চট্টগ্রাম বন্দর: বহির্নোঙ্গর এলাকায় নিয়মবহির্ভূতভাবে নোঙ্গর করছে লাইটার জাহাজ
লাইটার জাহাজের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের ডেজিগনেটেড অ্যাংকরেজ এরিয়া পতেঙ্গা এবং পারকি সমুদ্র সৈকত এলাকা। এই দুই এলাকার দশটি পয়েন্টে নোঙ্গর করার নিয়ম থাকলেও তা না মেনে লাইটার জাহাজগুলো বন্দরের বহির্নোঙ্গর এলাকায় অবস্থান করে।
অন্যদিকে লাইটার জাহাজে এআইএস (স্বয়ংক্রিয় সনাক্তকরণ সিস্টেম) না থাকায় বহির্নোঙ্গরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো তাৎক্ষণিক লাইটার জাহাজকে সনাক্ত করতে পারে না। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাল্ক ক্যারিয়ার (খোলা পণ্যবাহী) জাহাজগুলোর সাথে ঘটছে দুর্ঘটনা।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর এলাকায় বছরে ১০টির বেশি বাণিজ্যিক জাহাজে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে শিপিং সংশ্লিষ্টরা। এসব সংঘর্ষ রোধে লাইটার জাহাজে এআইএস সংযোজন সহ লাইটার জাহাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে নোঙ্গর নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ করেন তারা।
সমুদ্র বিষয়ক জরিপ সংস্থা ইন্টারপোর্ট মেরিটাইম লিমিটেডের করা এক প্রতিবেদনে বহির্নোঙ্গরে লাইটার জাহাজের অবৈধ পার্কিংয়ের বিষয়ে এসব তথ্য উঠে আসে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজের সাথে লাইটার জাহাজের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বহির্নোঙ্গর এলাকায় লাইটার জাহাজের নিয়মবহির্ভূত পার্কিং।
চট্টগ্রাম বন্দরের ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা-১৯৯২ অনুযায়ী, সাইক্লোন সতর্কতা উঠলেই কেবল নিরাপত্তার জন্য বাংলাবাজার এলাকা থেকে কর্ণফুলী ব্রিজ পর্যন্ত লাইটার জাহাজগুলো স্থানান্তরের কথা। কিন্তু এই এলাকায় শতশত লাইটার জাহাজ নোঙর করে রাখে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মেরিন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর উজানে বাংলাবাজার থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত লাইটার জাহাজ নোঙ্গরের জন্য ৪১টি মুরিং বয়া স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি মুরিং বয়ায় ৭টি লাইটার জাহাজ নোঙ্গর করার নিয়ম রয়েছে। সেই হিসেবে কর্ণফুলী নদীর উজানে ২৪৭টি লাইটার জাহাজ নোঙ্গর করার কথা।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। প্রতিটি মুরিং বয়ায় ১৫ থেকে ২০টি লাইটার জাহাজ নোঙ্গর করে। শুধু তাই নয়, পুরো নদী জুড়ে সেলফ অ্যাংকরিং করে লাইটার জাহাজগুলো। এতে নদীতে যাত্রী পারাপারে নিয়োজিত নৌকা সহ অন্যান্য নৌ যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করেছে লাইটার জাহাজগুলো।
চট্টগ্রাম বন্দর সীমানায় জাহাজ আসার পর জাহাজগুলো থেকে পণ্য খালাস কার্যক্রম শুরু করার জন্য বহির্নোঙ্গরে নিয়ে আসেন দেশীয় পাইলট (ক্যাপ্টেন)। একাধিক ক্যপ্টেন টিবিএসকে নাম প্রকাশ না করে বলেন, বেশিরভাগ লাইটার জাহাজে এআইএস নেই। যার ফলে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো অতিবৃষ্টি, রাত, কুয়াশা এবং প্রবল স্রোতের সময় কাছাকাছি থাকা লাইটার জাহাজগুলোকে সনাক্ত করতে পারেন না। এর ফলে বাণিজ্যিক জাহাজের সাথে ধাক্কা, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ টিবিএসকে বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে বাণিজিক জাহাজ চলাচলের পথে লাইটার জাহাজ পার্কিং করা কোনভাবেই উচিত নয়। লাইটার জাহাজ নোঙ্গরের নির্ধারিত স্থান রয়েছে। যে রুটে সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে সে পথে লাইটার জাহাজ চলাচল যাতে না করে সেটি কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মোঃ আনাম চৌধুরী বলেন, লাইটার জাহাজগুলো যাতে নিরাপদে নোঙ্গর করতে পারে সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা উচিত। বাংলাদেশে প্রতিবছর যেসব স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটা হচ্ছে সেসব জাহাজের এআইএস সিস্টেম কম মূল্যে লাইটার জাহাজগুলোকে সরবরাহ করলে এই সংকট সমাধান করা সম্ভব।
বন্দরের তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলোর প্রায় ৪৫% কনটেইনার জাহাজ, ৪৫% বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১০% ট্যাঙ্কার। প্রায় ৮০% বাল্ক কার্গো লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাইরের নোঙ্গরগুলোয় আনলোড করা হয়, বাকি ২০% আনলোড হয় জেটিতে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, ১০ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করতো দুই হাজারের বেশি। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৫৩-টিতে। অর্থাৎ দশ বছরের ব্যবধানে বাণিজ্যিক জাহাজ এবং লাইটার জাহাজের চলাচল বেড়েছে দ্বিগুণ। জাহাজের ট্রাফিক দ্বিগুণ বাড়লেও আউটার অ্যাংকরেজ এরিয়া কিংবা লাইটার জাহাজের অ্যাংকর এরিয়া বাড়েনি। এর ফলে পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় দিন দিন জটিলতা বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক বলেন, ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাণিজ্যিক জাহাজের পার্শ্বে বিপজ্জনক অবস্থায় কোন লাইটার জাহাজ বা নৌযান থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জাহাজের ক্যাপ্টেনদের জানানো হয়।
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল–ডব্লিওটিসি এবং লাইটার জাহাজ শ্রমিকদের তথ্য অনুযায়ী, বহির্নোঙ্গর থেকে পণ্য নিয়ে কর্ণফুলী নদীর ঘাটে দেশের বিভিন্ন নৌরুটে প্রায় ৩ হাজার লাইটার জাহাজ চলাচল করে। পরিমাণভেদে একটি মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস হয় প্রায় ৩০টি লাইটার জাহাজে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন রুটে আসা যাওয়া করে প্রায় ২০০টি লাইটার জাহাজ। পণ্য বোঝাই, চট্টগ্রাম বন্দরের কর্ণফুলী নদীর উজানে, পতেঙ্গা এলাকা সহ বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করা অবস্থায় থাকে ৮০০ এর বেশি লাইটার জাহাজ।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল বিধিমালা ২০০১ অনুযায়ী, বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল রুট বা কর্ণফুলী চ্যানেলে অভ্যন্তরীণ জাহাজের অবস্থান এবং চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু এরপরও লাইটার জাহাজ, বার্জ এবং অন্যান্য নৌযান চ্যানেলের পার্শ্বে নোঙ্গর করে রাখে। চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষের জারি করা একাধিক সার্কুলারেও কর্ণফুলী নদীর বন্দর চ্যানেলের আশপাশে লাইটার জাহাজ পার্কিং করার বিষয়টি উঠে আসে।
লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, লাইটার জাহাজগুলো সাগর উপকূলে নোঙ্গর করে। এরপরও লাইটার জাহাজ নোঙ্গর করার বিষয়ে কোন ত্রুটি থাকলে সেটি আমরা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসবো।
পোতাশ্রয়ের অভাবে বিপাকে লাইটার জাহাজ শ্রমিকরাও
২০২০ সালের আগে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছাকাছি ১৫ থেকে ১৮ নম্বর ঘাট এলাকায় নোঙ্গর করতো প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ জাহাজ। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজ চলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই স্থান থেকে লাইটার জাহাজের নোঙ্গর সরিয়ে দেয়। সেসব জাহাজগুলো এখন পতেঙ্গা এবং কর্ণফুলী নদীর উজানে নোঙ্গর করে।
লাইটার জাহাজের নাবিকরা জানিয়েছেন, জোয়ারের সময় বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল থাকায় লাইটার জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীতে চলাচল করতে পারে না। ফলে জাহাজ চলাচলের জন্য ভাটার অপেক্ষায় থাকতে হয়। ভাটায় স্রোতের প্রতিকূলে শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ৮ থেকে ৯ মাইল পাড়ি দিতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। এতে জ্বালানি ব্যয় হয় প্রায় ১৫০০ লিটার। আবার একইভাবে ভাটার সময় ফিরতে হয় নোঙ্গর এলাকায়।
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম টিবিএসকে বলেন, লাইটার জাহাজের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোন পোতাশ্রয় নেই। সমুদ্র উত্তাল থাকায় পতেঙ্গা সৈকতে জাহাজ নোঙ্গর করে রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই সময়ে লাইটার জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীর উজানে অবস্থান নেয়। শীতকালে সমুদ্র কিছুটা শান্ত থাকে। ওই সময়ে সবগুলো লাইটার জাহাজ পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় চলে আসে। যেসব লাইটার জাহাজে পণ্য খালাসের শিডিউল থাকে শুধুমাত্র সেই জাহাজগুলো বহির্নোঙ্গরের কাছাকাছি থাকে। মালিকরা লাইটার জাহাজে এআইএস এর ব্যবস্থা করেন না বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "আমরা লাইটার জাহাজের নিরাপদ পোতাশ্রয় চাই। পতেঙ্গায় বঙ্গোপসাগর উপকূলে সাগর উত্তাল থাকায় নোঙ্গর অবস্থায়ও নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের। লাইটার জাহাজ নোঙ্গর এলাকায় ব্রেক ওয়াটার (ঢেউ প্রতিরোধক বাঁধ) নির্মাণ করলে সেখানে সাগর উপকূলে নিরাপদে লাইটার জাহাজ নোঙ্গর করানো সম্ভব হবে।"