কোয়ারেন্টিনে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য পরিবারের করণীয়
কোভিড-১৯-এর আক্রমণের পর এ বছরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিরা নিজেদেরকে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব ও বাসায় অবস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। অবশ্য এর মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার তাদের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে খুবই সময়োপযোগী সেবা প্রদান করে আসছে। এর ভেতর দিয়ে তাদের শিখন ও শিক্ষণ পদ্ধতিতে নতুন প্যারাডিগমেটিক শিফট ঘটেছে বা নতুন ধরনের সেবার সৃষ্টি হয়েছে।
এটা যেমন নতুন দিক উন্মোচন করেছে, তেমনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিরা যেহেতু সারাক্ষণ বাসায় থাকছে, সেহেতু তাদের জন্য পরিবারের বিভিন্ন করণীয় দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
'কোয়ারেন্টিন সময়' শুনলে আজকাল মনে হয়, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আর ঘরের মধ্যে আবদ্ধ জীবন। কিন্তু আমরা যদি একটু বিপরীতভাবে চিন্তা করি, এটা আসলে পরিবারের সঙ্গে খুব ভালো কিছু সময় কাটানো, যা হয়তো আমাদের যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত জীবনে হারিয়ে গিয়েছিল।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা কিন্তু এই পরিবারের সদস্যদের বাইরে নয়। যে বাবা, অথবা ভাই-বোন কখনোই পরিবারের এই বিশেষ শিশুটির সঙ্গে সময় কাটায়নি কিংবা তারও যে আলাদা একটা ব্যক্তিসত্তা আছে- যা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম, কোয়ারিন্টিনের সময়টা নতুন করে ভাবনার এবং তাদের জন্য পরিবারের সবার কিছু করার একটা ভালো সুযোগ।
একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু তার হাজারও সীমাবদ্ধতা নিয়েও প্রতিদিন নতুন করে একটা দিন শুরু করে কিংবা করতে চায়। আর এক্ষেত্রে পরিবারের একটা বড় ভূমিকা পালন করার রয়েছে।
আমার যেমন আনন্দ,অনুভূতি, ভালোলাগা, ভালোবাসা, ঘৃণা, কষ্ট এবং আত্মসম্মানবোধ-- এই সবকিছু আছে, একজন বিশেষ শিশুর মধ্যেও এইসব অনুভূতি থাকে। আমাদের নিজস্ব উপলব্ধি দিয়ে তাদের বুঝতে হবে। সবার প্রথমেই যে বিষয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তা হলো- এই সময়ে শিশুটি কোনো মানসিক চাপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা লক্ষ্য করা। কারণ, আমাদের এই শিশুরা অনেক কিছু বলে প্রকাশ করতে পারে না; তাই তাদের অস্থিরতা থাকে অন্য সবার চেয়ে বেশি।
যেহেতু আমরা বাইরে যেতে পারছি না, সেজন্য পরিবারের সবাই মিলে কোয়ালিটি টাইম একে অপরকে দেওয়া উচিত। এবং অবশ্যই সেটা তার পছন্দ, তার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে। বাসায় তার জন্য একটা কাজের রুটিন তৈরি করা থাকবে- কখন কোন কাজটা সে করবে এবং কার সঙ্গে করবে। বাবা-মা, ভাই-বোন যারা থাকবেন, তাদের সবার সঙ্গে বাচ্চাটি যেন কাজ করতে পারে, সেভাবেই একটা রুটিন তৈরি করতে পারেন। এখানে উদ্দেশ্য একটাই, পরিবারের সবার সঙ্গে বাচ্চাটির যেন একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।
বাচ্চাটির বয়স এবং দক্ষতা অনুযায়ী তাকে পরিবারে কিছু কাজের দায়িত্বও দেওয়া যেতে পারে। সে যদি ভালো কাজ করে, সেক্ষেত্রে তার অনেক বেশি করে প্রশংশা করা উচিত, যেন পরের দিন সে নতুন উদ্যমে কাজ করার আগ্রহ নিয়ে থাকে। একইসঙ্গে চলমান পরিস্থিতি শিশুটির সামনে ব্যাখ্যা করা, কীভাবে অন্য সবাই এই সময় বাড়িতে সময় কাটাচ্ছে, সেই বিষয়গুলোও তাকে দেখানো। দিনের একটা সময় অবশ্যই বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা। সেটা হতে পারে সবাই মিলে ভালো কোনো সিনেমা দেখা, কোনো ইনডোর গেম খেলা।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মানসিক দিকগুলোর উন্নয়নে পরিবারের তৎপর থাকা দরকার। হোম কোয়ারেন্টিনে এই শিশুদের করণীয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রতিনিয়ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে নিচের বিষয়গুলি আমাদের সামনে উঠে এসেছে। আমাদের সঙ্গে যেসব অভিভাবক রয়েছেন, তারাও আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন নিচের বিষয়গুলো শনাক্ত এবং এইগুলো নিয়ে কাজ করতে।
১। যেকোনো ধরনের ভয়, দুঃশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অবসাদগ্রস্ততা থেকে এদের নিরাপদ রাখা। কোনো ধরনের ট্রমার মধ্যে ওই শিশু বা ব্যক্তিকে যেন পড়তে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। কারও হাতে ওই শিশু বা ব্যক্তি যেন নিপীড়িত না হয়, তা নিশ্চিত করা।
২। পরিবারের কোন সদস্য কখন ওই শিশু বা ব্যক্তির সঙ্গে গঠনমূলক সময় কাটাবে, তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা ভালো এবং পাশাপাশি তাকে বোঝানো- আমরা সবাই একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করছি। এর জন্য আগে থেকেই সন্তানের সঙ্গে কথা বলে তার উপযোগী একটা রুটিন ঠিক করে নেব।
৩। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সকল নিয়মকানুন পালন নিশ্চিত করা ও অভ্যাসে পরিণত করতে সাহায্য করা। যেমন বেশী করে পানি পান করা বা নির্দিষ্ট সময়ে টয়লেট ব্যবহার করা, অথবা নির্দিষ্ট সময়ে সবার সাথে একসাথে বসে খাবার খাওয়া।
৪। অন্যান্যদের মতোই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক অসুস্থ্যতার যে কোনো লক্ষণ দেখা দিলে, অসুস্থ্য হাবার ভয়, চিকিৎসা সেবা নিতে ভয় কিংবা মৃত্যুভয় দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক বা সঠিক প্রফেশনাল এর সহায়তা নিশ্চিত করুন।
৫। ওই শিশু বা ব্যক্তির যেন পর্যাপ্ত ঘুম হয়, সেই ব্যবস্থা করা। বর্তমান সময়ে সামান্য যে কোনো শারীরিক অসুস্থতার উপসর্গ দেখা দিলে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৬। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় ব্যয়াম, ইয়োগা ও নির্দিষ্ট থেরাপির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এটা থেরাপিস্টের সাহায্যে করানো যেতে পারে; অথবা অভিভাবকরা নিজেরাও সহায়তা করতে পারেন।
৭। বাইরে যাওয়ার অসুবিধাগুলো এই শিশু ও ব্যক্তিদের তার উপোযোগী করে বোঝানো। এক্ষেত্রে ওই শিশু বা ব্যক্তির সক্ষমতা ও দুর্বলতার দিকে খেয়াল করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের আগ্রহ ও পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া। আমরা অনেক সময়ই ওদের চাহিদাগুলো আমাদের সঙ্গে মিল না থাকায়, অথবা অন্যান্য কারণে প্রাধান্য দিই না। ওরা যখন রেগে যায় বা অন্যান্য আচরণের মাধ্যমে জোরাজুরি করে, তখন আমরা ওদের কথা শুনি; এমনটা বারবার করলে ওরা ধরেই নেয়, খারাপ আচরণেই শুধু তাদের কথা মনোযোগ পাওয়া সম্ভব। তার মানে কিন্তু এটাও নয়, কোনো অন্যায্য চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে হবে। অন্যায্যের ক্ষেত্রে অভিভাবকের শক্ত থাকাটাই বাঞ্ছণীয়।
৯। পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আপনজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, থেরাপিস্টদের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করা। সে নিজে অপারেট করতে পারলে ভালো; না পারলে তাকে সাহায্য করতে এবং উৎসাহিত করতে হবে।
১০। বিনোদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বিভিন্ন রকম ফান অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে। মজার মজার ইনডোর গেমস হতে পারে, যেগুলো দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখবে।
১১। সারা দিনের রুটিন ঠিক করা, যেন এটিতে সে স্বাছন্দ্যবোধ করে এবং এই রুটিন মেনে চলতে তাকে সাহায্য করা। তাদের আনন্দ দিতে পারে, এমন কাজ রুটিনে রাখা যেতে পারে।
১২। রুটিন মাফিক বিভিন্ন কার্টুন, নাটক, টিভি শো, সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করা; অথবা এমন কোনো কাজ করা, যেটা তারা পছন্দ করবে এবং তাদের আনন্দ দেবে।
১৩। সুকুমার বৃত্তি বিকাশের লক্ষ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বিভিন্ন রকম কাজে যুক্ত রাখা; যেমন- নাচ, গান, আবৃত্তি ইত্যাদি চর্চার ব্যবস্থা রাখা।
১৪। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বাসায় থাকা জিনিসপত্র ব্যবহার করে ক্র্যাফট জাতীয় জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত রাখা।
১৫। এমন শিশু ও ব্যক্তিদের বাসার দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখা। যেমন- ঘর গোছানো, ঘর মোছা ও পরিষ্কার করা, ফার্নিচার পরিষ্কার করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া, ভাঁজ করা ও আয়রন করা, সবজি ছিলা ও কাটা, মাছ-মাংস কাটা ও পরিষ্কার করা, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র অপারেট করতে শেখা, রান্না-বান্না শেখা , সেফটি সিকিউরিটি সম্বন্ধে শেখা ইত্যাদি।
১৭। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের শিখন প্রক্রিয়া গতিশীল রাখতে হোম স্কুলিংয়ের ইতিবাচক দিকগুলো তাদের সামনে তুলে ধরা। হোম স্কুলিং কার্যক্রমের সম্ভাব্য সকল কাজে ওই শিশু বা ব্যক্তিকে সাহায্য করা।
১৮। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদেরকে অনলাইন ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, যেন তারা তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে।
১৯। এমন শিশু ও ব্যক্তি কোন কোন ক্ষেত্রে আচরণগত সমস্যা করছে, সেই অবস্থাগুলো খেয়াল করা। এ সময় কি ধরনের শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে, তা লিখে রাখা। এমন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, যথাসম্ভব সেই খেয়াল রাখা।
২০। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের আবেগসংক্রান্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সে সম্পর্কে প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া। শিক্ষার্থীকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সাহায্য করা।
২১। এমন শিশু ও ব্যক্তিদের মোবাইলে কল করা; মেসেজ আদান প্রদান, ছবি বা ডকুমেন্ট শেয়ার করা শেখানো। পাশাপাশি তাদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে অভ্যস্ত করা।
সর্বোপরি, একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, নিয়ম করে পারিবারিক কাজগুলোতে পরিবারের সকল সদস্যের যুক্ত থাকা; যেন সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং ওই শিশু বা ব্যক্তি উৎসাহ খুঁজে পায়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি, এ ধরনের অনেক শিশু বা ব্যক্তি পিতা-মাতা বা ভাই-বোনের কথা না শুনে শিক্ষকের কথা বেশি শুনে; অনেক পিতা-মাতা এ ধরনের মন্তব্য বা নালিশ করেন। এমনটা হওয়ার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সে বিষয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে।
এই কোয়ারেন্টিনের সময়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের নিয়ে সবাই থাকুন, সেই প্রার্থনা করি।
- লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার এবং প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট, প্যারেন্টস ফোরাম ফর ডিফারেন্টলি অ্যাবল
(লেখাটি পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগিতায় তৈরি।)