জুলাই গণঅভ্যুত্থান যেভাবে দেশের জরুরি চিকিৎসা সেবার দৈন্যদশা ফুটিয়ে তুলেছে
আন্দোলনে এক হাত হারানো সেই ছেলেটির কথা মনে আছে? যিনি হাসপাতালের বিছানায় হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'দেশের জন্য আরেকটি হাত হারাতেও রাজি আছি!'
১৯ বছর বয়সী ওই ছেলের নাম আতিকুল ইসলাম। তিনি গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিন পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে একে একে পাঁচটি স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কোথাও তিনি চিকিৎসা পাননি। এমনকি ছেলেটির হাত থেকে গুলি বের করার পর দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা তিনি কোনো চিকিৎসা পাননি।
সবশেষে তাকে নেওয়া হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, আতিকের হাত জীবাণুতে আক্রান্ত হয়েছে। তাই সেটি কেটে ফেলতে হবে। এ কারণে আতিককে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ট্রমাটোলজি অ্যান্ড অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশনে (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) পাঠানো হয়। সেখানে ৭ আগস্ট তার হাত কেটে ফেলা হয়।
গত ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলো হাজার হাজার আহত বিক্ষোভকারীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিল, যার বেশিরভাগই বিনামূল্যে। যদিও এক্ষেত্রে প্রায়ই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীদের বিরোধিতা ছিল।
হাসপাতালগুলোর ভূমিকা প্রশংসিত হলেও বাস্তবতা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা গুরুতর আহতদের চিকিৎসা করতে পারেনি। এক্ষেত্রে সেসব রোগীদের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ফলে এক কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে তাদের অক্ষমতার কারণে শহরের কয়েকটি বড় হাসপাতালে আহত বিক্ষোভকারী ও নিহতদের মরদেহ নিয়ে আসতে থাকায় চাপ সৃষ্টি হয়, যা সেসব হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও কঠিন করে তোলে।
এ ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে দেশের জরুরি অবস্থায় ও বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবা কতটা অক্ষম।
অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব, মব জাস্টিসের ভয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হয়রানি ইত্যাদির কারণে দুর্ঘটনার আহত ব্যক্তি দ্রুত জরুরি চিকিৎসা পান না। এতে প্রায়শই অনেকে মারা যান কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারান।
এ চিত্র কেবল শহরের হাসপাতালেরই নয়, বরং উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোরও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জরুরি চিকিৎসা সেবার অবস্থা আমাদের দেশে সাধারণত বেশ দুর্বল। স্থানীয় হাসপাতালে বিশেষ করে ৪৮০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগ রয়েছে। কিন্তু এগুলো সক্ষমতা, লোকবল ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সবদিক থেকেই খুব সাধারণ।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্যদিকে এসব হাসপাতালের মেডিকেল অফিসাররা খুব কম বয়সী ও স্বল্প অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। সীমিত সরঞ্জাম, জায়গার অভাব ও জীবাণুমুক্ত করার সুবিধারও ঘাটতি রয়েছে।'
ফলে গুরুতর আঘাত বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঘটনা সামাল দেওয়া তাদের জন্য বেশ কঠিন। এছাড়াও গত দুই দশকে এমন একটা প্রবণতা বেড়েছে যে, জরুরি বিভাগে রোগীরা মারা গেলে রোগীর আত্মীয়রা সহিংস হয়ে ওঠেন এবং 'মব জাস্টিস'ও করে থাকেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর হামলা হয়। জরুরি বিভাগে ভাঙচুর করা হয়।
বে-নজির আহমেদ বলেন, 'তাই চিকিৎসকদের মধ্যে ইমারজেন্সি রোগীদের বড় হাসপাতালে পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে চেতনানাশক বা শল্যচিকিৎসকের অভাবের কারণে এ ধরনের চিকিৎসা সুবিধায় রক্ত সঞ্চালন কিংবা অস্ত্রোপচার করা যায় না।'
ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেন, 'ঢাকার ছোট বেসরকারি ক্লিনিকগুলো সব একই রকম। তারা তাদের খরচ বাঁচাতে চায়। এক্ষেত্রে তারা তরুণ চিকিৎসকদের নিয়োগ করে। সেখানে সুযোগ-সুবিধাও কম।'
এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন, বড় হাসপাতালগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থায় রয়েছে৷ সেখানে ইমার্জেন্সি কেয়ারে ডিগ্রিপ্রাপ্ত কনসালটেন্টও রয়েছে।
বেসরকারি ক্লিনিকগুলিতে ইমারজেন্সি কেয়ারের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বাধা হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রায়ই অপরাধের সাথে জড়িত আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ও ক্ষতিগ্রস্তদের আহতদের সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য জেরা করে থাকে। ফলে হাসপাতালগুলো প্রায়শই এ ধরনের মামলা এড়াতে এসব রোগীদের সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বলে।
২০২১ সালে হাইকোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকেরা যেন তাদের কাছে আসা প্রতিটি রোগীকে জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। যদিও ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো এখনও নানা কারণে ইমারজেন্সি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে।
গত ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ ও এর আশেপাশের এলাকা বিক্ষোভকারীদের ও সরকারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। সেদিন মিরপুর-১০ এর একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডা. আব্দুল হামিদ ১৯ জুলাই ডিউটিতে ছিলেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমরা নিহতদের শরীর থেকে যতটা সম্ভব গুলি বের করেছি। আমাদের তাদের সরকারি হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল।'
অন্যদিকে মেডিকেল কলেজগুলো জরুরি পরিস্থিতিতে সেবা প্রদানের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। একইসাথে তাদের রয়েছে অন্যান্য বিভাগও। তাই গুরুতর অবস্থায় থাকা রোগীদের এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বা কিছু ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়।
যেমন, দিনাজপুর ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ওই অঞ্চলের মানুষের সচরাচর গন্তব্য। ঢাকা বিভাগের লোকেরা একইভাবে সব চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'নিমতলী অগ্নিকাণ্ড ও এর মতো আরও অনেক ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসায় ঢামেকই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এছাড়াও তালিকায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটাল ফর হেড/নিউরোলজিক্যাল ইনজুরি ও মুগদা হাসপাতাল রয়েছে।'
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, 'প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি সেবার উন্নতির জন্য আমাদের গুরুত্ব সহকারে পরিকল্পনা করতে হবে। এভাবে সড়ক দুর্ঘটনার মতো আহতদের মৃত্যু কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জরুরি অবস্থায় কর্মরত কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।'
বিশেষজ্ঞের মতে সক্ষমতা বাড়ানো হলে ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে দেশের জরুরি চিকিৎসা সেবার পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে সেবার চাহিদা অত্যন্ত বেশি বলে তারা মনে করেন। একইসাথে ঘনবসতি হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেশি।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'সক্ষমতা বাড়ানো হলে তা মৃত্যুহার ও রোগে ভুগতে থাকা ব্যক্তির সংখ্যা কমাতে সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই বিদ্রোহের গুলিবিদ্ধ রোগীদের অনেকেরই তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিংবা হাত বা পা হারিয়েছিল। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হলে এদের পঙ্গুত্ব এড়ানো যেত। এই পঙ্গুত্ব এখন ভুক্তভোগীদের জীবন ওলট-পালট করে দেবে।'
এক্ষেত্রে আমরা জানতে চেয়েছি যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে বেসরকারি চিকিৎসকদের জন্য কি আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা দরকার? ডা. আহমেদ এ বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন।
তিনি বলেন, 'যদি একজন ডাক্তারের বিএমডিসি সার্টিফিকেট থাকে থাকে, তবে তিনি ক্ষতিগ্রস্তকে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে পারবেন। কিন্তু যেহেতু তারা ময়নাতদন্ত করেন না, তাই তারা গুরুতর আহতদের মধ্যে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা কম তাদের সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।"
তবে বে-নজির আহমেদ বলেন, 'হাসপাতালগুলোর এখন আগের চেয়ে আরও বেশি ইমারজেন্সি সেবা রয়েছে। একইসাথে স্বাভাবিক সময়েও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কাজ করা উচিত। যাতে করে সবসময় দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হলে মানুষ গণহারে মারা যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ফিল্ড হাসপাতালকে কোথায় স্থাপন করবে ইত্যাদির গাইডলাইন ও প্রস্তুতি থাকা উচিত। এছাড়াও চিকিৎসা সম্পর্কিত জিনিসপত্রের একটি আলাদা স্টক তৈরি করা দরকার।'
বে-নজির আহমেদ জানান, সশস্ত্র বাহিনীর মাঝে এমন প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু পাবলিক হেলথের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা করা হয় না। দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা খুবই কম। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো কার্ডিয়াক অপারেশন, পেডিয়াট্রিক কেয়ার, ডায়াগনস্টিক সেবাসহ দিনে ২৪ ঘণ্টা ও সপ্তাহে ৭ দিনের জরুরি সেবার বিষয়টি প্রচার করে৷ তবে প্রকৃতপক্ষে তারা স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা চাওয়ার বিষয়টি পূরণ করে থাকে। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আসলে তাদের মাঝে কোনটি অনুপস্থিত?
সাবেক এই ডিজিএইচএস ডিরেক্টর বলেন, 'প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর ইনডোর ও আউটডোর স্বাস্থ্য পরিষেবা রয়েছে। কিন্তু ইমারজেন্সি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তারা দুর্বল। জরুরি পরিস্থিতিতে তারা শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে ও রোগীদের অন্যান্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।'