আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ আর্থিক সিদ্ধান্ত: শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা
প্রত্যেকেই চায় তাদের আর্থিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত এবং সমৃদ্ধশালী হোক। কিন্তু আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমরা সবসময় সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি না।
আমি একজন পার্সোনাল ফাইন্যান্স বিশেষজ্ঞ হিসেবে বারবার এ বিষয়ে কথা বলেছি, তবুও আমার জীবনেও এমন একটি ভুল আর্থিক সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা আমাকে এবং আমার আর্থিক অবস্থাকে বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এটি আমার জীবনের একমাত্র ঘটনা নয়, তবে এটি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১০ সালের দিকে আমি একটি স্থিতিশীল ব্যাংকের চাকরিতে ছিলাম। ব্যাংকের চাকরিটি আর উপভোগ করতে না পারায় ব্যবসা করার জন্য চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই।
সেই সময় শেয়ার বাজারের অবস্থা অত্যন্ত ভালো ছিল। শেয়ারের দাম বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মনে হচ্ছিল এটি কোনোদিনই থামবে না।
তখন শেয়ার বাজারে প্রবেশ করা অনেকেরই স্বপ্ন ছিল, এবং আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। সে সময় আমার একটা জমি ছিল, যেটি ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করে পুরো অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করি।
তখন মনে হয়েছিল, এটি আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্তগুলোর একটি। কিন্তু শেয়ার বাজারের প্রকৃত অবস্থা আমাকে পরে শিখিয়েছে যে, আবেগ এবং লোভ আমাদের বড় ধরনের বিপদে ফেলতে পারে।
শেয়ার বাজারে প্রবেশ: ভুলের শুরু
আমি জমি বিক্রির পুরো টাকাটাই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলাম। কারণ তখন মনে হচ্ছিল যে এ বিনিয়োগের মাধ্যমে কয়েক গুণ বেশি লাভ হবে।
কয়েক মাসের মধ্যেই আমার বিনিয়োগ দ্বিগুণ হয়ে গেল। শেয়ারগুলোর মূল্য এত দ্রুত বাড়ছিল যে আমি শেয়ার বিক্রি করার কথা ভাবিনি।
এর পরপরই একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম: আমি সেই লাভ থেকে শেয়ার বিক্রি না করে আরও বেশি শেয়ার কিনে নিলাম।
তাছাড়া, আমি মার্জিন লোন নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। এর মাধ্যমে আমার আসল বিনিয়োগের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ পেলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে এটি আমার জন্য এক বড় ফাঁদে পরিণত হবে।
ইকোনমিস্ট জার্নালের একটি গবেষণায় (২০১৫) দেখা গেছে, যারা শেয়ার বাজারে আবেগপ্রবণ হয়ে লোন নিয়ে বিনিয়োগ করেন, তাদের প্রায় ৯০% লোক শেয়ার বাজারের মন্দার সময় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হন।
আমার ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছিল। যখন শেয়ার বাজারে পতন শুরু হলো, আমি তখনও শেয়ার বিক্রি করিনি, কারণ মনে করেছিলাম বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
মার্জিন লোন: আর্থিক বিপদের পথে যাত্রা
মার্জিন লোন শেয়ার বাজারের একটি প্রক্রিয়া, যা আপনাকে দ্বিগুণ অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়। এটি বিপজ্জনক, বিশেষ করে যখন শেয়ারের দাম কমতে থাকে।
শেয়ার বাজারে মন্দার সময় আমার পোর্টফোলিওর দাম কমতে শুরু করে, এবং এক সময় আমার আসল বিনিয়োগ প্রায় হারিয়ে যায়। শুধু মার্জিন লোনের বোঝা থেকে যায়।
মার্জিন লোনের ফাঁদে পড়া আমার জীবনের একটি বড় শিক্ষা ছিল। ফিনান্সিয়াল টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনে (২০১২) বলা হয়েছে, "শেয়ার বাজারে মার্জিন লোন নেওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক, বিশেষ করে যখন বাজারে অস্থিতিশীলতা থাকে।"
আমার পক্ষে সে সময় লোনের বোঝা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আমি এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম, যেখানে শেয়ার বিক্রি করলেও লোন শোধ করা সম্ভব ছিল না।
সিদ্ধান্তের ফলাফল: কী ভুল ছিল?
এ পুরো ঘটনার পর আমি উপলব্ধি করেছি যে, আমার কয়েকটি বড় ভুল ছিল।
প্রথমত, জমি বিক্রি করে পুরো অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা ছিল মারাত্মক ভুল। শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তা এমন যে, আমরা কখনই জানি না বাজার কখন মন্দায় যাবে।
দ্বিতীয়ত, শেয়ারের দাম বাড়ার পর তা বিক্রি না করাটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। লোভের কারণে আমি শেয়ার বিক্রি করিনি, কারণ মনে হয়েছিল দাম আরও বাড়বে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফাইন্যান্স-এর গবেষণায় (২০১৮) বলা হয়েছে, "বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই লোভের কারণে সময়মত শেয়ার বিক্রি করেন না, যা তাদের বড় ধরনের ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়।"
তৃতীয়ত, মার্জিন লোন নেওয়া আরেকটি বড় ভুল ছিল। মার্জিন লোন আপনাকে উচ্চ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়, কিন্তু শেয়ারের দাম কমতে শুরু করলে তা আপনাকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে।
গোল্ডম্যান স্যাচস-এর এক প্রতিবেদনে (২০১৬) বলা হয়েছে, "মার্জিন লোনের কারণে বিনিয়োগকারীরা মন্দার সময় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন।"
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা: কীভাবে আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত?
এ ভুল থেকে আমি শিখেছি যে, কোনো একক খাতে সব টাকা বিনিয়োগ করা উচিত নয়। বিভিন্ন সম্পদের মধ্যে বিনিয়োগ ভাগ করে নেওয়া উচিত, যেমন জমি, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকের এফডিআর, এবং শেয়ার বাজার। এতে কোনো একটি বাজারে মন্দা এলেও আমাদের পুরো অর্থ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
দ্বিতীয়ত, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের সময় আমাদের লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শেয়ারের দাম বাড়তে থাকলে কিছু শেয়ার বিক্রি করে তা নিরাপদ জায়গায় রাখা উচিত।
ফরচুন ম্যাগাজিন-এর প্রতিবেদনে (২০২০) বলা হয়েছে, "বিনিয়োগকারীদের উচিত শেয়ার বাজারে লাভ হলে কিছু মুনাফা তুলে নেওয়া, যা ভবিষ্যতের মন্দার সময় তাদের রক্ষা করতে পারে।"
তৃতীয়ত, মার্জিন লোন নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা আবশ্যক। মার্জিন লোন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, তাই এটি নেওয়ার আগে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা উচিত।
আমার সবচেয়ে খারাপ আর্থিক সিদ্ধান্ত আমাকে শিখিয়েছে যে, আবেগ এবং লোভ আমাদের বড় ধরনের আর্থিক বিপদে ফেলতে পারে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ অবশ্যই লাভজনক হতে পারে, তবে তা করতে হবে জ্ঞান, সতর্কতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করতে পারে।
সাইফুল হোসেন: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।