বর্ষা শেষ, ডেঙ্গু এখন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে?
বর্ষা ঋতু শেষ হলেও এবং বৃষ্টিপাত কম থাকলেও বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তাদের ধারণা, অক্টোবরের শেষের দিকে রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে।
তারা ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃষ্টিপাত কমলেও নগর কর্তৃপক্ষ এখনও মশা ও লার্ভা নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এডিস মশার লার্ভা এখন শহরের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বেড়ে উঠছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এ মাসের প্রথম ১৬ দিনের মধ্যে ১৫ হাজার ১২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৬৩ জন মারা গেছেন।
সেপ্টেম্বরে, ১৮ হাজার ৯৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ৮০ জন মারা গেছেন।
১ জানুয়ারি থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫ হাজার ৯৫০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এবং ২২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বৃষ্টি ও তাপমাত্রাকে ডেঙ্গু রোগের বৃদ্ধির পেছনে প্রধান দুটি কারণ হিসেবে ধরা হয়। তাহলে বর্ষাকাল শেষ হওয়া সত্ত্বেও কেন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে?
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার টিবিএসকে বলেন, 'দেশের প্রায় সব জায়গায় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির ওপরে রয়েছে, যা এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। এ মশার জীবনকাল ২০ থেকে ২৫ দিন। তাই আগামী দিনগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে মশার সংখ্যাও বাড়ছে এবং সেগুলো মানুষকে কামড়ে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'ডেঙ্গুর মৌসুম নভেম্বর ও ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে। প্রাদুর্ভাব এখনো চরমে পৌঁছায়নি, তবে ধীরে ধীরে কমার আগে এটি আগামী সপ্তাহে শীর্ষে উঠতে পারে। এ বছরের পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় বেশি গুরুতর।'
তিনি জনগণকে সিটি কর্পোরেশনের ওপর নির্ভর না করে নিজেদের সুরক্ষার জন্য ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
ঢাকা উত্তর সিটির ডেপুটি চিফ হেলথ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রুবায়েত ইসমত অভিক টিবিএসকে বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কিছু বিত্তশালী এলাকার বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। আমরা নিয়মিত লার্ভিসাইডিং ও ফগিং পরিচালনা করছি।'
'এর পাশাপাশি আমরা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ঠিকানার ভিত্তিতে তাদের বাড়িতে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালাচ্ছি। আশা করছি, ঢাকা উত্তরে কয়েক দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে,' তিনি যোগ করেন।
ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, 'ঢাকা দক্ষিণ সিটির দু-একটি এলাকা বাদে অধিকাংশ এলাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত বছর কিছু নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বেশি রোগী পাওয়া গেছে, তবে এবার ডেমরা এলাকায় কেস বেড়েছে। আমরা সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালাচ্ছি।'
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে
বুধবার (১৬ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন এক হাজার ১৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বরিশাল বিভাগের একজন ও ঢাকা উত্তর সিটির দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন।
এ বছর ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে ১১৮ জন ও উত্তর সিটিতে ৩৪ জন ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগে আট হাজার ৭০৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন ও ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল বিভাগে তিন হাজার ৯৮০টি ডেঙ্গু কেস ও ২৭ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। বর্তমানে দেশের আটটি বিভাগেই মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, এবং প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।
জেলাগুলোর মধ্যে কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ৬৮৪ জন। নরসিংদীতে এক হাজার ৩১৮ জন, চট্টগ্রামে এক হাজার ২০০ জন এবং বরগুনায় এক হাজার ১১১ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সর্বোচ্চ ৪৪ জনের মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ২৮ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৮ জন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জন মারা গেছেন।
২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ দেখা দেয়। তখন পাঁচ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। রোগীদের ৭১ শতাংশই ছিল ঢাকা শহরের, বাকিরা দেশের অন্যান্য শহরের।
প্রাথমিক সেই প্রাদুর্ভাবের পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমেছিল। কিন্তু বর্তমানে সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।