৫২ শতাংশ কর্মী দালালের মাধ্যমে বিদেশ যায়, বাড়ে অভিবাসন খরচ: বিবিএস
প্রায় ৫২.০৩ শতাংশ আন্তর্জাতিক অভিবাসী তাদের অভিবাসন খরচ দালালদের দিয়েছেন। শহরাঞ্চলের (৪৮.২৫ শতাংশ) তুলনায় গ্রামাঞ্চলে (৫৩.১০ শতাংশ) এমন ঘটনা বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের সম্পৃক্ততা দরিদ্র কর্মীদের খরচ বাড়িয়ে দেয়।
৫ জুন প্রকাশিত 'রিপোর্ট অন সোশিও-ইকোনমিক অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভে ২০২৩'-এ বলা হয়েছে, রংপুর ব্যতীত বেশিরভাগ বিভাগে অভিবাসন খরচের জন্য দালালদের ওপর ব্যাপক নির্ভর করতে হয়। রংপুরে সর্বোচ্চ ৫৪.৮৭ শতাংশ মানুষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভিবাসন খরচ দিয়েছে।
গত বছর ১৩ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন।
তবে চড়া অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকার দালালদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
জরিপ অনুসারে, সিলেট বিভাগের অভিবাসীরা বিদেশ গমনে সবচেয়ে বেশি দালারের ব্যবহার করে। এই বিভাগের মোট অভিবাসীর ৫৮.৫৩ শতাংশ বিদেশে গেছেন দালালের মাধ্যমে। এর পরেই ময়মনসিংহ (৫৭.৪৪ শতাংশ) বিভাগের অবস্থান। শুধু বরিশাল ও খুলনা বিভাগে এ হার ৫০ শতাংশের কম। বরিশালে দালালে ব্যবহার করেছেন ২৮.৮২ শতাংশ অভিবাসী, এবং খুলনায় এ হার ৪৫.৩৮ শতাংশ।
জরিপে চাকরি বা বসবাসের জন্য বিদেশে যাওয়াকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেসব ব্যক্তি নিজ দেশ ছেড়ে গন্তব্য দেশে ন্যূনতম ছয় মাসের জন্য থাকেন, তাদের আন্তর্জাতিক অভিবাসী বলা হয়।
দালালের সম্পৃক্ততার কারণে খরচ বাড়ে
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দালালরা অভিবাসী কর্মীদের খরচ ব্যাপক বাড়িয়ে দেয়। অথচ এই কর্মীদের সিংহভাগই নিম্ন-আয়ের পরিবারের সদস্য।
জরিপ অনুযায়ী, মোট অভিবাসীদের ৪২.০৯ শতাংশ তাদের অভিবাসন খরচ বেসরকারি কোম্পানি/এজেন্সিগুকে ৩.০৯ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করেছেন। আত্মীয় বা পরিচিতজনের সহায়তায় অভিবাসী হয়েছেন ২.৮ শতাংশ মানুষ।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং আইএলও পরামর্শদাতা আসিফ মুনির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই দালালদের মধ্যে বন্ধুবান্ধব ফ্রেন্ডস এবং পরিবারও আছে। কারণ একদম অপরিচিত মানুষকে কেউ অনেক টাকা দিতে চায় না।
তিনি বলেন, মানুষ যেহেতু বিদেশে যাওয়ার জন্য একপ্রকার মরিয়া হয়ে থাকেন, সেই সুযোগটা দালালেরা নেয়।
আসিফ আরও বলেন, 'অনেক জায়গায় এই টাকা দিতে হয়। তাই অভিবাসন খরচটা বেড়ে যায়। দালাল কিছুটা রাখে, কিছু এজেন্সি পায়, আবার গন্তব্য দেশেও এই টাকার ভাগ যায়।'
কর্মীরা কেন দালালদের শরণাপন্ন হন
মানুষ বিদেশে যেতে কেন দালালদের শরণাপন্ন হন, সে বিষয়ে জানাতে গিয়ে আসিফ মনস্তাত্ত্বিক কারণের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত লোক হওয়ার কারণে বিদেশগামীরা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন। 'তারা মনে করে যে তার খুব বেশি যোগ্যতা নাই, আবার আগে যারা গেছে তারাও খুব বেশি কাজ জানত না। তাই তার ভাবে, আমি যেভাবেই হোক আগে যাই, তারপরে ব্যবস্থা হবে।'
জরিপে উঠে এসেছে, বেশিরভাগ অভিবাসী (৫৩.৯১ শতাংশ) পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ১৮.৯৬ শতাংশ অভিবাসী এসএসসি/সমমান এবং ১০.৭৫ শতাংশ অভিবাসী এইচএসসি/সমমান পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাদের বড় একটি অংশই ঋণ করে অভিবাসন খরচ মেটান।
জরিপে দেখা গেছে, সৌদি আরবে (৩৪.৬৩ শতাংশ) যাওয়া কর্মীরা প্রত্যেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। একইভাবে মালয়েশিয়া (৪২.৩০ শতাংশ) ও বাহরাইনে (৩৮.১০ শতাংশ) যাওয়া অভিবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা করে খরচ করেছেন।
যারা ইতালিতে (৫৩.১২ শতাংশ) অভিবাসী হয়েছেন। তারা জনপ্রতি ৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করেছেন। আর যুক্তরাজ্যে (৩১.২১ শতাংশ) অভিবাসন খরচ ৫ লাখ টাকার বেশি।
অভিবাসন ব্যয়
জরিপে দেখা গেছে, ৫৮.২৪ শতাংশ অভিবাসী অভিবাসন খরচ মেটাতে ঋণের উপর নির্ভর করেন। এই ঋণনির্ভরতা শহরাঞ্চলের (৫১.৮৩ শতাংশ) তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় (৬০.০৭ শতাংশ) খানিকটা বেশি।
ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে। নারীদের (৩৭.৯৮ শতাংশ) তুলনায় পুরুষ অভিবাসীরা (৫৮.৭৪ শতাংশ) অনেক বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন।
ঋণ নেওয়ার হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে (৬৮.৫১ শতাংশ), সিলেটে সবচেয়ে কম (৪৬.৩৭ শতাংশ)।
জরিপে আরও দেখা গেছে, বেশিরভাগ অভিবাসী (যুক্তরাজ্য ও কানাডাগামী বাদে) কর্মসংস্থানের সুযোগ খোঁজেন। এটি মালদ্বীপ (৯৮.০৫ শতাংশ), মালয়েশিয়া (৯৬.৮৬ শতাংশ) ও সৌদি আরবের (৯৪.৫৭ শতাংশ) মতো দেশগুলোতে বিশেষভাবে স্পষ্ট, যেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা বেশি।
নারী অভিবাসীরা গৃহকর্মীর কাজ করতে যান বেশি। বিশেষ করে কুয়েত (৭২.৩৮ শতাংশ), ওমান (৫৫.২২ শতাংশ) ও সৌদি আরবে (৫০.৬৭ শতাংশ) এ কাজ বেশি করতে যান তারা।
দালালরা আইনের আওতায় আসছে
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা আইনি কাঠামোর আওতায় আসছে। নিবন্ধনের মাধ্যমে তারা স্বীকৃতি পাবে—এমন বিধান করে জাতীয় সংসদে গত সেপ্টেম্বরে 'বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী (সংশোধন) বিল-২০২৩' পাশ হয়েছে। বিল পাসের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় সদস্যরা প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও প্রতারণার চিত্র তুলে ধরেন। আদম ব্যবসায়ীরা (রিক্রুটিং এজেন্সি) সাধারণ মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে নিঃস্ব করে ফেলছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
নিবন্ধন ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বল্রন, 'দালালদের স্বীকৃতি কীভাবে দেবে, সেটা হচ্ছে কথা। মনিটরিং কিংবা রেজিস্ট্রেশন, কোনো ধরনের সেটআপই উপজেলা পর্যায়ে নেই। জেলা পর্যায়ে থাকলেও বিদেশগামীরা কি সে পর্যন্ত গিয়ে কিছু করবেন? কারণ উপজেলা পর্যন্ত যেতেও তাদের অনাগ্রহ।'
দালালদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা জরুরি বলে উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, 'ইউনিয়ন পর্যায় বা ইউএনেও অফিসের সংশ্লিষ্টতা জরুরি।'
একটি শক্তিশালী অনলাইন সিস্টেম গড়ে তুললে দালালরা বেশি টাকা নিতে পারত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা রোজানা রশীদ টিবিএস বলে, অভিবাসীদের দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তারা বিদেশে নিজেরাই কাজ খুঁজে নিতে পারেন এবং স্বল্প-দক্ষ কাজে ঢুকে শোষণের শিকার না হন।