বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১.১৩ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প
চট্টগ্রামে দেশের বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে মাল্টিমোডাল সংযোগসহ লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য ১.১২৭ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
বেজা কর্মকর্তাদের মতে, প্রকল্পটির লক্ষ্য শিল্পনগরটিকে একটি জলবায়ু-সহনশীল স্মার্ট শিল্পাঞ্চলে রূপান্তরিত করা। একইসঙ্গে এটিতে থাকবে অবকাঠামো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা। এসবের মধ্যে রয়েছে বিস্তৃত সড়ক সংযোগ, জেটিসহ একটি লজিস্টিক হাব, ইউটিলিটি অবকাঠামো এবং একটি ইন্টেলিজেন্ট পরিবহন ব্যবস্থা।
বেজার লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে লজিস্টিক উন্নয়নের এ কার্যক্রম সম্পন্ন করা। তারপর থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীতে অবস্থিত শিল্পাঞ্চলটি সম্পূর্ণরূপে চালু হবে।
তবে অর্থনৈতিক অঞ্চল বা বিসিকের মতো নির্ধারিত এলাকার বাইরের কারখানাগুলো আর ইউটিলিটি সংযোগ ও ব্যাংকিং পরিষেবা পাবে না — সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর আরও ছয়বছর পুরোপুরি চালু হবে না, তাই সরকারি এ সিদ্ধান্তে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিল্পাঞ্চলটিতে লজিস্টিক সুবিধা স্থাপনে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের পরে বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাটি এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। এ দুই কাজেও বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শিল্পনগরটিতে তিনটি জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। একটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ নির্মাণ করবে, অন্য দুটি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে।
'এর জন্য আমরা আলাদাভাবে কিছু জায়গা সংরক্ষণ করে রেখেছি। যেখানে জেটির পাশাপাশি কনটেইনার টার্মিনাল থাকবে। রেলপথ, সড়ক ও সমুদ্রপথ নিয়ে মাল্টিমোডাল সংযোগ সুবিধা থাকবে,' তিনি জানান।
তিনি বলেন, মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে। 'আমরা শিল্পনগরীর লজিস্টিক হাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে সম্মতি জানিয়েছে।'
বেজার কর্মকর্তারা বলেন, মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে শিল্পাঞ্চলটিতে স্থাপিত জেটিগুলো চট্টগ্রাম বন্দরসহ অন্যান্য বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগের সুবিধা তৈরি করবে। এছাড়া রেল ও সড়ক সংযোগ শিল্পাঞ্চলটিকে ঢাকা–চট্টগ্রাম রেলপথ ও মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করবে।
উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থায়ন
প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুসারে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ১.০২৫ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হবে।
আগামী বছরের মধ্যে সমীক্ষাসহ প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করার পর লজিস্টিকে বিনিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্য রয়েছে বেজার।
বেজার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, প্রকল্পটি গ্রহণের অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
কেন লজিস্টিক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ?
প্রায় ১৩৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার সমান ৩৩ হাজার ৪০৭ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বেজা ইতোমধ্যে ১৬ হাজার ৭২৯ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে এবং ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে।
বেজা এখন পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলটিতে ১৫২টি ইউনিটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এর জন্য এটি সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ২৫১ একরের বেশি জমি বরাদ্দ দিয়েছে। কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই ১.২৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
আর এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মাধ্যমে সাত লাখ ৭৫ হাজার ২২৮ জনের কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রকল্পের নথি অনুসারে, পরিবেশগত সহনশীলতার প্রতি বেজার অঙ্গীকার এ প্রকল্পের মূল ফোকাস হবে। শিল্পনগরটিতে পরিবেশবান্ধব নকশা ও নির্মাণচর্চা, সবুজ ও জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো, উপযোগিতা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরকে স্মার্ট, প্রতিযোগিতাসক্ষম, দক্ষ, টেকসই করে তোলা এবং এর পরিবেশগত ফুটপ্রিন্ট ন্যূনতম রাখা বেজার লক্ষ্য।
এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায় বেজা। এক ছাতার নিচে বিস্তৃত পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে নির্ধারিত এলাকার মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সংগঠিত করতে সরকারের কৌশলের অংশ এটি।
প্রাথমিকভাবে বেজা ২০৩০ সালের মধ্যে এই ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু এ সময় সংশোধন করে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত বেজা ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে বেসরকারি খাতের ৮টিসহ মোট ১১টি অঞ্চল ইতোমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে।
বেজার পদক্ষেপকে স্বাগত বিনিয়োগকারীদের
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগের কথা বিবেচনা করছে। বহুজাতিক কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, শিল্পাঞ্চলে একটি লজিস্টিক হাব প্রতিষ্ঠিত হলে সব কোম্পানির পণ্য লোড-আনলোডের সময় কমে যাবে।
'সমুদ্র, সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের সুবিধা হবে। এতে কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়বে। পণ্য সরবরাহের লিড টাইম [ক্রয় আদেশের পর থেকে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়] কমে যাবে। লজিস্ট্রিক হাবের সুবিধা যেন দ্রুত পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অপরূপ চৌধুরী বলেন, লজিস্টিক হাব ব্যবসায়িক কার্যক্রম সহজ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একটি উন্নত পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তুলতে অবদান রাখবে এটি।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিনিয়োগ এখন শিল্পাঞ্চলে প্রবাহিত হচ্ছে, যার জন্য লজিস্টিক উন্নয়ন প্রয়োজন।
'কিন্তু এ উন্নয়ন অবশ্যই ত্বরান্বিত করা উচিত, এবং এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো বিলম্ব করা উচিত নয়,' তিনি আরও বলেন।
সাম্প্রতিক বাজেট বক্তৃতায় আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, 'বিশ্বমানের প্রযুক্তিভিক্তিক, সময় ও ব্যয়সাশ্রয়ী, দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব লজিস্টিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে টেকসই ও অভীষ্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয় লজিস্টিকস নীতি ২০২৪ অনুমোদিত হয়েছে।'