কয়েকটি ব্যাংকের অপরিণত সিদ্ধান্তের কারণে ডলারের দাম বাড়ছে: গভর্নর
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকের অপরিণত সিদ্ধান্তের কারণে ডলারের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। রেমিট্যান্সের ডলারের দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ ১২৭.৭০ টাকায় পৌঁছার পর গতকাল (১৯ ডিসেম্বর) তিনি এ মন্তব্য করেন।
'তাদের [ব্যাংকগুলোর] তো বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা বাজার ও অনিয়মিত লেনদেন পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা শীঘ্রই ফরেক্স মার্কেটকে [বৈদেশিক মুদ্রাবাজার] স্থিতিশীল করব,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
রেমিট্যান্সের ডলারের দাম এক দিনে প্রায় ১ টাকা বেড়ে বুধবারের রেকর্ড ১২৭ টাকাকে ছাড়িয়ে গেছে। সরকার বকেয়া বৈদেশিক পেমেন্ট পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এবং অ্যাগ্রিগেটর এক্সচেঞ্জ হাউসের নানা কৌশলের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্সের ডলারের দাম এভাবে বেড়েছে।
গভর্নর বলেন, 'আমরা ডলারের বিনিময় হার মূলত বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তবে কয়েকটি ব্যাংকের সাম্প্রতিক লেনদেন বলছে, বাণিজ্য কীভাবে করতে হয় সে সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট ধারণা নেই। একটি ব্যাংক ১২৩ টাকায় রেমিট্যান্সের ডলার কেনার পর ওইদিনই আবার ১২৭ টাকায় কিনেছে। এমন ৪-৫ টাকার পার্থক্য অযৌক্তিক। ২০-২৫ পয়সার পার্থক্য মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এটা মানার মতো নয়। কেউ যদি ১২৭ টাকা দাবি করলে আমি তাতে রাজি হতাম না।'
তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো যুক্তি দিচ্ছে, সরকারি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বেশি দামে ডলার কেনা হচ্ছে। কিন্তু এ সমস্যা অন্যভাবেও মোকাবিলা করা যেত, যেমন অন্য ব্যাংকে পাঠিয়ে দিয়ে। এর জন্য বাজার অস্থিতিশীল করার কোনো প্রয়োজন নেই।
গভর্নর বলেন, 'বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কিছু অপরিণত ব্যবসায়ী এই সুযোগের অপব্যবহার করছে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ডিসেম্বরে স্রেফ ডলারের বেশি দাম দিয়েই শীর্ষ রেমিট্যান্স আয়কারী হয়ে উঠেছে। যেকোনো ব্যাংক এটা করতে পারে। কিন্তু এটা বাজার কার্যক্রম নয়। এই ঘটনাগুলো আমরা নিবিড়ভাবে মনিটর করছি এবং ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, বাজারে ডলারের সরবরাহ সংকট বা অতিরিক্ত চাহিদা নেই। ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ডলার কিনছে ১১৮-১১৯ টাকায়, আর রেমিট্যান্স প্রেরকদের কাছ থেকে কিনছে ১২৭ টাকায়। এটি অনৈতিক।
'ভিন্ন ভিন্ন বিক্রেতাকে ভিন্ন ভিন্ন দাম দিতে পারেন না। অযোগ্য ব্যবসায়ীদের বাজার থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত। অশিক্ষিত খেলোয়াড়দের দিয়ে আমি বাজার ঠিক করতে পারব না,' বলেন মনসুর।
ডলার বাজার স্থিতিশীল করার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ব্যবসায়ীদের শিক্ষিত করতে হবে। অভিজ্ঞ ডিলার না হলে ব্যাংকগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে লেনদেন করতে হবে। আর যারা বাজার অস্থিতিশীল করছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উচিত এসব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। ব্যাংকগুলোও বেশি দামে ডলার কিনে ক্ষতির মুখে পড়ছে। আমাদের পরিকল্পনা হলো একটা ফ্রি-ফ্লোটিং বাজারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।'
মনসুর বলেন, 'আমরা আর আগের মতো ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। ব্যাংকগুলোকে ডেকে এনে আর ডলার রেট ঠিক করে দিতে চাই না। তবে ব্যাংকগুলোকে নিয়ম-কানুন মেনে কাজ করতে হবে। একই বাজারে ৫-৭ টাকার পার্থক্য থাকতে পারে না।'
কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে ১২৭.৫০ থেকে ১২৭.৭০ টাকা রেট দিতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই ডলার-টাকার সর্বোচ্চ বিনিময় হার। এর আগে বুধবার রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করতে ব্যাংকগুলোকে ১২৬.৫০ থেকে ১২৭ টাকা পর্যন্ত রেট দিতে হয়েছিল।
২০২৩ সালের নভেম্বরে রেমিট্যান্সের ডলারের রেট সর্বোচ্চ ১২৬ টাকায় পৌঁছেছিল। এতদিন পর্যন্ত সেটিই ছিল ডলারের সর্বোচ্চ দাম। এর পর থেকে ডলারের রেট ওঠানামার মধ্যে থাকলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, নভেম্বরের শুরুর দিকে রেমিট্যান্সের ডলারের রেট ছিল সর্বোচ্চ ১২১.৮০ টাকা। এমনকি গত মাসের শেষ সপ্তাহেও রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করতে সর্বোচ্চ ১২২.৫০ টাকা খরচ হতো।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সের ডলারের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। মাত্র ১৪ কর্মদিবসের মধ্যে ডলারের দাম ৫ টাকা বা ৪.২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেন, বাজারে এখন ডলারের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে, তবে সেটি এত বেশি নয় যে দাম এভাবে বেড়ে যাবে।
ডলারের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কেন হলো জানতে বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে। তাদের মতে, বাজারে ডলারের চাহিদা আগের তুলনায় কিছুটা বাড়া, ডলারের দাম নির্ধারণে অ্যাগ্রিগেটর এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর আধিপত্য, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি প্রায় বন্ধ করে দেওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে নতুন প্রতিযোগী হিসেবে মাঠে নামা অন্যতম কারণ।
ডলার মার্কেট অ্যাগ্রিগেটর বলতে মূলত আর্থিক মধ্যস্থতাকারীকে বোঝায়—যারা ডলারের ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই মধ্যস্থতাকারীরা প্রায়ই ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হার পেতে একাধিক উৎস থেকে তারল্য সংগ্রহ করে থাকে। এর উদাহরণের মধ্যে রয়েছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, জুম, রেমিটলি, মানিগ্রাম ও কারেন্সিফেয়ার।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'অনেক অ্যাগ্রিগেটর সকালে আমাদের কাছে একটি নির্দিষ্ট রেটে ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। পরে দুপুরে ফোন করে বলছে, আরেক ব্যাংক বেশি রেট অফার করায় আমাদের ডলার দিতে পারবে না। এ কারণে আমরা পেমেন্ট শিডিউল ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছি।'