হারছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী - উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থনও হারাবে?
মিয়ানমারের জনপ্রিয় পার্বত্য শহর পাইন ও লুইনের প্রধান চত্বরে মঙ্গলবার কয়েকশ লোক জড়ো হয়েছিল। তারা ভিড় করে চশমা পরা এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর চমকপ্রদ বক্তৃতা শুনছিলেন।
ওই বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেন, দেশের সামরিক শাসক মিন অং হ্লাইংয়ের পদত্যাগ করা উচিত এবং তার ডেপুটি জেনারেল সো উইনের দায়িত্ব নেওয়া উচিত।
অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন অং হ্লাইং।
একটি বিপর্যয়কর গৃহযুদ্ধ উসকে দেওয়ার দায়ে অং হ্লাইং প্রচুর বৈশ্বিক নিন্দার মুখোমুখি হয়েছেন এবং মিয়ানমারের বেশিরভাগ জনগণ এখন তাকে ঘৃণা করে।
যদিও এই সমালোচনা অস্বাভাবিক। কারণ ভিক্ষু পাও কো তাও বৌদ্ধদের একটি অতি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর অংশ, যারা এখন পর্যন্ত কট্টর সামরিক জান্তার পেছনে আছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে জাতিগত বিদ্রোহীদের হাতে সেনাবাহিনীর একের পর এক শোচনীয় পরাজয়ের কারণে, মিন অং হ্লাইংয়ের এক সময়ের কট্টর এই সমর্থকরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কট্টর সমর্থকদের হারানো
পাও কো তাও জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, 'সো উইনের মুখের দিকে তাকান। এটা একটা সত্যিকারের সৈনিকের মুখ। মিন অং হ্লাইং (পরিস্থিতি) সামলাতে পারছেন না। তাঁর অবসরে যাওয়া উচিত।'
সশস্ত্র বাহিনীতে পাও কো তাওয়ের কী ধরনের সমর্থন রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তার মন্তব্য অন্যান্য জান্তা সমর্থকদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি।
পাও কো তাও বিবিসি বার্মিজকে সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তবে পাইন ও লুইনে তার দেওয়া বক্তৃতা তাৎপর্যপূর্ণ।
এক সময়ের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক হিল-স্টেশন এখন প্রতিরক্ষা পরিষেবা একাডেমির ঘাঁটি, যেখানে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ঐক্য নতুন কিছু নয়।
১৯৩০-এর দশকের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পর্যন্ত বার্মিজ ভিক্ষুদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে।
অনেকে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেন, এমনকি কেউ কেউ জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেন।
আবার অনেকে জেনারেলদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তারা মনে করেন, বৌদ্ধ ধর্ম ও বার্মিজ সংস্কৃতিকে বাইরের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে।
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের পর উইরাথু নামের এক ভিক্ষুর সহায়তায় 'মা বা থা' নামের এক আন্দোলন শুরু করেন। উল্লেখ্য মা বা থা অর্থ হচ্ছে- ধর্ম ও বর্ণ সুরক্ষা সমিতি। তারা মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা বয়কটকে উৎসাহিত করেছিল। তাদের দাবি ছিল, বার্মায় বৌদ্ধধর্ম মুসলমানদের হাতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ মুসলমানরা মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ।
আন্দোলনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সালে ভেঙে দেওয়া হয়, তবে তারা এখনও সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট।
এর আগে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেওয়ার দায়ে কারাগারে যাওয়া উইরাথুকে ২০২০ সালে ফের কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সামরিক বাহিনী তাকে মুক্তি দেয় এবং মিন অং হ্লাইং তাকে সম্মাননা ও নগদ অর্থ প্রদান করেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিন অং হ্লাইংয়ের অভ্যুত্থান জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দেশের আপামর জনগণ গণতান্ত্রিক সরকারকে ফিরে পাওয়ার দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ করে, জান্তা বাহিনী যা নির্মমভাবে দমন করে।
৬৭ বছর বয়সী এই জেনারেল তখন থেকে নিজেকে বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী হিসেবে উপস্থাপন করে তার বৈধতা জোরদার করার চেষ্টা করেছেন।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম একের পর এক এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেগুলোতে উপস্থাপিত হচ্ছে জান্তা বাহিনীর প্রধান প্যাগোডাগুলোতে উপহার দিচ্ছেন এবং মঠের জ্যেষ্ঠ মোহান্তদের শেষকৃত্যে নিয়মিত উপস্থিত থাকছেন।
সামরিক প্রশাসনের অর্থায়নে, রাজধানী নেইপিদোতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতেও দেখা গেছে তাঁকে।
মিয়ানমারের শীর্ষ ধর্মীয় সংস্থা- বৌদ্ধ পরিষদ বা রাষ্ট্রীয় সংঘ এই অভ্যুত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে খুব কমই কথা বলেছে। এর কিছু সদস্য নীরবে জেনারেলদের সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
তবে সংঘের একজন জ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী সিতাগু সায়াদাও প্রকাশ্যে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দিয়েছেন এবং এমনকি মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে রাশিয়ায় অস্ত্র কেনার সফরেও গিয়েছিলেন।
অন্য সন্ন্যাসীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। উইরাথুর একজন অনুসারী- ওয়াথাওয়া তার নিজ রাজ্য সাগাইংয়ে সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ গঠনে সহায়তা- করছেন যারা জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত স্বেচ্ছাসেবক পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসকে দমনে সহায়তা করছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, গেরুয়া পোশাক পরা সন্ন্যাসীরা রাইফেল কীভাবে চালাতে হয় তা শিখছেন।
পৌরাণিক বার্মিজ রাজার নামানুসারে গঠিত 'পিউসাওতি' মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুরুষদের জোরপূর্বক দলে নেওয়া এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে একাধিক নৃশংসতার অভিযোগ রয়েছে।
২০২২ সালের শুরু থেকে ওয়াথাওয়া যে এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, সেখানকার এক বাসিন্দা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তিনি প্রতিটি গ্রাম থেকে মাত্র ১০-১৫ জন লোককে নিয়োগ দিতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই পালিয়ে গেছে এবং ওয়াথাওয়া ও তার বন্দুকধারী সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে অন্যান্য গ্রামবাসীরা তাদের সহায়তা করছে।
সেনাবাহিনী পিছু হটছে
জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক পারফরম্যান্স এখন তাদের সমর্থকদের মনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
একজন বিশিষ্ট ব্লগার সম্প্রতি মিন অং হ্লাইংকে 'অযোগ্য' বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, তার অধীনে দেশ রেকর্ড ক্ষতি ও লজ্জার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এর জন্য হ্লাইংকে মূল্য দিতে হবে এবং পদত্যাগ করতে হবে।
তিনি বলেন, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বিদ্রোহীরা উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে। ব্রাদারহুডের অধীন তিনটি জাতিগত বাহিনী এখন চীনের সঙ্গে সীমান্তের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।
ওই ব্লগার বলেন, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত বছরের অক্টোবরে তাদের অভিযান শুরু করে, জান্তার হাজার হাজার সৈন্য এবং তাদের সব সরঞ্জাম আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তাদের অভিযান শেষ হয়। সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনী এবং শত শত স্বেচ্ছাসেবক (যারা জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জাতিগত বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছিল) মধ্যে লড়াই চলছে, যাতে মনে হচ্ছে জান্তার অবস্থান ভেঙে পড়েছে।
চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহগুলোতে সেনাবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে জোটের তিন গ্রুপের একটি আরাকান আর্মি বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে এবং তাদের চিন রাজ্য ও রাখাইন রাজ্যের বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, ছিপছিপে ইউনিফর্ম পরিহিত সেনাদের হাতকড়া পরিয়ে তারের টাই পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হচ্ছে।
অতর্কিত হামলা থেকে সড়কগুলো সুরক্ষিত করতে অক্ষম সামরিক বাহিনী, তাদের ঘাঁটিগুলোতে পরিষেবা সরবরাহের জন্য তাদের সীমিত সংখ্যক হেলিকপ্টারের উপর নির্ভর করছে এবং নিজেদের আত্মরক্ষার্থে বিমান হামলা চালাচ্ছে যার ফলে ব্যাপক বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা বলছে, তারা এ মাসে একটি হেলিকপ্টার ও একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি আত্মসমর্পণকারী সেনাদের যুদ্ধের খুব সামান্য অভিজ্ঞতা ছিল এমনটাও জানা যাচ্ছে। এমনকি তাঁরা লড়াই করার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
এ অবস্থায় শত শত সেনা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় এবং হাজার হাজার সেনা বিনা-যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছে।
শান রাজ্যে পরাজিত ছয় জেনারেলকে বন্দি করা হয়েছে।
বন্দি বিনিময়ের এক চুক্তির আওতায়, তাঁদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার পরে- এদের তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সম্ভবত অন্যদের আত্মসমর্পণ করা থেকে বিরত রাখতে এ ধরনের কঠোর বিচার করা হয়েছিল।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে এ ধরনের বিপর্যয় নজিরবিহীন। সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে, এই পরিস্থিতিতে নতুন সেনা নিয়োগ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
মিত্ররা শত্রুতে পরিণত হয়েছে?
তাহলে মিয়ানমারের অভ্যুত্থান নেতার কি এই বিক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
গত সপ্তাহে মঞ্চ থেকে পাও কো তাওয়ের সাহসী সমালোচনা তার স্নায়ুকে আঘাত হেনেছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ এরপরেই পরে সৈন্যরা তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তবে দ্রুত তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পাও কো তাওয়ের কিছু শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে।
তার সমাবেশের খবর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও মিন অং হ্লাইংকে নিয়ে তার মন্তব্য অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে।
জেনারেল সোয়ে উইন, যাকে পাউক কো তাও সেনাবাহিনীর কমান্ড বানানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন, তিনি তার সৈন্যদের খারাপ পারফরম্যান্সে অসন্তুষ্ট বলে জানা গেছে।
তবে তিনি এখনও জান্তা প্রধানের পদ দখলের কোনো লক্ষণ দেখাননি। বর্তমানে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে।
মিন অং হ্লাইং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করার ক্ষেত্রেও দক্ষ প্রমাণিত হয়েছেন।
গত সেপ্টেম্বরে যে জেনারেলকে একসময় তার সবচেয়ে সম্ভাব্য উত্তরসূরি বলে মনে করা হতো, সেই জেনারেল মো মিন্ট তুনকে হঠাৎ গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে দুর্নীতির দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কোনো উত্তরসূরি না থাকায় জান্তার সবচেয়ে একনিষ্ঠ সমর্থকরা বেশ আরাম বোধ করছেন।
এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে শোচনীয় পরাজয়ের পরেও একজন সামরিক কমান্ডারের চেয়ে একজন রাজার মতো করে মিন অং হ্লাইং সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে সভাপতিত্ব করছেন।
এটা কি তার আত্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করছে, নাকি বাস্তবতা থেকে তার বিচ্ছিন্নতা, তা স্পষ্ট নয়।
কিন্তু সেনাবাহিনী গত তিন মাসে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করেছে, যে এর বেশি ভার তারা নিতে পারবে না।
উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের প্রধান শহর লাশিওতে জান্তা বাহিনীর পতন; পশ্চিমে রাখাইন রাজ্যে; অথবা থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী কারেন্নি রাজ্যে, যেখানে বিদ্রোহীরা রাজ্যের রাজধানী লোইকাও দখলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, সেখানে সামরিক মনোবল আরও ব্যাপক ভাঙন দেখা দিতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটতে পারে।