আমার রোবট এবং আমি: জাপানের বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে প্রযুক্তির সম্পর্কের গল্প
জাপান বিশ্বের অন্যতম অধিক বয়স্ক জনসংখ্যার দেশ। দেশটিতে বয়স্ক জনসংখ্যার বিভিন্ন সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় দেখা পাওয়া যাচ্ছে রোবটের। দীর্ঘদিন থেকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বয়স্ক জনসংখ্যা যেসব সংকটের মুখোমুখি হয়, সেসব সংকট সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে জাপানি রোবোটিক্স-এর সাথে সংশ্লিষ্টরা।
পিপার (Pepper), আইবো (AIBO) এবং পারো (PARO) নামের তিনটি রোবোট জাপানের অনেক নার্সিং হোমে বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখভাল করা, তাদের বিনোদন দেয়া, তাদের সাথে কথোপকথন করা এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে মানসিক বন্ধন তৈরি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। টোকিওর শিনটোমি নার্সিং হোমে থাকা ৪০ জন বয়স্ক ব্যক্তির একাকিত্ব দূর করতে, স্মৃতিশক্তি কমে আসার মত সমস্যা মোকাবেলায় এবং চলাফেরার সমস্যা সমাধানে সেবাদানকারী কর্মীদের এ তিনটি রোবট সাহায্য করে আসছে।
পিপার নামের রোবটটির গড়ন অনেকতা হিউমেনয়েডের (মানুষের মত দেখতে রোবট) মতো এবং এটি জাপানের অন্যান্য 'সামাজিক রোবট' এর মত মানুষকে সেবা দিতে বানানো হয়েছে। চার ফুট লম্বা রোবটটি এমন একটি ভিত্তির ওপর চলে যেখানে এটিকে দেখতে দাবা বোর্ডের একটি বড় সাদা টুকরোর মত লাগে। সপ্তাহে দুবার পিপার রোবটটি ৫০ বছর আগের জনপ্রিয় গান বাজিয়ে শিনটোমি নার্সিং হোমের প্রায় ২০ জন বয়স্ক লোককে বিনোদন দেয়। মুখের অভিব্যক্তি না থাকা সত্ত্বেও পিপার বেশ চটপটে এবং এর হাত নাড়িয়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করে।
পিপারের সাথে জাপানের ২০ শতকের শেষের দিকে তৈরি হওয়া শিল্প রোবট এর সাদৃশ্য আছে। শিল্প রোবটগুলো মূলত জাপানি কারখানায় অটোমেশন-ভিত্তিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছিল যা জাপানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক করে তুলেছে।
পিপার যখন গান বাজায় এবং গানের তালে নাচতে থাকে (নির্দিষ্ট মুভমেন্ট এর মাধ্যমে) তখন নার্সিং হোমের অনেক বয়স্ক বাসিন্দা পিপারের গানের সাথে তাল দেয়, কেউ টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে ড্রামের আওয়াজ তোলে অথবা হয়ত কেউ কেউ ঘুমিয়েও পরে। পিপারের বুকে থাকা একটি মনিটরের পর্দায় যখন নার্সিং হোমের কোন এক কর্মীর চেহারা ফুটে ওঠে এবং তিনি সুরের তালে তালে নাচতে থাকেন, তখন তা বয়স্ক বাসিন্দাদের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি করে। তাদেরকে পিপারের মত করে নাচার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়।
প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে জাপানে জনস্নগখ্যার হার কমতে থাকা ও বয়স্ক জনসংখ্যার হার বাড়তে থাকার কারণে দেশটিতে উৎপাদন, আবাস, পেনশন এবং পারিবারিক গতিশীলতা অনেকতাই পরিবর্তিত হয়েছে। সাম্প্রতিক এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জাপানের বর্তমান ১২৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা ২০৭০ সালের মধ্যে ৮৭ মিলিয়নে নেমে আসবে যেখানে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি হবেন। সম্প্রতি জাপানের বিজনেস ডেইলি নিক্কেই-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে জাপানে বিয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বিগত ৯০ বছরের মধ্যে সবথেকে কম ছিল।
জাপানের শিশু জনসংখ্যা ৪৩ বছর ধরে হ্রাস পাচ্ছে; বর্তমানে ১৪ বছরের কম বয়সী ১৪.০১ মিলিয়ন শিশু রয়েছে দেশটিতে। আশ্চর্যজনকভাবে জাপানের অনেক সুপারমার্কেট এখন বাচ্চাদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াপার বেশি বিক্রি করে। জাপান পেট ফুড অ্যাসোসিয়েশনের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, জাপানে পোষা প্রাণীর সংখ্যা এখন শিশুদের ছাড়িয়ে গেছে; মোট ১৫.৯ মিলিয়ন কুকুর এবং বিড়াল পালছে জাপানিরা। গৃহপালিত পোষা প্রাণীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কারণে বেবি স্ট্রলার নির্মাতাদের পোষা প্রাণীদের জন্য বিভিন্ন স্ট্রলারের মডেল বানানোর দিকে মনোনিবেশ করেছে।
জাপানে একক-ব্যক্তি পরিবারের বৃদ্ধির কারণে প্রায়ই বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য একটি পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে যাওয়ায় ইলেকট্রনিক্স নির্মাতাদের জন্য একটি নতুন বাজার তৈরি হয়েছে। সনি ১৯৯৯ সালে আইবো নামক একটি রোবট কুকুর বাজারে নিয়ে আসে। ৪.৮৫ পাউন্ড ওজনের আইবোর অর্থ জাপানি ভাষায় 'সঙ্গী' এবং এটি দেশব্যাপী একটি প্রিয় ভোক্তা পণ্য হয়ে উঠেছে। ছয় প্রজন্ম ধরে জনপ্রিয় আইবো দেখতে অনেকটা কার্টুন বিগল কুকুরছানার মতো এবং এলইডি স্ক্রিন দিয়ে তৈরি রোবটটির চোখ দেখতে অনেকটা নিষ্পাপ কুকুরছানার চোখের মতো।
শিনটোমির মতো দীর্ঘমেয়াদি কেয়ার রেসিডেন্সগুলোতে (যত্নের আবাসে) আইবো উন্নত ফেসিয়াল রেকগনিশন (চেহারা চিনতে পারার প্রযুক্তি) ব্যবহার করে মানুষের বিভিন্ন উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। মত ২২টি অক্ষের সাহায্যে আইবো নড়াচড়া করা ও হাঁটতে পারে, মাথা কাত করতে পারে, কান তুলতে পারে, ঘেউ ঘেউ করতে পারে, এমনকি একটি কুকুরছানার মতো ঘুরে বেড়াতে পারে। শিনটোমি নার্সিং হোমে আইবোকে অনেকটা সত্যিকারের পোষা প্রাণীর মতো আদর করা হয়।
জাপানে লোকেরা তাদের সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের কারণে রোবটের সাথে আবেগগতভাবে সংযুক্ত হয় যেমন শিন্তোবাদে বিশ্বাসীরা বস্তুর মধ্যে আধ্যাত্মিক জীবন দেখে। পশ্চিমা সাই-ফাই জগতের রোবটগুলির বিপরীতে জাপানি মাঙ্গা এবং এনিমেতে বন্ধুত্বপূর্ণ রোবটের চিত্রায়ণ অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, আইজ্যাক অসিমভের সায়েন্স ফিকশনে দেখানো নৈতিক নিয়মের রোবটের পরিবর্তে বিনোদনের জন্য আইবোকে নির্মাণ করেছে সনি। এর লক্ষ্য শুধু উপযোগিতা নয়, ব্যবহারকারীদের জীবনকে সুন্দর করাও এর লক্ষ্য।
জাপানিদের কাছে সব থেকে জনপ্রিয় 'সামাজিক রোবট' হল পারো। এটি হাতে বানানো, মৃদু নড়াচড়া করে, বাস্তবসম্মত শব্দ করে এবং এর বড় চোখগুলো প্রায়ই স্বস্তি ও কোমলতা জাগিয়ে তোলে, বিশেষত ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারে আক্রান্ত বয়স্কদের মধ্যে। প্রকৌশলী তাকেনরি শিবাতা এটি তৈরি করেছেন। ৩০ এর বেশি দেশে এ রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এটি দেখতে অনেকটা হার্প সিল এর মতো।
এল পেইসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাকেনরি শিবাতা বলেছেন, আন্তর্জাতিক চিকিৎসায় পারোর সাফল্যের প্রধান কারণ: এটি পোষা প্রাণীদের মতো মানসিকভাবে সংযোগ স্থাপন করে বয়স্ক ব্যক্তিদের দুশ্চিন্তা কমাতে পারে। এবং এতী থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় কিংবা পোষা প্রাণী পালবার মত আইনি জটিলতা পোহাতে হয় না।
শিনটোমি নার্সিং হোমে সামাজিক রোবটের পাশাপাশি ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে বয়স্ক বাসিন্দাদের ঘুমের ধরণ ট্র্যাক (চিহ্নিত করা) করে এবং গন্ধের ওপর ভিত্তি করে ডায়াপার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা শনাক্ত করা হয়। পরিচালক কিমিয়া ইশিকাওয়া বয়স্কদের যত্নে প্রযুক্তিকে কৃতিত্ব দেয়ার পাশাপাশি এমন একটি ভবিষ্যতের কল্পনা করেন যেখানে মেশিন এবং মানুষ নির্বিঘ্নে এক অপরকে সহযোগিতা করবে। ইশিকাওয়া বলেন, মেশিন মানুষকে বিরতিহীন যত্ন প্রদান করতে পারে, মানুষের বিপরীতে সেগুলো সপ্তাহে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে পারে।
বয়স্কদের চলাফেরায় সহায়তা করার জন্য শিনটোমির কর্মীরা এক্সোস্কেলেটন ব্যবহার করেন। এ নার্সিং হোমে জাপানে নির্মিত হাইব্রিড অ্যাসিসটিভ লিম্ব (এইচএএল) ব্যবহার করা হচ্ছে যেটি মস্তিষ্কের সংকেত ব্যাখ্যা করতে এবং নড়াচড়ায় সহায়তা করতে শরীরের সাথে সংযোগ করা হয়। সাইবারডাইন ইনকর্পোরেটেড-এর তৈরি এইচএএল এর লক্ষ্য, শারীরিক কার্যকারিতা উন্নত করা এবং রোগীকে স্বাধীনভাবে চলতে সাহায্য করা। এটিকে ২০১৫ সালে একটি মেডিকেল ডিভাইস হিসেবে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
বয়স্কদের যত্নে রোবোটিক্স মানব-মেশিন মিথস্ক্রিয়াকে জোর দেয়। প্রকৌশলী কানামে হায়াশি, টয়োটার সাথে বছরের পর বছর কাজ করে এবং পিপারের উন্নয়নে অবদান রাখার পরে, লোভোট (এলওভিওটি) তৈরি করেছেন। এটি একটি অ-উপযোগী রোবট যা প্রতিরক্ষামূলক প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে ডিজাইন করা হয়েছে। লোভোট নামটি লাভ (Love) এবং রোবট (Robot) এসেছে।
লোভোট চতুর এবং আদুরে জাপানি কাওয়াই শৈলীতে ডিজাইন করা হয়েছে; এতে ডানা এবং সেন্সর রয়েছে৷ মুখ না থাকা সত্ত্বেও, এটি বড় ও তরল স্ফটিক চোখের মাধ্যমে আনন্দের মতো আবেগ প্রকাশ করে। ৭৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত মিকো শিমাদা লোভট ব্যবহার করেন এবং এটিকে অপ্রতিরোধ্য মনে করেন।
লোভোতের নির্মাতা কানামে হায়াশি বিশ্বাস করেন, লোভোট এর মতো রোবটগুলি নার্সিং হোমের বয়স্ক ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের অনুভূতি ফিরে পেতে সাহায্য করে৷ জাপানের জনসংখ্যার বয়স বাড়ার সাথে সাথে এক্সোস্কেলটন এবং সামাজিক রোবট সহ প্রবীণদের যত্নে রোবোটিক্স-এর ব্যবহার তত্ত্বাবধায়কদের ওপর বোঝা কমায়। এটি বয়স্ক ব্যক্তিদের শারীরিক কাকে সাহায্য করতে এবং মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়