শুষ্ক মৌসুমের আগেই ধুলা ভোগাচ্ছে নগরবাসীকে, নিয়ন্ত্রণে নেই জোরালো পদক্ষেপ
রাজধানীর বছিলার বাসিন্দা তাজওয়ার হোসেন প্রতিদিনই মোটরসাইকেলে সদরঘাট-গাবতলী সড়ক হয়ে মিরপুর-১ এ অফিস করেন। তবে এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকালে অসহনীয় ধুলার কারণে তাজওয়ার গত এক সপ্তাহ ধরে কাশিসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন।
তাজওয়ার হোসেন বলেন, "গত কয়েকদিনে বৃষ্টি কমে আবহাওয়া শুষ্ক হওয়া শুরু না করতেই গাবতলী এলাকায় ধুলার পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছে। সদরঘাট-গাবতলী রাস্তার অনেকাংশে উন্নয়ন কাজ চলায় এ ভোগান্তি আরও বেড়ে গিয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলাচলের পরে পরিধান করা কাপড় পরের দিন ব্যবহারের সুযোগ থাকে না। মাঝে মাঝে এমন হয় গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হয়।"
তিনি আরও বলেন, "গত কয়েকদিন এমন অসহনীয় ধুলার মধ্য দিয়ে যাতায়াতের কারণে শ্বাসকষ্ট, কাশিসহ নানা জটিলতায় ভুগছি। ডাক্তার এক সপ্তাহ বাসায় বিশ্রাম নিতে বলেছেন এবং ধুলা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকায় চলাচল করতে গেলে ধুলা এড়ানোর সুযোগ কই?"
শুধু বছিলার তাজওয়ার হোসেনই নয়, রাজধানীয় অধিকাংশ এলাকার বাসিন্দাদেরই এ অভিযোগ। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির রাস্তাতে ধুলা দূষণ চরমে পৌঁছেছে।
গত কয়েকদিন রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে ধুলা দূষণের এ চিত্র দেখা যায়। অধিকাংশ এলাকাতেই রাস্তা খোঁড়াখুড়ি করছে ঢাকা ওয়াসা, ডিপিডিসি, বিটিসিএল, সিটি কর্পোরেশন সহ বিভিন্ন সংস্থা। এমনকি কোনও কোনও এলাকার রাস্তা কেটে মেরামত না করে ওভাবেই ফেলে রাখায় সেখানে তৈরী হচ্ছে ধুলা। নির্মাণাধীন এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য আইন থাকলেও সেগুলো মানা হচ্ছে না অধিকাংশ এলাকায়।
বায়ুর মান নিয়ে কাজ করা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) তথ্যানুযায়ী, গত বৃহস্পতিবারও ঢাকা বায়ুমান ১৭০ নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিত শহরের তালিকায় অবস্থান করছিল। বায়ুদূষণে শীর্ষে থাকা ঢাকার সকাল কিংবা রাতেও তেমন স্কোরে পরিবর্তন নেই। ১৫১-২০০ স্কোর নিয়ে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এমনকি ছুটির দিনেও এ স্কোর ২০০ এর বেশি হচ্ছে, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।
এ বছরের পূর্বাভাসে আইকিউএয়ার বলছে, এই স্কোর আরও বাড়বে। আগামী তিন-চার মাসে তাপমাত্রা কমে এলে বাতাসে দূষিত পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
মানছে না হাইকোর্টের নির্দেশনাও
ধুলাদূষণ থেকে ঢাকাবাসীকে বাঁচাতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিন দফা নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট। রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পানি ছিটানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় উপর থেকে পানি ছিটাতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; যাতে রাস্তার পাশের ছোটোখাটো গাছে জমে থাকা ধুলা-ময়লা পরিষ্কার হয়। আর পানির ঘাটতি তৈরি হলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশকে পানি সরবরাহ করতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ নির্দেশনা দিয়েছিলো।
তবে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও ধুলা দূষণ রোধে এসব কার্যক্রম দেখা যায় না।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির অবস্থা কেমন?
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন প্রস্থের প্রায় ৪,২৩৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০% রাস্তা কোনো না কোনো সময় মেরামত করা হচ্ছে। ফলে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ধুলা আসে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক থেকে।
টিবিএস প্রতিবেদক ঢাকা উত্তরের গাবতলী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পিরেরবাগ, কাফরুল, মহাখালী, তেজগাঁও, বাড্ডা, শাহজাদপুর, গুদারাঘাট, গুলশান-১, উত্তরখান, দক্ষিণখান এবং হরিরামপুর সহ বেশ কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে দেখেছেন যে, এসব এলাকার সড়কের একটি বড় অংশ ধুলার আস্তরণে ঢাকা।
মিরপুর পশ্চিম কাফরুলের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "গত একমাস ধরে তালতলা এলাকায় খোঁড়াখুড়ি করছে ঢাকা ওয়াসা। ফলে পুরো এলাকা কাদামাটিতে পরিপূর্ণ এবং বৃষ্টি না থাকলেই ধুলায় মগ্ন হয়ে থাকে এলাকা। এমনকি ভবনের তিনতলাতেও জানালা খোলা রাখা যায় না। খুলে রাখলেই ধুলায় ঢেকে যায় রুম। আর এ ধুলা নিয়ন্ত্রণে কোনও পদক্ষেপও নিচ্ছে না তারা।"
কারওয়ানবাজার এলাকার রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী সুষ্মিতা ধর বলেন, "রাস্তায় বের হলে ধুলায় গোসল হয়ে যেতে হয়। পরিবারের সবারই সর্দি, কাশি লেগে আছে। যেসব এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ চলছে সেসব এলাকায় ধুলার পরিমাণ আরও বেশি। পানি ছিটানোর কথা থাকলেও দেখা যায় না তেমন।"
ধানমন্ডি, শাহবাগ, পুরান ঢাকার কিছু অংশ, লালবাগ, বাবুবাজার, চকবাজার, কদমতলী, গেন্ডারিয়া, গোপীবাগ, যাত্রাবাড়ী, বংশাল, নাজিরাবাজার, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, গ্রিন রোড, মেরাদিয়া, মতিঝিল সহ ঢাকা দক্ষিণ সিটিও একই ভোগান্তির সম্মুখীন। বিশেষ করে শান্তিনগর, আজিমপুর ও নিউমার্কেট বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
লালবাগের বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা রায়হান বলেন, "একদিকে রাস্তা খারাপ আবার ধুলায় পূর্ণ থাকে সারাক্ষণ, যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় বসবাস করি। রাস্তায় ধুলা জমে এমনটাই আকার ধারণ করেছে দূর থেকে দেখলে মনে হবে মাটির রাস্তা। আশপাশের বাড়ির দেয়ালেও ধুলা জমে ভিন্ন রঙ ধারণ করেছে। আমরা এ অবস্থার পরিবর্তন চাই।"
'ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে' তবে সামান্য
ধুলা দূষণ রোধে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কাজ করছে এমনটা বললেও নিজেরাই শিকার করছেন তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। তাদের দাবি, ধুলামুক্ত রাখতে রাস্তাগুলোতে ছিটানোর জন্য যে পরিমাণ পানির দরকার তা পাচ্ছে না ঢাকা ওয়াসা থেকে। সাথে সরকারী, বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে উৎপন্ন হওয়া ধুলা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সেলিম রেজা বলেন, উন্নয়নের স্বার্থেই খোঁড়াখুড়ি করার অনুমতি দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে কেউ যদি পরিবেশ দূষণসহ শর্তগুলো না মানে সেক্ষেত্রে তাদের জরিমানা, জামানত বাজেয়াপ্ত সহ আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
তিনি আরও বলেন, "আমরা ২০টি গাড়ির মাধ্যমে পানি ছিটাই কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। আমরা চেষ্টা করেও অনেক ক্ষেত্রে ধুলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।"
ঢাকা দক্ষিণের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ খায়রুল বাকের বলেন, "ঢাকায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবছর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন নির্মাণকাজ বেশি চলছে। আর এ নির্মাণকাজে ধুলা রোধে অধিকাংশই তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয় না। আমরা চেষ্টা করছি পানি ছিটানোর কিন্তু ওয়াসা থেকে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় সব রাস্তায় ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না।"
তিনি আরও বলেন, ঢাকার রাস্তার পাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো জরুরী। বিভিন্ন দেশের রাস্তার পাশে স্থাপিত এসব ফায়ার হাইড্রেন্ট ধুলা নিয়ন্ত্রণে ও আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (এয়ার ম্যানেজমেন্ট) বেগম শাহানাজ রহমান বলেন, "বায়ূ দূষণ রোধে আমাদের কেন্দ্রীয় একটি কমিটি করা আছে এবং এই কমিটির তত্ত্বাবধানে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্টসহ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়।"
তিনি বলেন, ঢাকার ধুলা দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হওয়াতেই ধুলা উৎপন্ন হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিতালের মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. আরমান হোসেন বলেন, "ধুলার কারণে প্রতিবছর অ্যালার্জি, হাঁপানি সহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগের হার বাড়ছে। ধুলাবালিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।"
"ধুলাবালি ফুসফুস ক্যান্সারের জন্যও দায়ী।"
২০২১ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটাল ২ লাখ ১০ হাজারের ওপর রোগীর চিকিৎসা দেয়; সাত বছর আগে, এই সংখ্যা ছিল ৮৫ হাজার।
সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পলিউশন স্টাডিজের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এবছর এখনও শুষ্ক মৌসুম না আসলেও ২০২২ এর তুলনায় এবছর ঢাকার বায়ূ দূষণ প্রায় ১০% বেশি। বিগত ৭ বছরের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় প্রায় ১৪% বেশি। এবছর বর্ষাকালেও অধিকাংশ দিন ঢাকার বায়ুমান খারাপ ছিল।"
দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "ঢাকায় নির্মাণবিধি না মেনে প্রচুর নির্মাণ কাজ হচ্ছে এবং রাস্তা খোঁড়াখুড়ি অবস্থায় দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে ধুলা দূষণ বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারে অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, "ধুলা দূষণ রোধে আমরা উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যবস্থা দেখছি না পরিবেশ অধিদপ্তরের কিংবা সিটি কর্পোরেশনের। যারা পরিবেশ দূষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখছি না। যদি যথাযথ আইন প্রয়োগ করা হয় তবে ঢাকার ধূলা দূষণ ৩০% কমিয়ে আনা সম্ভব।"