ঢাকার মধ্যে এক টুকরো সার্কাসের গ্রাম!
কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের চার নং ওয়ার্ডের একটি গ্রাম শিকারীটোলা। নামটি নাকি এসেছিল নবাবের কাছ থেকে। নবাবের নাম যদিও জানা যায়নি, তবে জানা গেল বীরসিংহ নামে এক লোক বাস করতেন তখন এই গ্রামে। স্থানীয়দের মতে, তিনি না-কি সূর্য দেখেই বলে দিতে পারতেন ঘড়িতে কয়টা বাজে। এজন্য বেশ নামডাকও ছিল তার। স্বয়ং নবাবও তাকে সমীহ করতেন। তাকে ছাড়া একচুল নড়তেন না।
'আচ্ছা শিকারি হ্যায়'!
দৈব ক্ষমতার কারণে প্রায়শই বীরসিংহের কাছে নানা সমস্যার কথা বলতেন নবাব। একবার নবাব তাকে ডেকে বললেন, 'নদীতে তো অনেক কুমির। ঘাট থেকে যে কুমির মানুষ ধরে নিয়ে যায়, এর কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?' একথা শুনে বীরসিংহ নবাবকে প্রস্তাব দিলেন তার সঙ্গে নৌকায় চড়ার। কথামতো একদিন নবাবও নৌকায় চড়ে বসলেন, মাঝি চালানো শুরু করলেন নৌকা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর নদীতে পড়লো বড় এক পাক। বীরসিংহ বলে উঠলেন, 'হুজুর এখানেই আছে (কুমির)! আজ এদের ঘায়েল করব। বলুন, কই মারব। নবাব বললেন, 'ডান চোখে মারো'। বীরসিংহ উপর থেকে ছোড়া মারলো আর একদম গিয়ে বিঁধল কুমিরের ডান চোখে। নবাব বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে উঠলেন, 'আচ্ছা শিকারি হ্যায়'! সে-ই থেকে শিকারীটোলা নামের শুরু।
শুধু যে বীরসিংহ একাই, তা নয়। স্থানীয়দের মতে, তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি সবাই শিকার করায় পারদর্শী ছিলেন। যেকোন জিনিস শিকার করতে এই গ্রামবাসীর দক্ষতা ছিল বলে গ্রামের নাম হয়ে যায় শিকারীটোলা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এই বর্ণনাই পাওয়া যায়। মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় থেকে আঁটিবাজার, এরপর ব্রিজ পার হয়ে অটোরিকশাকে শিকারীটোলা বললেই সোজা গিয়ে নামিয়ে দেবে এই গ্রামে।
মোদক সম্প্রদায়ের সবাই এই সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত
তবে এ গ্রাম পরিচিত অন্য এক কারণেও। শিকারীটোলাকে কেউ কেউ বলেন সার্কাস গ্রাম। এক সময় এখানে প্রতিটি ঘর যুক্ত ছিল সার্কাসের সঙ্গে। সে অবশ্য ইংরেজ আমলের কথা। সৈয়দ মুর্তাজা আলীর আত্নজীবনী 'আমাদের কালের কথা' বইতেও সার্কাস প্রসঙ্গে ১৯১৮ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সে আমলের কেউ তো আর বেঁচে নেই এখন। তবে গ্রামের সার্কাস খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে মুরুব্বি এখন বিমল মোদক। বয়স হবে নব্বইয়ের কাছাকাছি, হাঁটেন কুঁজো দিয়ে। তার সঙ্গেই প্রথম কথা হয়।
বিমল মোদক নিজেও জানেন না তার ঠিক কয় পুরুষের বাস এই ভিটায়। তবে বাপ-ঠাকুর্দাদাদের সার্কাস করতে দেখেছেন তিনি। তাদের থেকে নিজেও আয়ত্ত করেছেন এই পেশা। ছেলেদেরও শিখিয়েছেন। যদিও তারা এখন অন্য কাজ করছে। বিমলের জন্ম, বেড়ে ওঠা, উপার্জন, সংসার সবকিছুর সাক্ষী এই গ্রাম। একদম আট বছর বয়স থেকে শরীরে জোর থাকা পর্যন্ত সার্কাসের মাঠেই নিজের সব শক্তি, সময় ব্যয় করেছেন। তার থেকেই জানা যায়, আগে এ এলাকায় মানুষরা নাকি কুস্তি, হাডুডু খেলায় পারদর্শী ছিল। সেখান থেকেই ব্রিটিশ আমলে সার্কাসের শুরু।
বিমল মোদক বলেন, 'একসময় এই গ্রামে ছিল প্রায় সাড়ে তিনশো ঘর। এরমধ্যে মুসলমান ঘর ছিল হাতে গোণা কয়েকটাই। বাকিসব হিন্দু ঘর। পূবের দিকে নদীর ধারে সব হিন্দু। এই হিন্দু পরিবারগুলোও আবার সবাই এক সম্প্রদায়। ধীরে ধীরে এসেছে মুসলিম ঘর।'
ছয়মাস আগে স্ত্রীকে হারিয়েছেন নির্মল মোদক। ছোটো থেকেই সার্কাসের সঙ্গে আছেন। ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়ে এখন অবসর। তাই বয়স হলেও, এখনো খেলাধুলা করেন। ভালোবাসেন বেশি এক চাকার সাইকেল চালাতে। তার দুই ছেলেও সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত।
নির্মল বলেন, 'এই গ্রামে আমরা সবাই মোদক সম্প্রদায়ের। একসময় এ গ্রামে ছিল তিনটি হিন্দু পাড়া- জেলে পাড়া, ঘোষ পাড়া, মোদক পাড়া। ঘোষ বা জেলে সম্প্রদায়ের কেউ সার্কাস করেনা। মোদক সম্প্রদায়ের সবাই এই সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত।'
১৮৮৮ সালে 'গ্র্যান্ড শো অব ওয়াইল্ড এনিমেলস' নামে একটি সার্কাস দল গঠন করেন শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকায় এই দলটি প্রায়ই আসত খেলা দেখাতে। ঢাকার সার্কাস নিয়ে মীজানুর রহমান 'ঢাকা পুরাণ' গ্রন্থে লিখেছেন, 'হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো পঞ্চাশের যুগে ঢাকার বুকে প্রমোদ ভেলায় চেপে এসেছিল মাদ্রাজ তথা ভারতবর্ষ থেকে বিখ্যাত কমলা সার্কাস তাদের বিপুল বহর নিয়ে।.....পল্টনজুড়ে কমলা সার্কাসের বহর আঁট হয়ে ঘাঁটি গাড়ল। যেন বা এক সার্কাস নগর, ছোট ছোট তাঁবুর ঘর, তাতে সার্কাসের খেলোয়াড় ও কর্মী বাহিনীর সংসার। সারিবদ্ধ বড় বড় খাঁচা, পশুরাজ সিংহ, বেড়াল মামা, বাঘ মশাই, মক্ষী-প্রেমী ভালুক, রামসখা বানর-বিরস নয়নে অরণ্য ধ্যানে মগ্ন।'
'সোনার বাংলা', 'মহানগর', 'দি লায়ন সার্কাস' তিন মালিকের বাস এখানে
স্বাধীনতার আগে এ দেশে বেশ কিছু দল প্রায় নিয়মিত সার্কাস প্রদর্শনী করত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—'দি বেবি সার্কাস,' 'দি আজাদ সার্কাস,' 'দি রয়েল পাকিস্তান সার্কাস,' 'দি ইস্ট পাকিস্তান সার্কাস,' 'দি আর এন ডল ড্যান্স সার্কাস,' 'লক্ষ্মীনারায়ণ সার্কাস' ইত্যাদি।
বাংলাদেশে প্রথম সার্কাস দলের নাম 'দি লায়ন সার্কাস'। এছাড়া ছিল দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাস, দি বুলবুল সার্কাস, দি নিউ স্টার সার্কাস, দি ন্যাশনাল সার্কাস, দি রাজমনি সার্কাস, নিউ সবুজ বাংলা সার্কাস, দি সোনার বাংলা সার্কাস।
এই 'সোনার বাংলা'র মালিক নির্মল মোদকের আপন বড় জ্যাঠা বনমালী মোদক। বনমালী বেঁচে নেই, তার ছেলে অনন্ত মোদক জানান, তাদের দলে ছিল আড়াইশো তিনশো জন কর্মী। বিশ বছর আগেও চলছিল মোটামোটি ভালোই। ব্যবসায় ক্ষতি হতে হতে একসময় বিক্রি করে দেন। যে জীব জানোয়াররা ছিল, তারাও মারা যায়। একসময় মালিক ছিলেন, দাপটও ছিল। কিন্তু সে অনুযায়ী নিজেদের গুছিয়ে আনতে পারেননি সেভাবে। তাই বাড়িঘর বা সহায় সম্পত্তিও নেই।
নির্মল বলেন, 'আমার জ্যাঠা উপরে উঠছিল এই সার্কাস দিয়েই। আর নেমেও গেছে এই সার্কাস দিয়েই।' অনন্ত মোদক ছাড়াও মহানগর ও দি লায়ন সার্কাস এর দু মালিকপক্ষের বাস এখানে।
২০২১ সালের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ড্যার্ডের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সার্কাস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশে তালিকাভুক্ত মোট সার্কাস দল রয়েছে ২৫টি। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ হাজারের মতো মানুষের। তবে সমিতিভুক্ত এই ২৫ দল ছাড়াও দেশে শতাধিক দল রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার লোক এখনো এই পেশায় জড়িত। যারা নিজেরা নিজেরা ছোট ছোট দল তৈরি করে দেশজুড়েই ভ্রাম্যমাণ খেলা দেখিয়ে থাকে এখন।
বর্তমানে এ গ্রামে এরকম ছোটো ছোটো দল রয়েছে প্রায় বিশটি। আর সার্কাস খেলা দেখান এমন ঘর আছে দশ থেকে পনেরোটি। এরা সবাই হিন্দু।
মুসলিমদের মধ্যে শুধু একটি ঘরই সার্কাসের সঙ্গে জড়িত পুরো শিকারীটোলা গ্রামে। তারা হলেন মোহাম্মদ জীবনের পরিবার। জীবনের মা (আগে কাজ করতেন), স্ত্রী, ছোটোভাই, বড় ভাই, ছেলে গোটা পরিবারই যুক্ত এ পেশার সাথে। এমনকি তার ছয় বছরের ছেলেও ইতোমধ্যে অনেক কাজেই নিজেকে পোক্ত করেছে। যেখানে গ্রামের অন্যরা নিজেদের সন্তানদের সার্কাসে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠাচ্ছেন, সেখানে জীবন তার ছেলেকে পড়ালেখার পাশাপাশি সার্কাসেও উৎসাহ দিচ্ছেন। পুরো গ্রামে ক্ষুদে শিল্পী সে একাই। এরই মধ্যে হাড়গোড় ভেঙ্গে ফুটবল, ব্যাঙ, বাদুড় হয়ে যাওয়ার মতো মোট পাঁচটি খেলা আয়ত্ত করেছে সে। ছেলের নাম মোহাম্মদ রোমান।
'তিন অক্ষরের নাম লিখতেও অনেক সময় লাগে'
সার্কাসের সঙ্গেই বেশিরভাগ পরিবার যুক্ত থাকায় এখানকার শিক্ষার হার খুব কম বলা চলে। যেহেতু সার্কাস খেলা রপ্ত করতে হয় একদম ছয় সাত বছর বয়স থেকেই, তাই অন্যদিকে আর মনোযোগ দেওয়া হয়না। গ্রামের কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, এখানে মেয়েদের সর্বোচ্চ পড়ালেখা পঞ্চম- ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। অপরদিকে ছেলেদের ততটুকুও হয়না অনেক সময়। গ্রামের এই সার্কাস পরিবারগুলোতে উচ্চশিক্ষা বলতে মাধ্যমিক পর্যন্তই ধরা হয়।
সবুজ চন্দ্র মোদক নিজে একজন সার্কাস খেলোয়াড়। শিখেছেন বাবার কাছ থেকেই। লেখাপড়া কতটুকু করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, 'লেখাপড়া করতে পারিনাই। করব কখন, একবারে ছোটো থেকেই তো সার্কাসের সঙ্গে আছিলাম। নামটুকু লিখতে পারি শুধু। তিন অক্ষরের নাম লিখতেও অনেক সময় লাগে। তবে লেখাপড়া না জানলেও, কাজের সুত্রে অনেক উঁচুতে গেছিলাম। রাষ্ট্রপতির সামনে খেলাও দেখাইসি। কিন্তু তাতে কী হবে, শিল্পীদের একসময় পড়ে যেতে হয়। এই দেখেন প্রবীর মিত্র, আজম খান এরা এত বড় শিল্পী হয়েও শেষ জীবনে সরকারি সহযোগিতা লাগসে।'
লেখাপড়া করেননি বলে আফসোস করেন গ্রামের মুরুব্বি বিমল মোদক। যদি আজ লেখাপড়া জানতেন, তবে সার্কাসের অন্যকিছু করে চলতে পারতেন। অভাবে অনটনে চলতে হতোনা এখন। জায়গা বিক্রি করে দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে হতোনা। কেউ ঠকাতেও পারতো না।
তবে এখনকার বাবা মায়েরা সচেতন। তারা তাদের ছেলেমেয়েকে সার্কাসে না বরং স্কুলে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু দারিদ্রতার ছোবলে সে যাত্রা হয়তো বেশিদূর এগোতে পারবেনা। নিয়ে নিতে হবে সংসারের হাল, নেমে পড়তে হবে কাজের সন্ধানে।
শিক্ষার হার যেমন কম, তেমনি অল্প বয়সেই বিয়ে করে সংসার শুরু করেন এখানকার মানুষ। মেয়েদের তেরো চৌদ্দ আর ছেলেদের সতেরো আঠারো বছর হলেই বিবাহবন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। কণিকা মোদকের বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছরে আর স্বামী পর্বত মোদকের আঠারো বছর। অবশ্য বিয়ে তাদের হয়েছিল না, বরং নিজেরাই বিয়ে করেছিলেন। স্বামী পর্বত মোদক আর তিনি দুজনেই সার্কাস করতেন। সার্কাস থেকেই প্রণয়, এরপর পরিণতি। কণিকা লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর সার্কাসেই কাজ করতেন পুরোদমে। বরিশালের লক্ষণ দাসের দল, মহানগর, সোণার বাংলা তিনটাতেই কাজ করছেন। কণিকার দুই ছেলে। তাদেরও বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন বিশ বছরের মধ্যেই। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত আর ছোটো ছেলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। যদিও তারা সার্কাসে ঢুকেনি।
দেশ ছেড়ে চলে গেছে অনেকে, যাবার স্বপ্ন দেখছে আরও অনেক পরিবার
বিশ ত্রিশ বছর হলো কণিকারদেরও অনেক আত্মীয়স্বজন চলে গেছে ভারতে। তাদের নিজেদেরও ইচ্ছে চলে যাবার। স্বামী পর্বত মোদক জানান, 'এখন এই গ্রামে আছে ৩৬৫ ঘর। যার অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান। দেশভাগের আগে পুরো হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম ছিল এই অঞ্চলটি। এই গ্রামে এত মানুষ ছিল যে গায়ে গায়ে গুঁতো লাগত। গ্রামে একটা মুসলিমও ছিল না। সাড়ে তিনশো ঘর ছিল পাকিস্তানের সময়। সাতচল্লিশের দেশভাগ আর একাত্তরের যুদ্ধ অনেক হিন্দু পরিবারকে বাস্তচ্যুত করেছে। কমপক্ষে একশোটা ঘর হবে।'
এখনও এখানকার অনেক মোদক পরিবার যারা সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত, স্বপ্ন দেখছেন ভারতে চলে যাবার। যেন হিন্দু বলে সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে না হয়। আবার গ্রামে সার্কাসের বাজার ভালো বলে অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন ঢাকা ছেড়ে। না খেতে পেরে জায়গা বিক্রি করে চলেছে অনেক কর্মী।
বিয়েও হয় গ্রামের মধ্যেই…
কণিকার বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দুটোই এখানে। ফলে ভারত এবং এই শিকারীটোলা এ দুটো জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে তার আত্মীয়রা। এই চিত্র শুধু কণিকার নয়, গ্রামের বাকিদেরও।
কণিকা বলেন, 'আমরা এখানে যারা আছি, বেশিরভাগেরই বিয়ে হয় এখানেই। এই গ্রামের বাইরে যাইনা আমরা। কাছেই সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিক আছে, অসুস্থ হলে সেখানেই যাই। দৈনন্দিক বাজার সদাই করি রাস্তা থেকে। আর পূজো আসলে জামাকাপড় কিনতে যান যাই আটিবাজার। এখানে এখনো অনেকেই আছে যারা আজ পর্যন্ত ঢাকায় যায়নি। একটা পরিবারে শুধু একসূত্রেই আত্মীয় না, দেখা যায় বিভিন্ন দিক থেকে আত্মীয় হয়ে যাই।'
গ্রামটি ঠিক কতটুকু জায়গা জুড়ে হবে তার কোনো নির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও, গ্রামবাসীর মতে, এক কিলোমিটারের কিছুটা কম হবে এই গ্রাম। কিন্তু জনসংখ্যা অনেক।
কেরানীগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আতিকুজ্জামান পিন্টু। বর্তমানে কাজ করছেন একটি বেসরকারি প্রজেক্টে এবং পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। তিনি বলেন, 'এখানে একটি পুকুর আছে, পুকুরপাড়ের আশপাশ দিয়ে এক থেকে দেড়শো লোক বাস করে। এই অঞ্চলটি মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েতের জায়গা। খুব ছোটো হলেও ঘনবসতি ব্যাপক। আবার মূল সড়কের সাথে লাগোয়া যে রাস্তা চলে গেছে সেখানে বাস করে আরও দুইশো-তিনশো পরিবার। সব মিলিয়ে শিকারীটোলা গ্রামে আছে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো পরিবার।'
এলাকার মানুষ কুস্তি, হাডুডু খেলায় পারদর্শী ছিল
একসময় নাগদা ভোট অফিস কাউন্সিলর অফিস থেকে এই পর্যন্ত প্রায় আড়াইশো তিনশো হিন্দু বাড়িঘর ছিল। আশির দশকে মুসলিমদের আগমন বাড়তে থাকে। অভাব অনটন, পারিবারিক সমস্যা, দ্বন্দ্ব বিভিন্ন কারণে হিন্দুরা তাদের জায়গা জমি বেঁচে দেওয়ায় এখানে মুসলিমদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। বর্তমানে সার্কাস পরিবার আছে বারো থেকে তেরোটি। বংশ পরম্পরায় খেলার সঙ্গে যুক্ত আছেন ৫০-৬০ জন । বিমল মোদক, পর্বত মোদক, প্রদীপ মোদক, সবুজ চন্দ্র মোদক, অনন্ত মোদক, শ্যামল মোদক, সুমা মোদক, বিপ্লব মোদক-এরা সবাই যুক্ত বর্তমানে সার্কাসের সঙ্গে। অধিকাংশই ছেড়ে দিয়ে এখন বাদাম বিক্রি, সেলুনে চাকরি, অটো চালানোর মতো বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত।
এই গ্রামের মানুষদের কুস্তি বা মল্লযুদ্ধসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শিতা অনেক কাল আগে থেকেই। এর পাশাপাশি নানা ব্যবসাও করতেন তারা। যেমন, ডিব্বা কেটে কুপি বানাতো তারা। এছাড়া দই, মিষ্টি, কদমা এসব তৈরি হতো এই গ্রামে। হিন্দুদের মধ্যে যারা মিষ্টি বানায় তাদেরই মোদক বলা হয়।
শিকারীটোলা গ্রামের একমাত্র মুসলিম সার্কাস খেলোয়াড় মোহাম্মদ জীবনের মা লুলি বেগমও একসময় দাপিয়ে খেলতেন সার্কাসের মাঠে। নিজেও সন্তানরা বড় হওয়া পর্যন্ত কাজ করেছেন সার্কাসে। তার বাবা, স্বামী, শ্বশুর, কাকা, ভগ্নিপতি সবাই যুক্ত ছিলেন সার্কাসের সঙ্গে। বাবা এবং শ্বশুরের নিজস্ব দল ছিল। দলগুলোতে দুইশো-আড়াইশো কর্মী থাকত। লুলি নিজেও বাবার দলে কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। একসময় অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। তবে নিজেদের ভাগ্য গুছিয়ে আনতে পারেননি সেভাবে।
লুলি বলেন, 'বেতন তো ভালোই পাইতাম। দশ পাই থেকে বাড়তে বাড়তে তিন হাজার টাকাও পাইসি আমি একা। কিন্তু টাকাকে টাকা মনে করেনি কখনো। খালি ভাবসি পোলা মাইয়ারা কোন ভালো জিনিসটা আইন্যা খাওয়ামু।'
ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেননি কখনো
বর্তমানে থাকেন দুটি রুমের একটি পাকা বাসায়। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এ বাসাতেই ভাড়া রয়েছেন মা লুলিকে নিয়ে মোহাম্মদ জীবন। সাথে থাকে ভাই, স্ত্রী, সন্তান। গ্রামের অন্যান্যদের তুলনায় তাদের অবস্থান একটু ভালো। পাকা দালানে থাকেন। তবু লুলি বলেন, 'যদি ভবিষ্যত ভেবে টাকা সঞ্চয় করতাম, তবে এতদিন যে ভাড়া দিয়ে আছি তাতে চার-পাঁচটা বাড়ি বানাতে পারতাম।'
কণিকা, লুলি বেগমের মতো এ গ্রামের মেয়েরা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেরাও সার্কাস খেলেছেন একসময়। তারা আজ বিয়ে করে সংসার করছেন এখানেই। অনেকের ছেলেমেয়েও বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনির মুখ দেখেছেন। কিন্তু সংখ্যাটা এখন কমেছে। আগে যদি পঞ্চাশ জন মেয়ে করতো, এখন সে সংখ্যা নেমে এসেছে সাত আটে। এদের মধ্যে একজন হলেন জীবনের স্ত্রী তাসলিমা আখতার।
পাকসেনার হাত থেকে বেঁচেছিলেন যেভাবে
সিরাজগঞ্জ বাদে, এই গ্রাম থেকেই দেশের সার্কাস খেলোয়াড়দের উৎপত্তি-এমনটাই দাবি এ গ্রামের বাসিন্দাদের। কারণ এ গ্রামে মোদক সম্প্রদায়ের পুরোনো পেশা সার্কাসই। তবে এর বাইরে তারা মণ্ডা মিঠাই বানাত, মাছ শিকার করত। আর মুসলিমদের মধ্যে অনেকেরই মোমের ব্যবসা ছিল। গ্রামের ভেতরেই প্রায় দশটা মোমের কারখানা ছিল। ফলে মুসলমানদের অবস্থা একটু উন্নত। তাদের মধ্যে লেখাপড়ার হারও বেশি।
পেশা এবং পূর্বপুরুষ আলাদা হলেও হিন্দু-মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিলও আছে অনেক। নির্মল মোদক বলেন, 'একাত্তরের যুদ্ধ তো আমি দেখেছি, আমাদের চেয়ারম্যান সুলতান সাহেব ছিলেন মুসলমান। তারাই এই গ্রামকে রক্ষা করেছিল পাকসেনার কাছ থেকে। পাকসেনা খোঁজ নিতে আসলে, বলতেন "এরা বড়ই গরীব, এদের আমি এখানে থাকতে দিসি। মাছ টাছ ধরে খায়। এদের মেরে আর কী হবে।" এভাবেই আমাদের দেখে রেখেছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব।'
একাত্তরের যুদ্ধে সামনে থেকে যুদ্ধ করেছেন বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে থাকা বিমল মোদকও। বিমল নিজে মোহাম্মদপুরে ক্যাম্পে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, 'দেশ ছেড়ে তো ভারতে চলেই গেছে অনেকে। কিন্তু যারা যুদ্ধ করেছেন কেউ নেই আর। এই গ্রামের কেউ কোনো খেতাবও পায়নাই।'
কেউ জুতা পায়ে দিয়ে যেতে পারত না!
সন্ধ্যে নামলেই এ গ্রাম থেকে ভেসে আসত গান। কেউ একজন গান ধরলেই সবাই মিলে সে গানে সুর মেলাতেন। আড্ডায় জমে উঠতো পুরো পাড়া। ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে রাত জেগে করতেন উৎসব-উল্লাস। উঠোনের এক কোণে সে দৃশ্য বসে বসে উপভোগ করতেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। পূর্ণিমা রাতে চাদের আলোয় যে আসরে বসতেন সবাই, সে আড্ডার রেশ ধরে কাটিয়ে দিতেন রাত।
তখন অভাব অনটনের চিন্তাও তেমন ছিল না। যদিও মালিকপক্ষ অনেক সময় দু তিন মাসের বেতন একসাথে দিতেন, কিন্তু সার্কাসের বাজার জমজমাট ছিল। ফলে আয় উপার্জনও ছিল। তাই তাদেরও আনন্দ- উৎসব করেই কেটে যেতো দিন। জৌলুশে ভরপুর ছিলো পুরো গ্রামের দৃশ্যপট।
এখনও কিন্তু পুরোপুরি মলিন হয়ে যায়নি। সকাল-সন্ধ্যা বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। কারো অনুষ্ঠানে সবার উপস্থিতি যেন বাধ্যতামূলক।
একসময় গ্রামের সব মানুষরা মেনে চলতেন কিছু রীতি-রেওয়াজও! সবার মধ্যেই ছিলো একে অপরের প্রতি সমীহ করার ধারা। কেউ জুতা পায়ে দিয়ে যেতে পারত না। আবার মাথা ওপর ছাতি খুলেও কেউ হেঁটে যেত না এই গ্রামের ভিতর। এছাড়া উঁচু স্বরে কেউ কথা বলতো না।
এখন এসব মানা হয় না আর। গ্রামে ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন লোক। আগে ছিল এটা হিন্দুদের গ্রাম, এখন এখানে হিন্দু মুসলমানের সমান উপস্থিতি। কমে গেছে সার্কাস খেলোয়াড়ও। তবু মলিন হয়ে যায়নি এই জৌলুশ। এখনো তারা একে অপরের খোঁজ রাখেন। গ্রামে কারও বিয়ে হলে এখনো উৎসব করেন সবাই মিলে। বর-কন কে রিকশায় বসিয়ে নিজেরা পেছনপেছন পুরো গ্রামে নেচে বেড়ান।
পূজো এলে, চাঁদা তুলে গ্রামে করা হয় লাইটিং, আয়োজন থাকে গান বাজনার। কালীপূজো লক্ষ্মীপূজোতেও মঞ্চ করে নাচ-গানের আয়োজন করেন। সেই আয়োজন চলে কয়েকদিন। জন্মাষ্টমী বা রথ মেলা হলে সবাই মিলে দলবেঁধে যান তাঁতিবাজারে। কারও বাড়িতে বাচ্চা হলে, ছয়দিন পর কীর্তন করেন সবাই মিলে।
সকাল-দুপুর সারাদিন কিছুটা শান্ত শিষ্ট থাকলেও, সন্ধার পর যেন প্রাণ ফিরে পায় নদীর ধারের এই গ্রামটি। যেন লোকজনের মিছিল বের হয়। আশপাশের গ্রামের লোকজন বেড়াতে আসে। লোকজন চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে বেরোয়। সবমিলিয়ে এখনো উৎসবমুখর রেশ রয়ে গেছে এক সময়ের সার্কাস গ্রাম নামে পরিচিত শিকারীটোলায়।