উত্তর কোরিয়ার মিসাইল গবেষক যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদ সদস্য হলেন
একজন তরুণ গবেষক হিসেবে পার্ক চঙ্গ-কওন একসময়ে নিজ মাতৃভূমি উত্তর কোরিয়ার জন্য মিসাইল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। যা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য আজও হুমকির কারণ।
সময়ের বিবর্তনে পার্ক আজ পার্শ্ববর্তী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদ সদস্য। চলতি সপ্তাহেই গণতান্ত্রিক উপায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।
যখন মানুষ স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা থেকে উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হয়, তখন তারা একটি উন্নত জীবন ও সুযোগের স্বপ্ন দেখে। সেক্ষেত্রে একজন উদ্বাস্তু একদিন হতে পারে আইনপ্রণেতা, এমনকি প্রেসিডেন্টও।
পার্কের যাত্রাটাও বেশ অসাধারণ। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি চতুর্থ শরণার্থী হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার আইনপ্রণেতা হয়েছেন।
বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পার্ক বলেন, "আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় শুন্য হাতে এসেছিলাম। এখন আমি দেশটির রাজনৈতিক পরিসরে প্রবেশ করেছি।"
পার্ক আরও বলেন, "আমি এটিকে আমাদের উদার গণতন্ত্রের শক্তি হিসাবে দেখি। আমি মনে করি এটি সব সম্ভব হয়েছে কারণ আমাদের নাগরিকরা তা চেয়েছে। এটি বেশ ভিন্নধর্মী ঘটনা ও আশীর্বাদ।"
উত্তর কোরিয়ার পর্যবেক্ষকদের মতেও পার্কের ঘটনাটি একটি উন্নতির লক্ষণ। এই বিষয়ে অটোয়ার কার্লেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সান্দ্রা ফাহি বলেন, "হাজার হাজার উত্তর কোরিয়ানরা নিজেরা ভোট দিয়েছে। তারা চলমান শাসন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেউ জিতেছেন; কেউ হেরেছেন। বিশ্ব তাদের থেকে উপকৃত হচ্ছে।"
সান্দ্রা আরও বলেন, "যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই তারা ছাড়া আর কে এর গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝতে পারে?"
পার্ক জানান, তিনি গত দেড় দশক আগে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তখন তার বয়স ২৩ বছর। তার বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানাননি। কেননা এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। যদি তারা বিষয়টি জানতেন, তবে এটি তাদের বিপদে ফেলতে পারতো।
পার্ক শেষ তিন বছর ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে যুক্ত থেকে কাটিয়েছিলেন। তিনি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র প্রযুক্তির বিকাশের দায়িত্বে থাকা পরবর্তী প্রজন্মের অভিজাত শিক্ষার্থীদের একজন।
পার্ক ১৯৯০-এর দশকে উত্তর কোরিয়ায় বড় হয়েছিলেন। ঐ সময়টাতে দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ চলছিল; লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। হতাশ নাগরিকেরা কালোবাজারি পণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।
কিন্তু এতসব প্রতিবন্ধকতা ও নেতিবাচকতার মাঝেও পার্ক বাইরের জগত সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি গোপনে আসা দক্ষিণ কোরিয়ান টিভি শো-গুলি দেখতেন। একইসাথে চীনে পড়াশোনাও করেছেন। ফলে নিত্য-নতুন ধারণার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি।
সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পাশের সময়ই পার্ক কোরিয়ান গণমাধ্যমকে বলেন, "আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, উত্তর কোরিয়ার শাসনব্যবস্থা কতটা দুর্নীতিগ্রস্থ ও ভুল ছিল।"
তাই পার্ক পরিকল্পনা তৈরি করে অপেক্ষা করতে লাগল। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাস। উত্তর কোরিয়া সফলভাবে প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়।
এই অস্ত্র নির্মাণের জন্য পার্ক বহু বছর ধরে পরিশ্রম করেছিলেন৷ গোটা দেশ ছিল 'উৎসবের মেজাজে'। সে সুযোগ দেখে পরের দিন সকালে সকলের আনন্দের মাঝেই তিনি দেশ থেকে আড়ালে চলে গেল।
দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া পার্কের জন্য অবশ্যই বেশ অগ্নিপরীক্ষা ছিল। সেক্ষেত্রে তিনি চীনে যেতে বেশ দ্রুত ও ব্যয়বহুল পথ বেছে নেয়। এক্ষেত্রে তাকে ৭,৩০০ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়। একইসাথে দালালের দেওয়া একটি জাল পাসপোর্টও ব্যবহার করেন তিনি।
কিন্তু গত বছর এনকে নিউজের সাথে একটি সাক্ষাত্কারে পার্ক সেই মুহূর্তটি স্মরণ করেছিলেন; যেটিকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নিজের সম্ভাব্য মুক্তি হিসেবে। টিউমেন নদীর তীর দিয়ে যখন তিনি যাচ্ছিলেন, তখন তার স্বাধীনতা ও ক্ষতির এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল।
সেখানে কিছুদিন থাকার পর পার্ক দক্ষিণ কোরিয়ার পাসপোর্ট লাভ করেন। যেটিকে তিনি নিজের জীবনের অন্যতম খুশির মুহূর্ত বলে অভিহিত করেছেন।
১৯০০-এর দশকে প্রায় ৩৫ হাজার জন উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ায় বসতি স্থাপন করেছেন। সেক্ষেত্রে পার্কও দক্ষিণ কোরিয়ায় তার নতুন জীবনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয়। যদিও এটি একটি চ্যালেঞ্জ ছিল; তবে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য তা সহজ হয়ে যায়।
পার্ক দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে যুক্ত হন। যেখানে তিনি পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পিএইচডি অর্জন করেন। তারপরে দক্ষিণ কোরিয়ার কংগ্লোমারেট হুন্দাই স্টিলে অত্যন্ত লোভনীয় চাকরি পান। তারপর প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক দল থেকেও তিনি প্রস্তাব পান।
পার্ক বিবিসিকে জানান, তিনি কখনও রাজনীতিতে প্রবেশ করার কথা বিবেচনা করেননি। তবে যখন পিপল পাওয়ার পার্টি (পিপিপি) প্রস্তাব নিয়ে আসে, তখন তিনি জনসেবা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
গত বুধবারের নির্বাচনে অনেকটা সহজেই নির্বাচিত হন পার্ক। তবে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল ও তার দল ক্ষমতাসীন পিপিপি ভালো ফলাফল করতে পারেনি।
কিন্তু পার্ক ব্যক্তিগত ইমেজের দিক থেকে অনেকটা এগিয়ে আছেন। এখন একজন নির্বাচিত আইনপ্রণেতা হিসেবে তার বেশ বড় পরিকল্পনা রয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্ববর্তী পার্লামেন্টে ইতিমধ্যেই উত্তর কোরিয়ার দুইজন সদস্য ছিলেন। উভয়েরই বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রোফাইল রয়েছে। এদের মধ্যে একজন থাই ইয়ং-হো, যিনি গাংনামের বিলাসবহুল জেলার প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি পূর্বে যুক্তরাজ্যে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। যিনি ২০১৬ সালে লন্ডনে থাকার সময় আচমকা দেশত্যাগ করেছিলেন।
অন্যজন অধিকার কর্মী জি সিওং-হো। যিনি ১৯৯৬ সালে একটি তরুণ কিশোর থাকাকালীন বাম হাত ও পা হারিয়েছিলেন।
মূলত জি ও তার ক্ষুধার্ত পরিবার একদিন একটি ট্রেন থেকে কয়লা চুরি করছিলেন। এমতবস্থায় তিনি ক্ষুধায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং ট্রেনের গাড়ির মধ্যেকার ফাঁকে পড়ে যান। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যায় এবং ভালো জীবনের আশায় ক্রাচে ভর করে উত্তর কোরিয়া থেকে পালাতে সক্ষম হন।
তবে অনেকের মতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় আসার পরেও যদিও তারা কিছুটা উন্নত জীবন পেয়েছে। তবে দেশটিতে তারা অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মতো দিন কাটাচ্ছেন।
এমন অনুভূতি থেকেই জি ২০২০ সালে আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্য মাঠে নামেন। তিনি উত্তর কোরিয়ানদের অধিকার নিয়ে প্রচারণা চালান।
এছাড়াও বছরখানেক আগে একজন দরিদ্র উত্তর কোরিয়ার মা ও মেয়েকে সিউলে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। জানা গেছে, তারা অনাহারে মারা গেছেন।
পার্কের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ানরা যখন দক্ষিণ কোরিয়ায় আসেন তখন তাদের সাহায্য প্রদানের সুযোগকে আরও উন্নত করেন। তিনি তাদের জন্য আজীবন প্যাকেজ অনুমোদনের জন্য চাপ দিচ্ছেন।
পার্ক মনে করেন, যেহেতু মহামারীর সময়ে সীমান্ত বন্ধের কারণে নতুন লোক আগমনের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে, তাই বাজেটটি পুনরায় বরাদ্দ করা উচিত। আন্তঃকোরীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তিনি কাজ করতে চান।
একইসাথে পার্ক উত্তর কোরিয়া ও কিম জং-উনের বর্ধিত ক্ষেপণাস্ত্রের উস্কানিকে মোকাবেলা করার বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্টের কঠোর মনোভাবকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন।
যদিও অনেকেই মনে করেন, আমেরিকা ও জাপানের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই উত্তর কোরিয়া এমন আচরণ করছে। তবে পার্ক এমন তত্ত্ব খারিজ করে দেয়।
বিবিসি-কে পার্ক বলেন, "কেউ কেউ মনে করেন ইউন সরকার আসার পর থেকে যুদ্ধের হুমকি বেড়েছে। তবে এটি সত্য নয়। পূর্ববর্তী প্রশাসনের অধীনে উস্কানিগুলি আরও শক্তিশালী ছিল।"
পার্ক উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন-এর প্রশাসনের সময় উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ও অস্ত্রের বিকাশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। যা উত্তর কোরিয়ার সাথে জড়িত থাকার জন্য আরও সমঝোতামূলক পদ্ধতির চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু একইসাথে পার্ক দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের সাথে 'সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করতে' দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, "আমি দক্ষিণ কোরিয়ারদের উত্তর কোরিয়ার শাসন ও এর জনগণকে আলাদাভাবে দেখতে সাহায্য করতে চাই। সেক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের একীকরণের জন্য উপযোগী একটি মানসিকতা তৈরি করতে হবে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান