ব্যবহৃত টি-ব্যাগে আবেগের ছাপ
চা পানের পর যে টি-ব্যাগ ফেলে দেওয়া হয় অবহেলায়, সেটিই সাদিত সংগ্রহ করেন। পরিষ্কার করে রোদে শুকান। তারপর মনের মাধুরী মিশিয়ে সেগুলোতে ফুটিয়ে তোলেন চিত্রকর্ম।
সাদিতের রঙ-তুলির আঁচড়ে পরিত্যক্ত টি-ব্যাগগুলো পায় অনন্য মর্যাদা। কখনো কখনো টি-ব্যাগগুলোতে ফুটে ওঠে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মতো চিত্রপট। পরিত্যক্ত টি-ব্যাগে উঠে আসে আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য, লোকজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য। জনগুরুত্বপূর্ণ সমসমায়য়িক বিভিন্ন ঘটনার কথা বলে সাদিতের টি-ব্যাগ-চিত্রকর্ম।
পেইন্টিং বা ড্রয়িংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সাদিতের চিত্রকর্ম দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তুরস্কের কোম্পানি পেলি পেপার ক্যাটালগের প্রচ্ছদ ছবি আঁকেন সাদিত। পেলি পেপার বিশ্বব্যাপী টি-ব্যাগের কাগজ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘দেবী’ সিনেমার পোস্টারের চিত্রকর্ম এঁকেছেন তিনি। কাজ করেছেন ইস্পাহানি মির্জাপুর টি-ব্যাগের। তার টি-ব্যাগ-চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে রূপালী ইন্সুরেন্স কোম্পানির চলতি বছরের ক্যালেন্ডারে।
সাদিতের পুরো নাম সাদিতউজ্জামান। জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন শেষে ফিরে আসেন রাজশাহীতে। শুরু করেন ব্যবসা। পাশাপাশি টি-ব্যাগ চিত্রকর্মে মনোনিবেশ করেছেন। এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় চার শতাধিক টি-ব্যাগে ছবি একেছেন- যার প্রতিটিই শিল্পমোদী মানুষকে বিমোহিত করে।
ফেলে দেওয়া টি-ব্যাগে আঁকাআঁকি করে আত্মিক প্রশান্তির কথা জানলেন সাদিত।
তিনি বলেন, “শিল্পী হওয়ার কথা কখনোই ভাবিনি। শখের বসেই ছবি আঁকি।”
ছবি আঁকার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের টি-ব্যাগ সংগ্রহ করাটাও তার শখের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘‘এতে বিভিন্ন দেশের চায়ের স্বাদের পাশাপাশি ছবিও আঁকা হয়।’’
রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ঝাউতলা মোড় এলাকায় সাদিতের বাড়িতে গেলে মনে হয়- এ যেন এক টি-ব্যাগ-চিত্রশালা। ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের টি-ব্যাগে শোভা পাচ্ছে তার চিত্রকর্ম।
ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল সাদিতের। বাবা ফরহাদউজ্জামান বলেন, “কোনো খেলনাতেই বেশি দিন মন বসতো না সাদিতের। লেখা শেখার আগেই একদিন আমার চশমার ছবি একে দেখালো।”
ছেলের কৃতকর্মে খুশি হয়ে তাকে ড্রইংয়ের সরঞ্জাম কিনে দেন বাবা। সেই থেকে শুরু।
সাদিতের বন্ধু-প্রতিবেশি-পরিচিতজনরা জানান, সাদিতের ছবির বিশেষ গুণ হচ্ছে- সেগুলো ফুটিয়ে তোলা হয় টি-ব্যাগে- যেগুলো ব্যবহারের পর ছুড়ে ফেলা হয়।
সাদিত বলেন, “আম্মু দীর্ঘ ২৬ বছর স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। সেই সুবাদে আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক আমার মা। বাবার অনুপ্রেরণার বাস্তবায়ন হয়েছে মায়ের হাতের ছোঁয়ায়।”
সাদিত মনে করেন, তার শিল্পী বাসনার পুরোটাই বাবা আর মায়ের আদর-ভালবাসার প্রতিচ্ছবি।
তিনি আরও বলেন, ‘‘…তবে টি-ব্যাগে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণাটা পেয়েছি মার্কিন চিত্রশিল্পী রুবি সিলভিয়াসের কাছ থেকে। ফেলে দেওয়া জিনিসগুলোর যত্ন নিলে সেগুলোও সুন্দর কিছু হতে পারে- এই দর্শনটা তাকে দেখে শিখেছি।’’
সাদিতের দাবি, টি-ব্যাগে ছবি আঁকার বিষয়টা তারই প্রথম। ২০১৬ সাল থেকেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি।
সাদিতের ‘টি-ব্যাগ স্টোরিজ’ নামে একটি ফেসবুক পেজও আছে। সেখানে তিনি তার আঁকা ছবি নিয়মিত পোস্ট করেন। আর সেই আঁকা ছবি দেখে রুবি সিলাভিয়াস প্রশংসাও করেছেন।
দিনের শুরুতে, কাজের ফাঁকে, বন্ধুর সাথে আড্ডায় কিংবা একাকী বারান্দায়- চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বিক্ষিপ্ত যে ভাবনাগুলো মাথায় ভর করে- পরিত্যক্ত টি-ব্যাগে সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটান সাদিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন ড. মোস্তফা শরীফ আনোয়ার বলেন, চিত্রকলায় এ ধরনের শিল্পকর্মকে মিশ্রমাধ্যম বলে। টি-ব্যাগে আঁকা সাদিতের ছবিগুলো জীবন ও প্রকৃতিকে ধারণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও চিত্রকলায় সাদিতের কর্মপ্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে।