প্রাচীন ভারতের সুগন্ধশিল্প
শ্রুতির সুখের জন্য সাত সুরের সম্মিলনে বিচিত্র রাগ ও রাগিণীর সৃষ্টি করেছে মানুষ। রসনার তৃপ্তির জন্য শস্যদানা আর শাকসবজি দিয়ে বানিয়েছে বিবিধ খাবার। চোখ জুড়ানোর জন্য পাথর ও কাঠ কেটে বানিয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য আর রঙ দিয়ে এঁকেছে চিত্তাকর্ষক চিত্রমালা। ঘ্রাণের ইন্দ্রিয়াসন নাকও অবহেলিত থাকেনি, এবং এর পরিতৃপ্তি সাধনের উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম নানা বস্তুর মিশেলে তৈরি করেছে বিবিধ সুগন্ধিদ্রব্য।
কাজটি মোটেও সহজ ছিল না, কেননা নিরেট বস্তু বা সহজে ধরা-ছোঁয়া যায় এমন কিছু দিয়ে অন্য ইন্দ্রিয়গুলোর পরিতোষণ সম্ভব হলেও প্রাকৃতিক উৎস তথা শেকড়, ফুল প্রভৃতি থেকে সুগন্ধি উপাদান আহরণ ক'রে কোনো নিরেট মাধ্যম বা বাহকের মারফতে পরিবেশন করার মতো উপায় তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছিল যেন মোহিনী সুগন্ধকে বহুদিন ধ'রে রাখা ও উপভোগ করা চলে। ফলে, কলা ও বিজ্ঞান দুই রূপেই গন্ধশিল্পের চর্চার প্রয়োজন দেখা দিলো, কেননা আতরস্রষ্টাকে সুগন্ধবস্তুর সুষম মিশেল দিতে জানতে হয় যার জন্য শিল্পীসুলভ ইন্দ্রিয়সংবেদ আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দুইয়েরই দরকার।
ভারতবর্ষ স্মরণাতীত কাল থেকেই আতর ও সুগন্ধিদ্রব্যের জন্য সুপরিজ্ঞাত। সুগন্ধিবস্তু রূপচর্চার উপকরণ হিসাবে বিবেচিত হতো এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পুরুষ ও নারী কর্তৃক এসবের ব্যবহারের উল্লেখ আমরা পাই।
কল্পসূত্রেও সুগন্ধিদ্রব্যের ব্যবহারের কথা আছে। বলা হয়েছে, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ব্রহ্মচারীর বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনেরা সুগন্ধিদ্রব্য বা চন্দনবাটা নিয়ে আসতো যেগুলো সে তার শরীরে মেখে সর্বপ্রকারের ভেষজ লতাপাতা দিয়ে সিদ্ধ করা সুগন্ধজলে স্নান করতো।
গৃহ্যসূত্রে উল্লেখ আছে, টগর নামের সুগন্ধবস্তু সাপকে দেওয়া হতো আর শ্রাবণোৎসবে বিশেষ কিছু মলমও অর্পিত হতো সাপের উদ্দেশে। সাধারণত উশীর ঘাস (Andropogon muricatus) কিংবা চন্দন থেকে প্রস্তুত অনুলেপন ও অঙ্গরাগ গায়ে মাখার উল্লেখ মহাকাব্যসমূহ ও অন্যান্য সাহিত্যকর্ম জুড়ে আছে।
সুগন্ধি তেল, মলম ইত্যাদি তৈয়ারের আরো বেশ কিছু উপাদানের উল্লেখও পাওয়া যায়। কালেয়ক (সুগন্ধি তেল তৈরি করে এমন একটা উদ্ভিৎ), অগরু (Aquilaria agallocha), ইঙ্গুদী (Terminalia catappa), চন্দন, কস্তূরী, কুঙ্কুম (জাফরান) প্রভৃতি ছিল সুগন্ধি তৈরির কাজে বহুল ব্যবহৃত বস্তু। এমনকি মনঃশিলা, হরিতাল, মঞ্জিষ্ঠার মতো বস্তুও সুগন্ধ আহরণের উৎস হিসাবে উল্লিখিত হয়েছে।
বাৎসায়নকৃত নাগরকের বিবরণে প্রক্ষালণঘরের যে-চিত্র পাওয়া যায় তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে গন্ধসামগ্রী ও আতরের ব্যবহার প্রাচীন ভারতের শৈলীসচেতন নাগরদের জীবনের প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে গিয়েছিল। ফেনকের উল্লেখ দেখে আমরা বুঝতে পারি, প্রাচীন ভারতীয়গণ সুগন্ধি সাবানও তৈরি করতে জানতেন।
চন্দন ও এর নানান ধরণ, এবং নবমল্লিকার গন্ধযুক্ত অগরু ও এর নানান ধরন ইত্যাদি উচ্চমূল্য সুগন্ধি কাঠের ব্যবসায়ের কথা কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন। তিনি তৈলপর্ণিকা গাছের কথাও উল্লেখ করেছেন যার কাঠ থেকে অশোক-গ্রামিক, জোঙ্গক, গ্রামেরুক প্রভৃতি সুগন্ধদ্রব্য তৈরির সুগন্ধি তেল আহৃত হতো। বাটা, সিদ্ধ বা পোড়ানো যা-ই করা হোক না কেন, তৈলপর্ণিকা থেকে প্রস্তুত দ্রব্যাদির গন্ধ যে দীর্ঘস্থায়ী হতো, তার সবিস্তার বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। ঐসব উল্লিখন থেকে এ-কথা পরিষ্কার যে, লোকেরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে আতর ও সুগন্ধি সামগ্রী তৈরি করছিল, সুগন্ধশিল্প বিকশিত হচ্ছিল, এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় ও শিল্প হিসাবে এর প্রসার ঘটছিল। ভারতীয় সুগন্ধ সামগ্রী মূল্যবান রপ্তানিপণ্যও হয়ে উঠেছিল।
মিশরীয় (perfumare = ধোঁয়া দিয়ে ভ'রে দেওয়া) মন্দিরগুলোতে সুগন্ধি ধূপ দেওয়ার ব্যাপারটা থেকেই ইংরেজিতে perfume কথাটা এসেছে। কিন্তু উপযুক্ত বাহকের ভেতরে সন্নিবিষ্ট সুগন্ধযুক্ত বস্তুর যে-কোনো মিশ্রণকেই perfume বলা চলে।
সুগন্ধি সামগ্রীর বৈজ্ঞানিক উৎপাদন প্রসঙ্গে প্রথম মূল্যবান আলোচনা পাওয়া যায় বরাহমিহিরের বৃহৎ সংহিতা রচনায়। বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি সামগ্রী, ওগুলোর প্রাকৃতিক উৎস, তৈরির প্রক্রিয়া ইত্যাদি এই রচনায় গন্ধযুক্তি শিরোনামে আলোচিত হয়েছে। গন্ধযুক্তি শব্দ সুগন্ধি সামগ্রীর কলা ও বিজ্ঞান দুইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
গন্ধযুক্তিজ্ঞ ও গন্ধযুক্তিবিদ শব্দদুটোও সেকালে প্রচলিত ছিল, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে বিশেষ এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের বৃত্তি হিসাবে সুগন্ধি সামগ্রীর উৎপাদন ও বিপণনকে বেছে নিয়েছিলেন। গন্ধযুক্তি শব্দের আক্ষরিক অর্থ নানান সুগন্ধির মিশ্রণ। সমবায় সূত্র রচনায় রাসায়নিক শিল্প অর্থে সুগন্ধশিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।
কামশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ৬৮ কলার মধ্যে একটি ব'লে বাৎসায়ন একে উল্লেখ করেছেন। রাজা সোমেশ্বর রচিত শার্ঙধর পদ্ধতি, অগ্নিপুরাণ, মানসোল্লাস এবং গঙ্গাধর রচিত গন্ধসার প্রভৃতিতেও বৈজ্ঞানিক শিল্প হিসাবে এটি আলোচিত হয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক বিষয়ের সবিস্তার বিবরণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৭শ শতাব্দীর কেলাডি বাসবরাজ রচিত বৃহদায়তন শিব তত্ত্ব রত্নাকর রচনায়। ধাতুবিদ্যা, রয়াসনশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ের বিবিধ তথ্যের বিশদ আকরগ্রন্থ এটি।
বৃহৎ সংহিতা ও শিব তত্ত্ব রত্নাকর প্রভৃতি রচনায় প্রদত্ত বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি সামগ্রী এবং সেগুলো তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে এখন আমরা আলোকপাত করব, যার ওপর নির্ভর ক'রে এ-সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে যে প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান হিসাবে আতরবিদ্যার বিকাশ ঘটেছিল এবং আজকের দিনে যে-বিজ্ঞান চূড়ান্ত বিকশিত পর্যায়ে আছে, সে-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার কাজে আমাদের দেশের অবদান কোনো অংশে ঊন ছিলো না।
সুগন্ধি তৈল:
চাঁপা ফুলের সুবাস ছড়ায় এমন চুলের তেল তৈরির প্রক্রিয়ার বিবরণ বৃহৎ সংহিতায় দেওয়া আছে। সমপরিমাণে মঞ্জুষ্ঠা, ব্যাঘ্র-নখ (Euphorbia antiquorum), শুক্তি (Unguis odoratus), দারুচিনি ছাল, কোষ্টি ও রজনের গুঁড়োকে তিলের তেলে মেশাতে হবে এবং এর পরে তেলটাকে রোদে শুকাতে হবে।
বাসবরাজ বলেছেন গোসলের জন্য বা গাত্রমর্দনের তৈল তৈরি করতে হবে সুগন্ধি উপাদান আর ভেষজ লতাপাতাকে মিশিয়ে। গায়ে মাখানোর কাজে ব্যবহার্য্য তেল তৈরির জন্য চাঁপা, পুন্নাগ, কেতকী, জাতী প্রভৃতি সুগন্ধি ফুলের নির্যাস দিয়ে প্রথমে তিলের দানাকে ভাপাতে হবে এবং এরপর পেষণী পাথরে ভেঙ্গে চূর্ণ করতে হবে। বৃহৎ সংহিতায় বর্ণিত প্রক্রিয়া সঙ্গে এই এক্রিয়ার কিছু পার্থক্য রয়েছে।
অগ্নিপুরাণ-এ সুগন্ধি তৈল নিষ্কাশনের জন্য প্রথমে ফুলের নির্যাস দিয়ে তিলের দানাকে ভাপানোর কথা বলা হয়েছে। ফলে, সুগন্ধি তৈল তৈরির ক্ষেত্রে যে দুটি ভিন্ন পদ্ধতির প্রচলন ছিলো, তা পরিষ্কার হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, শিব তত্ত্ব রত্নাকর রচয়িতা তিল থেকে তৈল নিষ্কাশনের সাধারণ পদ্ধতিসহ শস্যদানাকে প্রস্তুত করা ও ভাপানোর নানান প্রক্রিয়াও বাৎলে দিয়েছেন। অন্যান্য ধরনের সুগন্ধি তৈরির ক্ষেত্রেও মুখ্য তেল হিসাবে তিলের তেল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তেল বানানোর দানাগুলোকে প্রথমে প্রখর রোদে ভালোমতো শুকিয়ে নিতে হবে। আবহাওয়ার ভিন্নতার ভিত্তিতে তিল থেকে তেল নিষ্কাষণের দুই ধরনের প্রক্রিয়া প্রস্তাবিত হয়েছে; যথা, গ্রীষ্ম শরৎ ও বসন্ত কালে রোদের তাপে আর হেমন্তকালে আগুনের আঁচে শুকানো।
তিলের দানাকে ভাপানোর কাজে প্রাচীন ভারতে ব্যবহৃত পাঁচটি প্রক্রিয়ার বিবরণ দিয়েছেন বাসবরাজ। পঞ্চপল্লব (Ficus racemora, Ficus indica, Ficus lacor, Manjifera indica, Ficus religiosa এই পাঁচটি গাছের পাতা)-এর রস ব্যবহার করে মর্দন বা ডলন; সর্বগন্ধার রসের বাষ্প প্রয়োগ করে স্বেদন; ত্রিজটা (Cinnamomum zeylanicum এর ছাল, এলাচ, Cinnamomum tamala) ও ত্রিফলা (হরীতকী, বয়রা, আমলকী) সহযোগে লেপন; অগুরু, কুঙ্কুম (জাফরান) এবং চন্দন (Santalam album) এর ধোঁয়ায় ভাপিয়ে ধূপনম্; এবং তিলের সঙ্গে অন্যান্য সুগন্ধিবস্তুর গুঁড়ো মিশিয়ে বাসনম্।
ফুলের সৌরভ ছড়ায় এমন দুই ধরনের তেল তৈরির রেসিপিও দেওয়া হয়েছে। সমপরিমাণ শ্রীগন্ধা, অগরু, কুঙ্কুম, অব্জ (পদ্ম), ত্বক (দারুচিনি গাছের ছাল), কুষ্ট, তগর (Tabernaemontana coronaraia), ঘনসার, অঙ্কোল (Alangium salarifolium), লাক্ষা এগুলোর সঙ্গে তিনগুণ পরিমাণে রাল মিশাতে হবে এবং তা থেকে সোমযন্ত্র পদ্ধতিতে তৈল নিষ্কাশন করতে হবে। জাতী, চম্পক, কেতকী, মরুবক এবং কস্তূরী ফুলের নির্যাসের সঙ্গে তেল মিশিয়ে তৈরি আরেকটি সুগন্ধি তৈলেরও উল্লেখ আছে। সোমযন্ত্রের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে, একালে পাতনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের মতো কোনো যন্ত্রের প্রচলন এমনকি সেকালেও ছিল এবং প্রাকৃতির উপাদান পাতিয়ে সুগন্ধি নিংড়ানোর কারিগরি শিল্প লোকের জানা ছিল। কোষ্টি যন্ত্র ও অন্যান্য উপায় ব্যবহার ক'রে হরিতাল ও মনঃশিলা থেকে সুগন্ধি নির্যাস আহরণ করার পদ্ধতির বিবরণ রয়েছে পারদ, খনিজদ্রব্য প্রভৃতি বিষয়ের পর্যালোচনামূলক প্রাচীন গ্রন্থ রসরত্নসমুচ্চয়-এ।
অনুবাদ: এহসানুল কবির
সূত্র: Indian Journal of History of Science, 22(1): 71-79 (1987)