চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি: ৯ মাস ধরে নিয়মবহির্ভূতভাবে টোল আদায় করছে সি মেরিটাইম সার্ভিসেস
ইজারা নবায়ন ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের চরপাড়া পন্টুন জেটি থেকে টোল আদায়ের অভিযোগ উঠেছে সি মেরিটাইম সার্ভিসের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর জেটি চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও গত নয় মাস ধরে নিয়মবহির্ভূতভাবে টোল আদায় করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয় সাম্পান থেকে টোল আদায়ের কারণে লাইটার শ্রমিকদের দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
লাইটার জাহাজ শ্রমিকদের বহির্নোঙ্গর থেকে উপকূলে যাতায়াতে নির্মিত চরপাড়া পন্টুন জেটি ঘাট ইজারা দিয়েছিলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০২২ সালে এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হলেও মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ মাস পর ইজারার টাকা ফেরত চাইছে ইজারদার সি মেরিটাইম সার্ভিসেস।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি ইজারা বাতিল করে ভ্যাট, ট্যাক্স সহ ইজারার ১ কোটি ২৯ লাখ ১১ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানায় প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত না জানানোয় তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, জেটি ঘাট ব্যবহার করে নৌযান শ্রমিক, সার্ভেয়ার, কাস্টমস ও বিভিন্ন এজেন্সির কর্মকর্তা, মার্চেন্ট শিপের কর্মকর্তা, শিপিং এজেন্ট প্রতিনিধি, সার্ভেয়ার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং পর্যটক যাতায়াত করে। চট্টগ্রাম বন্দরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুধুমাত্র নৌ যান শ্রমিকদের কাছ থেকে টোল আদায় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
বর্তমানে শুধুমাত্র শ্রমিকদের থেকে ১০ টাকা হারে টোল আদায় বন্ধ রয়েছে। সাম্পান, পণ্য পরিবহন খাতে টোল আদায় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন ইজারার টাকা ফেরত চাওয়া অযৌক্তিক। ২০২৩ সালের ইজারার টাকা প্রদানের জন্য ডিমান্ড নোটিশ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, লাইটার জাহাজ থেকে উপকূলে লাইটার শ্রমিকদের যাতায়াত এবং তাদের নিত্যব্যবহার্য পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গার চরপাড়া এলাকায় একটি জেটি নির্মাণ করে। জেটি পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালে টেন্ডার আহবান করে।
১ কোটি ১০ লাখ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয় চট্টগ্রামের সি মেরিটাইম সার্ভিসেস। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চরপাড়া পন্টুন জেটির পরিচালনার দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে জেটির ইজারা বাবদ প্রতিটি শ্রমিক থেকে ১০ টাকা হারে আদায় করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সাম্পান প্রতি ১০০ টাকা, এবং পণ্য খাতে ওজনের ভিত্তিতে টাকা আদায় করতো প্রতিষ্ঠানটি।
চরপাড়া ঘাট ইজারা দেওয়ার পর থেকে আন্দোলনে নামে লাইটার শ্রমিকরা। ইজারা বাতিলের দাবীতে একাধিকবার সারা দেশে লাইটার জাহাজের চলাচল বন্ধ করে দেয় তারা। এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় কয়েকবার।
সংকট সমাধানে ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি বৈঠক অুনষ্টিত হয়। ওই বৈঠকে সিন্ধান্ত নেওয়া হয় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত লাইটার জাহাজের নৌ শ্রমিকদের কোন টোল ও ফি দিতে হবে না। এরপর থেকে শ্রমিকদের কাছ থেকে টোল নেওয়া বন্ধ রয়েছে। তবে ঠিকাদার সাম্পান থেকে ট্রিপপ্রতি ১০০ টাকা হারে টোল আদায় করছে।
লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে পণ্য নিয়ে প্রায় ৩ হাজার লাইটার জাহাজ চলাচল করে। পতেঙ্গা এবং কর্ণফুলী নদীর উজানে প্রায় ৬০০ জাহাজ নোঙ্গর করা অবস্থায় থাকে। প্রতিটি জাহাজে গড়ে ১২ জন নাবিক হিসেবে প্রায় ৭ হাজার ২০০ শ্রমিক লাইটার জাহাজে অবস্থান করে। লাইটার জাহাজের শ্রমিক ছাড়াও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর, লজিস্টিক খাতের অন্যান্য লোকজন এই ঘাট ব্যবহার করে।
এদিকে লাইটার জাহাজ শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে টোল আদায় বন্ধ থাকলেও সাম্পান থেকে টোল আদায় করছে ঠিকাদার। সাম্পান থেকে টোল নেওয়ার কারণে ভাড়া বাবদ তাদের বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। তারা চরপাড়া ঘাটের ইজারার স্থায়ী বাতিল চান।
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম টিবিএসকে বলেন, "ঘাটের টোল আদায় নিয়ে প্রতিনিয়ত মারধরের শিকার হতো লাইটার শ্রমিকরা। আমাদের আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের কাছ থেকে টোল আদায় বন্ধ রাখলেও সাম্পান থেকে টাকা আদায় করছে। এতে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।"
চরপাড়া ঘাটে যাত্রী পারাপারে নিয়োজিত এক সাম্পান মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "চরপাড়া ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি সাম্পান চলাচল করে। প্রতিটি সাম্পানে সর্বোচ্চ ১২ জন যাত্রী চলাচল করে। একটি সাম্পান তিন থেকে চারটি ট্রিপ দেয়। প্রতি ট্রিপে ১০০ টাকা করে আদায় করে ইজারাদারের লোকজন।"
সী মেরিটাইম সার্ভিসের প্রোপ্রাইটর জয়দেব চন্দ্র রায় টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখনো আমাদের ইজারা বাতিল করেনি। ঘাটে যদি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে সেজন্য আমাদের লোকজন সেখানে দায়িত্ব পালন করে। এখন আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে কোন টাকা গ্রহণ করি না। যেহেতু আমরা ঘাট থেকে টোল তুলতে পারছি না তাই বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা ইজারার টাকা ফেরত চেয়েছি।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোঃ ওমর ফারুক বলেন, চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর টেন্ডার নবায়ন করে ভাড়া পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ইজারাদার ২০২৩ সালের টাকা পরিশোধ করেনি। ২০২৩ সালের ভাড়া পরিশোধের জন্য শীঘ্রই ডিমান্ড নোটিশ পাঠানো হবে। ২০২৩ সালের ১ কোটি ১০ হাজার টাকা পরিশোধ না করলে সী মেরিটাইম সার্ভিসের ইজারা বাতিল করে জেটি ঘাটের দরপত্র আহবান করা হবে।