আলতাদীঘি: কীভাবে একটি সংরক্ষণ প্রকল্প জাতীয় উদ্যানের সর্বনাশ ঘটাল
তিন বছর আগে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলতাদীঘি, শালবন আর পরিযায়ী পাখি দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন তৎকালীন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার। তবে এখন আলতাদীঘি ও শালবন এলাকা দেখলে তার মনের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠবে।
'সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ সুরক্ষা প্রকল্প'- নামের এক বিতর্কিত প্রকল্পে ধ্বংস করা হচ্ছে এখানকার বনায়ন। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছপালা।
কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন নওগাঁ থেকে আলতাদিঘীতে বেড়াতে আসা আরমান হোসেন। তার ভাষ্য, "হাস্যকর বিষয় হলো পরিবেশ রক্ষার প্রকল্প নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্যই ধ্বংস করা হচ্ছে।"
ধামইরহাট উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের কোলঘেঁষে আলতাদীঘি ও তার সাথে ২৬৪.১২ হেক্টর জায়গাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। এরমধ্যে জেলার সর্ববৃহৎ এই দীঘির মোট আয়তন ৫৫.৪৬ একর (পাড়সহ)।
এই দীঘি খননে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ব্যয়ে বন অধিদপ্তর 'আলতাদীঘি পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ'- শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে আলতাদীঘির জলাশয়ের চারপাশে ২ মিটার প্রস্থ ইটের সোলিং করা হবে। তৈরি হবে পাকা রাস্তা। দীঘির ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত ও বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। এতে পরিবেশের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচন এবং ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে দাবি বন বিভাগের।
বছরখানেক আগেও দীঘির চারপাশে বহুকালের আচ্ছাদিত গাছগুলো ছায়া দিত। তবে প্রকল্পের কারণে এখন গাছগুলো কাটা হয়েছে। আলোচনা কিংবা সমালোচনা শুরু এখানেই।
তবে বনায়ন ধ্বংস করে 'জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার' করা প্রকল্পের স্বপক্ষে যুক্তিও দাঁড় করিয়েছে বন বিভাগ। তারা বলছে, জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অবস্থিত আলতাদীঘিটি দীর্ঘদিন ধরে খনন ও সংস্কার না করার কারণে এর গভীরতা কমে গেছে। দীঘিতে ১ ফুটের উচ্চতার নিচে পানি থাকত। পাড়গুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় দীঘিটি পুনঃখনন ও পাড় সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ে। এ কারণে দীঘির চার পাড়ের ১,০০২টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গত বছরেই। ফলে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকার টেন্ডারের মাধ্যমে গাছগুলো বিক্রি করা হয়।
ঐতিহাসিক আলতাদিঘী ও শালবন দেখাশোনা করেন ধামইরহাট বন বিট কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, তাপদাহ ও তীব্র খরার কারণে আলতাদীঘি শুকিয়ে যায়। এ কারণে দীঘিটি নতুন করে ২.৫০ মিটার খনন করা হয়েছে।
"টেন্ডারের মাধ্যমে দীঘিপাড়ের ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ কাটা হয়েছে। এর বাইরে শালগাছ কাটা হয়নি। এগুলো নিছক অভিযোগ, বরং পরিবেশ রক্ষায় আমরা দেশীয় প্রজাতির ৩,০০০ চারা লাগিয়ে দীঘির চারপাশে নতুনভাবে সামাজিক বনায়ন করা হবে। শালবন এলাকায় আগেও সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে," বলেন তিনি।
এ প্রকল্পের বাইরেও উজাড় হচ্ছে বন
এ প্রকল্পের বাইরেও গাছ কেটে বিভিন্ন স্থাপনার ঘটনা দেখা গেছে শালবন এলাকাজুড়ে।
আলতাদীঘির পাশে ১৭.৩৪ হেক্টর বনভূমিকে ২০১৬ সালে বন অধিদপ্তর বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা ঘোষণা করে। এই অঞ্চলের মধ্যেই ১ কোটি ৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার। এখানে প্রায় এক বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার মো. মমতাজ হোসেন।
তিনি জানান, "আমি এই এলাকায় কাজ করতে যাওয়া-আসা করছি প্রায় এক বছর ধরে। এরমধ্যে পুকুর খননের কাজ চলছিল। পাড়ে অসংখ্য গাছপালা ছিল। দেখতেও ভালো লাগতো। কিন্তু পুকুরের মাটি ভরাটের জন্য পাড় ও আশপাশের অসংখ্য গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বনের মধ্যে ওয়াচ টাওয়ার, অফিসভবন, ২ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি টয়লেটসহ আরও স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কারণেও কিছু গাছপালা কাটা হয়েছে।"
কনক ইসলামের বাড়ি আলতাদীঘি এলাকায়। এই পর্যটন কেন্দ্রে তিনি খাবার দোকন করছেন তিন বছর হলো। এই তরুণ উদ্যোক্তা জানান, "আগে দীঘির চারপাশের গাছের কারণে এলাকা অনেক ঠাণ্ডা থাকত। এখন এখানেও গরম বেড়েছে। পর্যটকরাও এখন কম আসে।"
এই বনের মধ্যে মাঝে মাঝেই আগুন ধরিয়ে গাছ পুড়িয়ে দেওয়া হয় উল্লেখ করে নওগাঁ সদর উপজেলার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, "এই এলাকায় রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন লোকজন ও বন কর্মকর্তারারা গাছ চুরির সাথে জড়িত। নইলে কয়দিন পর পর কেন বনের মধ্যে আগুন লাগে?"
"শালবনের মধ্যে অনেক এলাকায় শালগাছ নেই। এখানে সাংবাদিকরা নিউজ করতে আসলেও তোপের মুখে পড়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন। ক্ষমতাসীন লোকজন জড়িত থাকার কারণে ভয়ে গাছ চুরি কিংবা অনিয়মের মাধ্যমে বিক্রি নিয়ে কেউ মুখ খোলে না। এভাবে চলতে থাকলে এখানে পর্যটক আসা আরও কমে যাবে," যোগ করেন তিনি।
পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি
বন উজাড়ের কারণে নওগাঁর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে সতর্ক করেছেন পরিবেশবাদীরা। এ বছর ইতোমধ্যেই জেলার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।
নির্বিচারে গাছ কাটার বিষয়ে নওগাঁর মো. রকি বলেন, "আলতাদীঘি খনন ও পাড় সংস্কার দেখে মনে হচ্ছে এই অঞ্চল মরুভূমির পথে যাচ্ছে। এখানে এসে কথা বলে জানলাম, এখানে এক হাজার গাছ কাটার কথা বলে পশ্চিম পাড়ের শালসহ কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এটা উন্নয়নের নামে বন কর্মকর্তাদের বাণিজ্য।"
মো. সোহাগ গরুর খামারের পাশাপাশি আলতাদীঘির পাড়ে খাবারের দোকান দিয়েছেন দুই বছর হলো। এই ব্যবসায়ী জানান, গাছ কাটার আগে এখানে মনোরোম পরিবেশ ছিল। বর্তমানে এটি খারাপের দিকে যাচ্ছে। "আগে আলতাদীঘিতে পানি ছিল, বনে পাখি ছিল। কিন্তু এখন নেই। এখন দীঘি গো-চারণ ভূমি।"
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হওয়া গাছপালা এভাবে নির্বচারে কাটা পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে বলে জানালেন নওগাঁ সরকারি কলেজে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান।
এই পরিবেশবিদ বলেন, "আলতাদীঘির চারপাশের যে গাছপালা ছিল, তা অনেকটাই সুন্দরবনের মতো। ঝোপঝাড় ধরনের গাছপালা। মাঝে সংবাদে এসেছিলে অজগর সাপ বনের মধ্যে শিয়াল ধরে খেয়েছে। এই সাপ ও শিয়াল জীবন বৈচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশের অংশ।"
"আলতাদীঘির গাছগুলোকে কেন্দ্র করে সেখানে এক ধরনের জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। যাকে আমরা বরেন্দ্র ভূমির জীববৈচিত্র্য বলে থাকি। গাছ কেটে আগুনে পোড়ালে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।"
"প্রাকৃতিক দৃশ্য থাকার কারণে সেখানে আমরা ভূগোল বিভাগ থেকে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষা সফরে যেতাম। এখন সেই জয়গা আর প্রাকৃতিক থাকল না। আবার আমাদের এই অঞ্চল হলো দেশের উঞ্চতম। তারপর সেখানে এভাবে গাছ নিধন! আসলে প্রাকৃতিক বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বন বিভাগকে বুঝতে হবে," বলেন মো. মিজানুর রহমান।