রোগীদের বিদেশমুখীতা ঠেকাতে সম্পদের ব্যবহার, সেবার মান উন্নত করতে হবে: বিশেষজ্ঞরা
দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিভিন্ন জায়গায় উন্নতি প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে– ভুল ডায়াগনোসিস, অপর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রোগীদের ঠিকমত সময় না দেওয়া, সেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হওয়া, চিকিৎসা ব্যয় বেশি, ক্যান্সারসহ কিছু রোগের অপর্যাপ্ত চিকিৎসা এবং আস্থার সংকটের কারণে উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে বিদেশে যাচ্ছেন রোগীরা।
রোগীদের এই বিদেশমুখীরা ঠেকাতে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এসব সমস্যার সমাধান জরুরি বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী হলে অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ আয়োজিত 'চিকিৎসা সেবা: বিদেশ মুখাপেক্ষিতা থেকে উত্তরণের উপায়' শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা তুলে ধরেন বক্তারা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট ডা. আবু জামিল ফয়সাল।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, "চিকিৎসা নিতে বিদেশমুখীতা কমাতে বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজ্ড হাসপাতাল পুরোদমে চালু করতে কাজ করছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। এছাড়া, প্রাথমিকভাবে ৩ থেকে ৪টি রোগকে টার্গেট করা হয়েছে, এসব রোগের জন্য যাতে বিদেশে যেতে না হয়, সেভাবে হেলথ সিস্টেমকে প্রস্তুত করা হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসায় বিদেশমুখীতা কমাতে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের হাতে প্রযুক্তিসম্পন্ন এবং সবচেয়ে ভালো অবকাঠামো হচ্ছে এই হাসপাতাল।
"সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু করার বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে আনা হয়েছে। আজ (১২ ডিসেম্বর) সেখানে ৬০ জন রোগী ভর্তি আছেন। এটি ৭০০ বেডের হাসপাতাল, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত পুরোদমে এটি চালু করার। রোগীদের বিদেশমুখী হওয়া কমাতে এ হাসপাতাল নেতৃত্ব পর্যায়ে থাকবে বলে আমরা আশাবাদী," যোগ করেন ডা. সায়েদুর রহমান।
তিনি আরও জানান, "ক্যান্সারসহ ৩–৪টি রোগে সাধারণত রোগীরা বিদেশে যান। এসব রোগে আক্রান্ত হলে রোগীরা যাতে দেশেই চিকিৎসা পান, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা থাকে। সরকারের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো হবে। বেসরকারি উদ্যোগগুলোর জন্য সাপোর্টিভ হওয়ার কৌশলও বের করার চেষ্টা করা হবে।"
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ব্রিগেডিয়ার জে. (অব.) মামুন মোস্তাফি বলেন, "আস্থার অভাবে আমাদের রোগীর ভারতে যান। ভালো ব্যবহার ও ভালো চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এ দুটো বিষয় যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে সমাধান হবে।"
তিনি বলেন, "সরকারের পক্ষ থেকে যদি এমন নির্দেশনা আসে যে, আগামী ৩ মাস কোনো রোগী খারাপ ব্যবহারের শিকার হবে না, সেটি একটি বিআর পদক্ষেপ হতে পারে। লং টার্মে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজে যদি ভালো ব্যবহার, সিস্প্যাথি-ইম্প্যাথি দিয়ে শেখানো যায়— তাহলে রোগীরা আস্থা পাবেন। কার্ডিওলজি ও নেফ্রোলজিতে আমরা পিছিয়ে নেই। আমাদের ইনফ্রাস্টটাকচার আছে, এখন দরকার কম খরচে আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করা।"
ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম শামীম বলেন, "কোভিডের সময় আমরা সব ধরনের রোগীকে সেবা দিয়েছি। চিকিৎসা সেবায় আমরা ভারতের মতোই সক্ষম। আমাদের এখানে নেগেটিভ পাবলিসিটি বেশি, সেটি একটি সমস্যা।"
জনস্বাস্থ্য ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমএইচ চৌধুরী লেলিন বলেন, "আমরা সত্যি কি চাই, রোগীরা বিদেশে না যাক? তাহলে নিজের আচরণ বদলাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, মন্ত্রী, যুগ্ম সচিবরা দেশে চিকিৎসা নেবেন। যারা দেশের জনগণের জন্য শপথ নিয়ে দায়বদ্ধ হয়েছেন তাদের দেশে চিকিৎসা নিতে হবে।"
তিনি বলেন, "দেশের ৫৫ শতাংশ চিকিৎসা সেবা দেয় বেসরকারি খাত। এই ৫৫ শতাংশের বিকাশ ও নজরদারির দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।"
আইসিডিডিআর,বি-এর বিজ্ঞানী এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, "আমাদের দেশে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে রোগীরা বাজারে গেছেন বলে মনে হয়। রোগীকে এখান থেকে সেখানে ছুটতে হয়। কিন্তু বিদেশে গেলে একটা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর রোগীকে কিছুই করতে হয়না, হাসপাতাল থেকেই সব করে।"
তিনি বলেন, "মেডিকেল ট্যুরিজম ঠেকাতে ১/২ বছর বা ৫ বছরে কী করবো, তা প্ল্যান ও বিনিয়োগ করতে হবে।"
অনুষ্ঠানে আলোচকেরা আরও বলেন, ডাক্তারদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য দায়ী। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মেডিকেল কলেজ ও ডাক্তারদের এই দ্বন্দ্ব থেকে সরে আসতে হবে।