প্রমিজ এবং এক্সপি লোটসে এ সপ্তাহে ওয়েবার সনদ সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই জটিলতায় কন্টেইনার বুকিং দেওয়ার পরেও ফিডার জাহাজগুলোকে কার্গো লোড না করেই বন্দর ছাড়তে হয়েছে।
সি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন এএস চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওয়েবার সার্টিফিকেট সংক্রান্ত জটিলতার কারণে, 'এক্সপি লোটসে'-এর যাত্রার সময়সূচী একদিনের জন্য পিছিয়েছে। ১৪ অক্টোবর প্রায় ১,৫০০ টিইইউএস কন্টেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলম্বোর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল জাহাজটির; এখন প্রায় ১,০৪০ টিইইউএস কন্টেইনার নিয়ে এটি বন্দর ছেড়ে যাবে।"
শুক্রবার এক্স-প্রেস ফিডার জানিয়েছে, তাদের পার্টনার ভেসেল 'এসওএল প্রমিস' গত ১১ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর বার্থে এসে পৌঁছায় এবং পরের দিন কার্গো আনলোডিং সম্পন্ন করে।
এক্স-প্রেস ফিডারের বিবৃতিতে জানানো হয়, 'স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য কার্গো পরিচালনার অনুমতি দেয় এবং ১২ অক্টোবর সকাল ৮টার পরে রপ্তানি কার্গো লোডিং স্থগিত করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে (সিপিএ) অবহিত করে।'
"চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা বিবেচনায় বেঁধে দেওয়া ২৪ ঘণ্টা সময়সীমার মধ্যে এই পরিমাণ কন্টেইনার লোডিং এবং আনলোডিং করা অবাস্তব বলে জানায় এক্স-প্রেস ফিডার। এই সময়ের মধ্যে জাহাজটিতে মাত্র ১১০ টিইইউএস রপ্তানি কার্গো লোড করা সম্ভব হয়েছিল। বাকি প্রায় ৬০০ টিইইউএস বাদ পড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়।
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক জাহাজ অপারেটর স্ট্রেইট ওরিয়েন্ট লাইনস' (এসওএল) এর স্থানীয় এজেন্ট, জিবিএক্স লজিস্টিকসের অপারেশন প্রধান মুনতাসির রুবায়ত টিবিএসকে বলেন, "পতাকা (যান) সুরক্ষা আইনের ভুল ব্যাখ্যায় চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজ পণ্য পরিবহনের সময় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। অলস পড়ে থাকলে প্রতিটি জাহাজকে দৈনিক ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা দিতে হয়।"
কন্টেইনার শিপিং লাইনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯০টি ফিডার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলম্বো, সিঙ্গাপুর, পোর্ট কেলাং, তানজুম পেলেপাস বন্দরের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে চলাচল করে। এরমধ্যে দেশীয় জাহাজ রয়েছে আটটি। কর্ণফুলী গ্রুপের এইচআর লাইন্স লিমিটেড চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর এবং কলম্বো পর্যন্ত দুটি ফিডার ভেসেল পরিচালনা করে।
এদিকে, বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের স্থানীয় এজেন্টরা অভিযোগ করেন, অনেক সময় দেশীয় কোম্পানিগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজগুলোর কন্টেইনার লোড-আনলোডে বাধা দেওয়া হয়ে থাকে; মাদার ভেসেলের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে বাইরের নোঙ্গরখানায় স্থানান্তরিত করা হয় বিদেশি জাহাজ।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন, ২০১৯অনুসারে, জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনকৃত মোট পণ্যের ৫০ ভাগ দেশের পতাকাবাহী জাহাজে বহন করা বাধ্যতামূলক। তবে অভ্যন্তরীণ জাহাজে জায়গা না থাকা সাপেক্ষে বিদেশি শিপিং এজেন্টদের আইনের বিধান অনুযায়ী বাকি পণ্য বহনের জন্য বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র নিতে হবে।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) বিধিমালা-২০২৩ অনুসারে, বিদেশি জাহাজের মালিক বা তাদের প্রতিনিধিদের পণ্য লোড করার আগে বাধ্যতামূলক ওয়েবার সনদের জন্য মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসে অনলাইনে আবেদন করতে হবে।
এদিকে, ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রীকে পাঠানো এক চিঠিতে চট্টগ্রাম বন্দরে ওয়েবার সনদ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে নিয়মের কিছু ধারা সংশোধনে পরামর্শ দিয়েছে।
সংস্থাটির মতে, প্রচলিত নিয়ম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করছে, যা আমদানি ও রপ্তানিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
মার্কেন্টাইল মেরিন অফিসের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, "আইন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ পতাকাবাহী জাহাজের জন্য কার্গো নিশ্চিত হওয়ার পর, বাকিটা দেওয়া হয় বিদেশি জাহাজগুলোকে। মূলত কার্গোর ভলিউম কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, "ওয়েভার সনদ ইস্যুটি নৌ বাণিজ্য দপ্তর (মার্কেন্টাইল মেরিস অফিস)-এর এখতিয়ার। পণ্য লোড না করে বিদেশি জাহাজ বন্দর ত্যাগ করেছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।"
বাংলাদেশ কন্টেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ফিডার ভেসেলগুলো বিজিএমইএ-এর আমদানিকৃত পণ্যের প্রায় ৫৫ শতাংশ এবং রপ্তানিকৃত পণ্যের ৮৫ শতাংশ বহন করে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্যের শিডিউল মিস হলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) মিস হওয়ার আশংকা তৈরি হয়। মাদার ভেসেল মিস করলে ইউরোপ-আমেরিকার গন্তব্যে সঠিক সময় পণ্য পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
তখন রপ্তানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয় বলে জানান পোশাক রপ্তানিকারকরা।