‘ভয় পাচ্ছিলাম ব্রেট লির বল খেলতে পারব কিনা’
আগের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। পরের ম্যাচেই প্রতিপক্ষ অদম্য অস্ট্রেলিয়া। যে দলে খেলেন বিশ্বের অন্যতম গতিসম্পন্ন বোলার ব্রেট লি। শাহরিয়ার নাফিসের মনে ভয় জাগে, 'ব্রেট লির বল খেলতে পারব তো?' নিজের কাছেই প্রশ্ন করেন বাংলাদেশের বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান, 'বল দেখা যাবে তো?'
ম্যাচের দিন সকালে ওয়ার্ম আপ। গা গরমের এই পর্বে অস্থির শাহরিয়ার নাফিস। এদিক-সেদিক পায়চারি করছিলেন বাঁহাতি এই ওপেনার। চিন্তায় ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছিল তার। ব্রেট লি'কে কীভাবে মোকাবিলা করবেন, এটা ভেবে দিশা পাচ্ছিলেন না নাফিস।
যদিও মাঠে নেমে প্রথম বল খেলার পরই এই ভয় কেটে যায় নাফিসের। বাংলাদেশের ১০ উইকেটে হারার ম্যাচে ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি, গ্লেন ম্যাকগ্রাদের বোলিংয়ের বিপক্ষে ৪৭ রানের একটি ইনিংসও খেলেন তিনি। ম্যানচেষ্টারে ২০০৫ সালের ২৫ জুন অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচটি নিজের জন্য কত বড় পরীক্ষা ছিল, সেই গল্প শুনিয়েছেন নাফিস।
শাহরিয়ার নাফিস: বাংলাদেশ জাতীয় দলের পক্ষে আমার অভিষেক হয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নটিংহ্যামে। ওই ম্যাচটিতে খুব একটা ভালো করতে পারিনি, মাত্র ১০ রান করেছিলাম। আমরা বড় ব্যবধানে ম্যাচটি হেরে যাই। পরের ম্যাচ খেলার জন্য চলে যাই ম্যানচেস্টারে। আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া।
হোটেলে চেকিং করার পর আমাদের কোচ ডেভ হোয়াটমোর প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মিটিং করে আমরা কীভাবে খেলব, আমাদের কৌশল কী হবে, এসব নিয়ে। কোচ আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিলেন, "তুমি প্রথম ম্যাচ ভালো করতে পারোনি, কোনো সমস্যা নেই। সামনে আমাদের তিনটি ম্যাচ আছে। সেগুলো তুমি ফ্রি হয়ে খেলো। বাদ পড়ার কোনো চিন্তা করবে না। আমরা তোমার উপর বিশ্বাস রাখছি। তুমি শুধু খেলে যাও।"
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা। আমরা এর আগের ম্যাচেই ওদের হারিয়েছি। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়া তাঁতিয়ে ছিল। আমরা অনুশীলন করলাম আগের দিন। ম্যাচের দিন সকালে ওয়ার্মআপ করলাম। ওয়ার্মআপের সময় যেটা হয়েছিল, আমি চিন্তায় প্রচণ্ড হাঁটাহাঁটি করছিলাম। আমার ভেতরটা খালি হয়ে আসছিল। কীভাবে খেলব এ রকম দলের বিপক্ষে। আবার শেষ ম্যাচ ভালো খেলেনি। প্রচন্ড নার্ভাস ছিলাম।
প্যাড পরলাম। আমার মনে আছে আমি সকালে কিছু খেতে পারিনি। গ্লেন ম্যাকগ্রা, ব্রেট লি, জেসন গিলেস্পি; কীভাবে খেলব এই বোলিং অ্যাটাকের বিপক্ষে। নার্ভাসনেস নিয়ে আমি আর জাভেদ ভাই প্রস্তুত হলাম।
প্রথম বল খেলি না দ্বিতীয় বল খেলি সেটা ব্যাপার না। আমি আমার পার্টনারকে আগে যেতে দেই। উনি এগিয়ে গেলেন। আমি উনার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। আমার পুরো ভেতরটা একদম খালি হয়ে যাচ্ছিল। এতো ভয়, এতো নার্ভাসনেস আগে আমি অন্য কোনো ম্যাচে পাইনি।
ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড মাঠ, কানায় কানায় বাংলাদেশের দর্শকে পূর্ণ। ইংল্যান্ডে খেলার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ডে ,যায় বাংলাদেশের সমর্থকদের দিয়ে মাঠ ভরে যায়। তারা প্রচন্ড উল্লাস করছিলেন।
ওই মাঠের ড্রেসিংরুম এমন ছিল যে, আপনাকে দর্শকদের মাঝ দিয়ে হেঁটে মাঠে নামা লাগবে। আমি যখন মাঠে নামা শুরু করলাম, তখন বাংলাদেশের দর্শকদের আনন্দ, চিৎকার দেখে আমার ভয় সব দূর হয়ে গেল।
জাভেদ ভাই প্রথম বল খেললেন, পরে আমি গার্ড নিলাম। প্রথম বল মোকাবিলা করতে যাচ্ছি ব্রেট লির। টিভিতে আগে খেলা দেখিছি। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার। সব বল ঘণ্টায় ৯০ মাইলের বেশি করে। এর আগে এতো জোরে বল খেলার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। ভয় পাচ্ছিলাম খেলতে পারব কিনা। বল আসলে দেখা যাবে কি না। এতো জোরে বল তো এর আগে কখনও খেলিনি।
প্রথম বল খেলার পর বোলারের দিকে না তাকিয়ে, বল কোথায় গেছে সেদিকে না তাকিয়ে বড় স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। দেখি বলের গতি ওই ৯০/মাইল। তখন বুঝতে পারলাম বল তো দেখতে পারছি, খেলতে পারছি। ইনশা আল্লাহ খেলতে পারব। এরপর থেকে ভয় দূর হয়ে গেল। পরের বল শর্ট ছিল। হাল্কা গ্লাইড করে থার্ড ম্যানে পাঠিয়ে এক রান নিলাম। রানের খাতা খুললাম। এভাবেই আমার ইনিংসটি শুরু হয়।
ব্রেট লিকে শেষ করার পর ম্যাকগ্রার ওভার আাসে। একদম ছোটবেলা থেকে ম্যাকগ্রার বোলিং দেখেছি। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ পেসার। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা পেসার। হয়তো গতি ব্রেট লির মতো ছিল না। কিন্তু একদম অ্যাকুরেট বোলার। তাকেও সাহস করে খেলে ফেললাম। একটা বল খেললাম, দুটি বল খেললাম। একটি সিঙ্গেল নিলাম। এভাবে আস্তে আস্তে কিছুটা আত্মবিশ্বাস তৈরি করলাম।
ওই সময় আমাদের দুটি উইকেট পড়ে গিয়েছে। আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। দুই উইকেট পড়ে যাওয়ার পর এলো আশরাফুল। আমরা ছোটবেলায় ওয়াহিদ স্যারের কাছে একসঙ্গে কোচিং করেছি। আমাদের মধ্যে একটা ভালো বোঝাপড়া ছিল। দুজন দুজনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। এর আগের ম্যাচে আশরাফুল ৯৪ রান করেছিল ৫২ বলে। তার আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ১০০। আত্মবিশ্বাস ভরা। ও আমাকে নিশ্চয়তা দেয় যে খেলে যা। এভাবে এক রান, দুই রান করে ইনিংসটি এগিয়ে যেতে থাকে।
সুনির্দিষ্ট করে যে ওভারটির কথা মনে থাকবে, সেটা হলো গ্লেন ম্যাকগ্রার এক ওভারে আমি ১০ রান নিয়েছিলাম। প্রথমে একটি চার মেরেছিলাম ফ্লিক করে। স্কয়ার লেগ দিয়ে চার হয়েছিল। পরের বলটি গ্লান্স করেছিলাম ফাইন লেগ দিয়ে চার হয়েছিল। ওই ওভারে আরেকটি গ্লান্স করে ফাইন লেগে পাঠিয়ে ২ রান নিই। ১০ রান নেওয়ায় ওই ওভারটি সারাজীবন মনে থাকবে।
ব্রেট লিকে হ্যান্ডেল করার পর, ম্যাকগ্রাকে হ্যান্ডেল করার পর গিলেস্পি আসে। ওর গতি ম্যাকগ্রার চেয়ে বেশি কিন্তু ব্রেট লির মতো না। তখন কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলাম। প্রথম বলেই মনে হয় থার্ড ম্যান অঞ্চল দিয়ে চার মারি। এভাবেই খেলতে খেলতে ওই ম্যাচের সেরা শটটা পেয়ে যাই। একটা কভার ড্রাইভ করেছিলাম গিলেস্পিকে। দারুণ শটে চার হয়েছিল। ম্যাচে সেটা ছিল আমার ব্যক্তিগত পছন্দের ও সেরা শট।
এভাবে একরান, দুই রান করতে করতে ইনিংস বড় করি। শেন ওয়াটসনও বোলিংয়ে আসে। ও খুব আক্রমণাত্মক বোলার ছিল। বাউন্সার দিচ্ছিল। সেগুলি ছেড়ে দিচ্ছি। ওকেও একটা ফ্লিক করে চার মারি। এভাবে আমার আর আশরাফুলের ইনিংসটি বড় হতে থাকে।
এরপর এলো ব্র্যাড হগ। ওর প্রথম বল ডিফেন্স করে মিস করেছিলাম। পরের বলে ব্যাটের কানায় লেগে চার হয়ে গিয়েছিল। এভাবে আরও এক রান, দুই রান নিলাম। এভাবে খেলে যেতে যেতেই দলের অবস্থান এবং আমার ব্যক্তিগত রান একটা ভালো জায়গায় চলে এসেছিল।
অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস এলো। মনে হলো এতো ভালো ভালো বোলার খেলেছি। ওকে কেন খেলবে পারব না। একটি সিঙ্গেল নিলাম। ততক্ষণে আমার রান ৪৭ এ পৌঁছে গেছে। ৫৬ বলে ৪৭ রান। এরকম একটি পজিশনে থেকে মনে হলো, এখন একটু হাত খুলে খেলা যায়। ওইটাই আসলে আমার কাল হয়ে দাঁড়াল।
বল না দেখে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বল অফ স্টাম্পে এলে সুইপ করব। ওভাবেই পজিশন নিয়ে গিয়েছিলাম। সাইমন্ডস খুব লেট বল ছাড়ে এবং পেস ও অফস্পিন দুটিই করত পারে। যে বলে আউট হই সেটা একবারে লেট ছেড়েছিল, আবার ইয়র্কার ছিল। আমি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে সুইপ খেলতে যাব। আমি বল মিস করি। বল অফ স্টাম্পে আঘাত করে। ৪৭ রানে আমি আউট হই।
আশরাফুলের সাথে আমার ৯০ রানের জুটি। বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে ছিল। আমাদের রান রেট ভালো ছিল। ওই আউটের পর সিদ্ধান্ত নিই কখনও আর আগে চিন্তা করে কোনো শট খেলব না। এবং যদি কোনো দিন এ রকম ৫০ বা মাইলফলকের কাছাকাছি আসি তাহলে আরেকটু সাবধানী হয়ে খেলব। পরের ম্যাচটি আবার অস্ট্রেলিয়ার সাথে। ওই ম্যাচে কিন্তু পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলতে পেরেছিলাম।