ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকায় গুপ্ত পুলিশের ঘাতক ছায়া
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সুন্দর একটি দেশ রোমানিয়া। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বলকান উপদ্বীপের উত্তরে অবস্থিত দেশটির মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘ মনোরম পর্বতমালা রয়েছে। রোমানিয়াকে বরাবরই ইউরোপের অন্যতম বিচ্ছিন্ন ও পিছিয়ে পড়া দেশের তালিকায় ফেলা হয়। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে দেশটি শাসন করেছে বিভিন্ন বিদেশি শক্তি। এ সব শাসক রোমানিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনই মনে করেনি।
১৯৪০-এর দশকে রোমানিয়ার ক্ষমতা পট পরিবর্তন হয়েছিল। রোমানিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি সে সময় ক্ষমতায় বসে। তারপরও রোমানিয়ার বরাত খুলেনি। পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। রোমানিয়ার প্রথম শাসক দলটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আদল বা মডেল অনুসরণে মেতে ওঠে। ১৯৬০-এর দশকে রোমানিয়া নিজস্ব শাসনব্যবস্থা তৈরি করে। এই সময়েই নিষ্ঠুর একনায়ক নিকোলাই চশেস্কু রোমানিয়ায় লৌহ কঠিন শাসন কায়েম করে। চশেস্কুর নীতিমালা রোমানিয়াকে আরো হতদরিদ্র দশার দিকে ঠেলে দেয়। একই সাথে চলতে থাকে দমন পীড়ন। রোমানিয়ার আমজনতা মনে করতেন, যে তাদের ঘাড়ে দেশ এক বিশাল জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে। এ পাথর সরানোর সক্ষমতা তাদের নেই।
চশেস্কুর শাসনকালে (১৯৬৫-১৯৮৯) রোমানিয়ার অধিকাংশ নাগরিকই কঠিন কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন। শীতকালে ঘরবাড়ি ও অফিস-আদালতে তাপ ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করত না। বেশির ভাগ সময়ই ঘরের তাপমাত্রা সচরাচর ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠতো না। শীতকাল, ফলে, ঘরের ভেতরেও কোট, টুপি, এবং দস্তানা পরে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কাঁপতে কাজ করতে হতো। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নামে চশেস্কুর নির্দেশে রাতে রাস্তায় আলো বন্ধ রাখা হতো। নাগরিকদের ঘরের ভেতর মাত্র এক বা দুইটি ৪০-ওয়াটের বিদ্যুৎ বাতি জ্বালিয়ে চলতে হতো।
ময়দা, চিনি, এবং গোশতের মতো নিত্যপণ্যগুলোর রেশনের মাধ্যমে কেনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। পরিবারপিছু তিন-চার মাসে মাত্র একখণ্ড ছোট মাখনের টুকরো জুটত। কসাইদের দোকানে শুধু শুকরের মাথা এবং পায়ের অংশ বিক্রি করা হতো, যেন প্রাণীগুলোর বাকি দেহাংশ অদৃশ্য হয়ে গেছে। বাস্তবে, সেই খাদ্য পণ্যগুলো রপ্তানি করে অর্থ কামাত চশেস্কুর সরকার।
অর্থনীতির লাগাম ছিল রাষ্ট্রের হাতে, কিন্তু রোমানিয়ার আমজনতার জীবনমান উন্নত করার দিকে তাদের মনযোগ ছিল না। দেশটির জনগণের জীবন দুঃখ-দুর্দশায় কানায় কানায় ভরপুর থাকার পরও চশেস্কুর খায়েশের শেষ ছিল না। উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আরও বেশি বেশি ত্যাগ স্বীকার করার দাবি জানাত রাষ্ট্র। চশেস্কেুর উচ্চাভিলাষী প্রকল্প এবং শিল্পায়ন পরিকল্পনার জন্য নেওয়া বিদেশি ঋণ শোধ করতে ত্যাগের এই কীর্তন গাওয়া হতো। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হাজার হাজার ঐতিহ্যবাহী গ্রাম ধ্বংস করে বিশাল কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ভবন নির্মাণ। হতভাগা গ্রামবাসীদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে গ্রীষ্মকালীন কারখানার কাজে নিয়োগ করা হয়। ধূসর শহুরে ডরমিটরিতে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
বুখারেস্টের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে 'সোশ্যালিস্ট ভিক্টরি অ্যাভিনিউ' তৈরির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে এই প্রকল্পের কারণে ৪০,০০০ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়েছিল। একই সাথে প্রাচীন অনেক গির্জা ও মঠ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এই অ্যাভিনউর প্রধান অংশে চশেস্কু পরিবারের জন্য রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এ প্রাসাদ বানাতে ৭২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করা হয়েছিল। চশেস্কু এবং তার স্ত্রী ঘন ঘন নির্মাণ সাইটে গিয়ে নতুন নতুন ব্যয়বহুল পরিবর্তনের নির্দেশনা দিতেন। তাদের এমন সব খায়েশ মেটাতে ১৫,০০০ শ্রমিককে দিনরাত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
রোমানিয়ার সাধারণ মানুষজন হতদরিদ্র দশায় জীবন কাটালেও চশেস্কু পরিবার জীবনযাপন বিলাসিতায় ভরপুর। ৪০ কক্ষের প্রাসাদে সুইমিং পুল, বক্সিং রিং এবং টেনিস কোর্ট ছিল। তাদের পোশাকের তাকগুলো দামি দামি পশ্চিমা পোশাক-আশাকে উপচে পড়ত। প্রাসাদের দেয়ালগুলো সাজানো হয়েছিল মূল্যবান চিত্রকর্ম দিয়ে।
চশেস্কুর আত্মীয় ও স্বজনবর্গও তার শাসনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। প্রায় ৪০ জন আত্মীয় উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন। তার ভাইদের একজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ডেপুটি, আরেকজন নিরাপত্তা বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল, এবং তৃতীয়জন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান পদে আসীন হয়েছিলেন। তার স্ত্রী এলেনা রাষ্ট্রী এবং দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। রোমানিয়ায় চশেস্কুর পরেই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন এলেনা।
চশেস্কু দম্পতিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে শিশুরা ফুলের তোড়া নিয়ে গালে চুমু দিয়ে তাদের স্বাগত জানাত, লোক চক্ষুর আড়ালে ফুল নিয়ে অংশ নেওয়া এ শিশুদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত করা হতো যে তারা কোনো সংক্রামক অসুখবিসুখে ভুগছে না।
১৯৩০-এর দশকের সোভিয়েত আদলে রোমানিয়ায় নতুন এক সমাজ গড়ার ধান্ধা ছিল চশেস্কুর। তার সাধ ছিল এমন মানুষ গড়বেন, যারা সব আদেশ বিনা দ্বিধায় মেনে চলবে। রোমানিয়ার এক ইতিহাসবিদ বলেছিলেন, এ ধরনের সমাজের জন্য মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে দলের ওপর নির্ভরশীল করতে হবে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা স্বাভাবিক মানবিক প্রতিক্রিয়ার ছিটেফোঁটা থাকলেও তারা এই নতুন সমাজের বিরোধিতা করবে।
ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য চশেস্কুর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল তার গোপন পুলিশ বাহিনী, 'সেকুরিতাতে।' এই বাহিনী তার প্রতি দারুণ অনুগত ছিল। বাহিনীর অনেক সদস্যকে এতিমখানা থেকে শিশুকালেই দলে নেওয়া হয়েছিল। তাদের বড় করা হয়েছিল এই বিশ্বাস দিয়ে যে চশেস্কুই তাদের আসল বাবা এবং তার পরিবারই তাদের একমাত্র পরিবার। তাদের শেখানো হয়েছিল, চশেস্কুর জন্য জীবন দিতেও পিছপা হওয়া যাবে না।
জনশক্তির বিবেচনায় রোমানিয়ার সেনাবাহিনী বড় হওয়া সত্ত্বেও দিনশেষে চশেস্কু বেশি ভরসা করতেন তার গোপন পুলিশ বাহিনী 'সেকুরিতাতে'র ওপর। তুলনামূলক ভাবে 'সেকুরিতাতে' সদস্যদের সুযোগ-সুবিধার বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো। প্রতিশ্রুত একশ ডলার সমপরিমাণ বোনাস পেতে পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের ছয় বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেনাদের অনেক সময় কায়িক শ্রমে বাধ্য করা হতো, যেখানে 'সেকুরিতাতে'র সদস্যদের এমন কাজ কখনোই করতে হতো না।
'সেকুরিতাতে'র জন্য বরাদ্দ ছিল অঢেল অর্থ, ভালো প্রশিক্ষণ, আর উন্নত অস্ত্র। সেনারা দুই বছরে মাত্র চারটা বুলেট পেত। কিন্তু 'সেকুরিতাতে'র কাছে অগণিত গোলাবারুদ থাকত। আর ছিল, রাতের বেলায় দেখার নাইট ভিশন ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এজন্য 'সেকুরিতাতে' সেরাবাহিনির চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক ছিল।
'সেকুরিতাতে'র বদ্ধমুল ধারণা ছিল চশেস্কুর নিরাপত্তা মানেই তাদের নিজের নিরাপত্তা। তারা চশেস্কুর আদেশ পালন করত, কমিউনিস্ট নেতাদের রক্ষা করত। চশেস্কু আর তার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখাই ছিল এ বাহিনীর প্রধান কাজ।
চশেস্কু গুপ্তঘাতকের ভয়ে দিন কাটাতেন। কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাকে বিষ মাখানো জুতা পরিয়ে তাকে খুনের চেষ্টা করেছিল। এমন ঘটনা এড়াতে, 'সেকুরিতাতে' চশেস্কুর জন্য এক বছরের কাপড়চোপড়, জুতা-মোজাসব এক গোপন গুদামে কড়া পাহারায় জমা করে রাখতো। প্রতিদিন সেই কাপড় পরীক্ষা করে তাকে পরতে দেওয়া হতো। তারপরও বিষ লাগতে পারে এ আশঙ্কায় কাপড়চোপড় খোলা মাত্র দিন শেষে সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হতো।
সেকুরিতাতে গোয়েন্দারা চশেস্কু পরিবারের সেবা করার পাশাপাশি সাঁজোয়া যান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে রোমানিয়ার সীমান্তেও টহল দিত। রাজনৈতিক বন্দিদের আটক রাখা হয়েছে এমন সব কারাগারের পাহারায় তাদের মোতায়েন করা হতো। রাজনৈতিক বন্দি নির্যাতনের দায়িত্বে ছিল সেকুরিতাত 'র সার্ভিস কে' নামে পরিচিত একটি দল।
রোমানিয়ার প্রায় সব কিছুর উপরেই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল সেকুরিতাতে। ১ লাখ ৮০ হাজার উর্দিধারী গোয়েন্দার সাথে আরো ছিল ৩০ লাখ সহযোগী চর বা তথ্যদাতা। রোমানিয়ার নাগরিকদের ওপর নিয়মিত নজরদারি চালানোর জন্য টেলিফোনে আড়িপাতা, ফোনালাপ রেকর্ড করার সব রকম জন্য উন্নত সরঞ্জামই ছিল এ গুপ্ত পুলিশের কাছে।
শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষেত্রেও নজরদারি চালাতো তারা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। সরকার বিরোধী কথাবার্তা বললেই দশশিকের পিছনে পুরে দেওয়া হতো। বইয়ের দোকানগুলোতে চশেস্কু এবং তার স্ত্রী এলিনার লেখা বই রাখতে বাধ্য করা হতো। দেশটিতে বিদেশি বই বা সাময়িকী নিষিদ্ধ ছিল। গ্রন্থাগার থেকে বিদেশি বই ধার নিতে চাইলে সেকুরিতাতের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন ছিল।
সরকারবিরোধী কাজ যেন ব্যবহার না করা যায় সে জন্য টাইপরাইটার এবং তার নমুনা পৃষ্ঠাগুলো নিবন্ধন করতে হত। এমনকি নাগরিকদের হাতের লেখার নমুনাও সংগ্রহ করা হত। মানুষ বিশ্বাস করত, কেউ যদি সেকুরিতাতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য নিয়ে কোনো বেনামি চিঠি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে পাঠায়, তবুও তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে। রোমানিয়ার মানুষের জন্য বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষিদ্ধ ছিল। ঘটনাক্রমে বিদেশিদের সাথে কথাবার্তা হলে তার প্রতিবেদন দাখিল করাও বাধ্যতামূলক ছিল।
সেকুরিতাতে তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য কমিউনিস্ট বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ংকর গুপ্ত পুলিশ বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পায়। তাদের সদর দপ্তরের নিচতলায় অত্যাধুনিক নির্যাতনের সরঞ্জাম ছিল, যার মধ্যে বৈদ্যুতিক শক মেশিন, অপারেশন টেবিল, এবং নির্যাতনের নানা যন্ত্র। সেকুরিতাতে এজেন্টদের কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ হত্যার অনুমতি দেওয়া ছিল। অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার শাস্তি ছিল তিন বছরের জেল, কিন্তু সেকুরিতাতের হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাথে সাথে গুলি করে মেরে ফেলা হত।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর তিমিসোয়ার শহরে চশেস্কু বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনা পরম্পরায় সেনাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ায়। সেকুরিতাতে ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। তাদের হামলায় বহু পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হয়। তবে পরিস্থিতি দ্রুত তাদের হাতের বাইরে চলে যায়। এ বিক্ষোভ রাজধানী বুখারেস্টসহ সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। চশেস্কু নিজ সমর্থনে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার পর জনতা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক থেকে চশেস্কু সস্ত্রীক দেশ ছেড়ে সরে পড়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সে সময়ে তার গড়ে তোলা সেকুরিতাতের সাথে সংঘর্ষের মধ্যেই দেশটিতে নতুন সরকার গঠিত হয় এবং নিকোলা চশেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনা চশেস্কুকে পাকড়াও করতে সক্ষম হয় নতুন সরকার। এরপর সামরিক আদালতে বিচারের ১৯৮৯-এর বড়দিনের সন্ধ্যায় এই দম্পতির প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফায়ারিং স্কোয়াডের জন্য মাত্র তিনজন সেনার দরকার থাকলেও তিনশর বেশি সেনা এ কাজের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
মধ্য ইউরোপে আবারও সবচেয়ে বড় দেশে পরিণত হয়েছে জার্মানি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দেশটিকে পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি এই দুই খণ্ডে ভাগ করা হয়েছিল। পূর্ব জার্মানির মূল নিয়ন্ত্রণে থাকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যদিকে পশ্চিমা মিত্রদের হাতে থাকে পশ্চিম জার্মানি। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বার্লিন প্রাচীর দুই জার্মানির বিভক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বিভেদের এ প্রাচীর ২৮ বছর ধরে, ১৯৮৯ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্ব জার্মানি থেকে যারা এ প্রাচীর টপকাতে চেষ্টা করেছে তারাই জীবনের ঝুঁকিতে পড়েছে। কিংবা প্রাণ দিয়েছে।
পূর্ব জার্মানিকে সোভিয়েত আদলে গড়ে তোলা হয়। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ন্ত্রণে থাকে জার্মানির কম্যুনিস্টরা। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে খামার বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কবজা করে সোভিয়েতরা। এ সব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের ধাঁচে গড়ে তোলা হতে থাকে। এ পদ্ধতি বিরুদ্ধাচারণ করা মানেই হলে বন্দি শিবিরে চালান হওয়া। ইস্ট জার্মান মিনিস্ট্রি ফর স্টেট সিকিউরিটি সংক্ষেপে স্ট্যাসি জার্মান ডেমোক্রটিক রিপাবলিক বা জিডিআর সরকারের দেশকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। স্বদেশে এবং বিদেশে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অঙ্গন উভয় স্থানেই স্ট্যাসি সমান তালে তৎপরতা চালিয়েছে।
প্রায় ৯০ হাজার নিয়মিত সদস্যের এ বাহিনীর চর হিসেবে কাজ করেছিল আরো প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার সদস্য। তবে এ সবই আনুমানিক সংখ্যা। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের শক্তিশালী এবং সর্বব্যাপী গোয়েন্দা এবং গুপ্ত পুলিশ সংস্থাগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছিল স্ট্যাসি। পূর্ব জার্মানীর মানুষকে রাষ্ট্রের তাঁবেদার বানিয়ে রাখার জন্য তাদের ওপর চোখ রাখাসহ অপহরণ, নির্যাতনসহ সব অপ কৌশলের আশ্রয় নিতে দ্বিধা করত না সংস্থাটি। ফোনে আড়িপাতা, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র বা ডায়েরি হাতিয়ে নিয়ে পড়াসহ সব গোয়েন্দা তৎপরতায় দক্ষ ছিল স্ট্যাসি। জার্মান নাগরিকদের ওপর নজরদরির নথির ওজন পাঁচ হাজার টনের বেশি ছিল। এ সব নথি একটার পর একটা সাজিয়ে রাখা হলে পাঁচশ' মাইলের বেশি হতো বলে অনুমান করা হয়।
বার্লিনের প্রাচীরের পতনের মধ্য দিয়ে জিডিআর সরকারের পতন ঘটে। একই সাথে অবসান হয় স্ট্যাসির ভয়াল যুগের।
১৯৮০-এর দশকে এল সালভাদোরের হোসে নামে এক ব্যক্তিকে একদল সাদা পোশাকের সশস্ত্র লোক অপহরণ করে। তাকর হাত ও চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোপন স্থানে নিয়ে যাওযা হয়। সেখানে নির্যাতন চলে তার উপর। কিন্তু তাকে আইনের হাকে সোর্পদ করা হয়নি, এমন কি কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। আট দিন পর, হোসে এবং আরও দুই বন্দিকে এক প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে গুলি করা হয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে হোসে বেঁচে যায়। এক পরিবার তাকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে সেখানেও তার খোঁজে হাজির হয়ে যায় সৈন্যরা। তবে নার্সরা নিরাপত্তার বাহিনি খুজে পওেয়ার আগেই তাকে লুকিয়ে ফেলে। পরে সুস্থ হয়ে দেশ ছেড়ে পালায় হোসে। আর কখনো ফিরে আসেনি।
মধ্য আমেরিকার ছোট দেশ এল সালভাদোর দীর্ঘদিন দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। সরকার ডেথ স্কোয়াড তৈরি করে। এই সিক্রেট পুলিশ বাহিনি সাদা পোশাকে বিরোধীদের উপর নির্বচারে হত্যা ও নির্যাতন চালায়। এদের হাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।
ডেথ স্কোয়াডের অন্যতম সাড়া জাগানো শিকার হয়েছিলেন আর্চবিশপ অস্কার রোমেরো। তিনি সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে, সৈন্যদের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বলে রোষানলে পড়েন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের সময় তাকে হত্যা করা হয়। সাক্ষী-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, হত্যাকারীরা শাস্তি পায়নি।
এল সালভাদোরে শিক্ষক, শ্রমিক নেতা এবং মানবাধিকার কর্মী কেউই হামলা থেকে রেহাই পায়নি। বিচারপতিরা তদন্ত করতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকিতে পড়েছেন। কিংবা নিহত হয়েছেন। ডেথ স্কোয়াড বছরের পর বছর ধরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং দেশের ওপর শাসকের কঠোর শাসনি টিকিয়ে রেখেছে।
১৯৮০-এর দশকের সূচনায় হন্ডুরাসে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে। ব্যাটালিয়ন ৩-১৬ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত সামরিক দল বহু মানুষকে অপহরণ, গুম, নির্যাতন ও হত্যা করে। ব্যাটালিয়ন৩-১৬ শিক্ষার্থী, শ্রমিক নেতা এবং রাজনৈতিক কর্মীদেরকে সরকারবিরোধী বলে চিহ্নিত করত। ভয়ভীতি, মানসিক নির্যাতনে কাজ না হলে নির্দ্বধায় হত্যা করত। হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হতো প্রকাশ্যে। তাদের হাতে বন্দি থাকা, বোড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওযা মানুষের কপালে কি ঘটেছে কোনদিনই জানা যায়নি। পাওয়া যায়নি তাদের মৃতদেহও।
তৎকালীন সামরিক কমান্ডার জেনারেল গুস্তাভো আলভারেজ মার্টিনেজ এই নির্যাতন ও হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। তার হুকুমে বহু মানুষকে অপহরণ, গুম, জিজ্ঞাসাবাদ ও হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে কিছু সামরিক কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং তার কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়। ফাঁস করা তথ্য থেকে জানা যায়, ব্যাটালিয়ন ৩-১৬কে যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষণ এবং তহবিলের জোগান দিয়েছিল।
জেনারেল আলভারেজ শেষ পর্যন্ত নির্বাসিত হন।
সাভাক (সাযমান-ই এত্তেলাআত ভা আমনিয়াত-ই কেশভার বা জাতীয় গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থা) ছিল ইরানের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী। ১৯৫৭ সালে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে সাভাক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন এবং শাহের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। সিআইএ এবং মোসাদের সহায়তায় প্রশিক্ষিত এই বাহিনী তাদের নিষ্ঠুর পদ্ধতির জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিল।
ইরানের রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবী এবং যে কেউকে রাজতন্ত্র বিরোধী বলে সন্দেহ করা হতো তারাই সাভাকের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতো। এ ভাবে বিরোধীদের নজরদারি, বাক স্বাধীনতা হরণ, সেন্সরশিপ, নির্যাতন এবং কারাবন্দি করার নীতি এক ভয়াল দমনমূলক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
১৯৭০-এর দশকের মধ্যে সাভাকের ক্ষমতা এবং নিষ্ঠুরতা ইরানি জনগণের তীব্র অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ইরানি ইসলামি বিপ্লবে শাহের পতনের অন্যতম কারণ ছিল সাভাক। ফারসি দিনপঞ্জি অনুযায়ী বাইশে বাহমান অর্থাৎ ১১ ফ্রেরুয়ারি ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লবের পর সাভাককে বিলুপ্ত করা হয়। সাভাক প্রধানকে আটক করা হয়। বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
জেনারেল অগাস্টো পিনোশে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে। তিনি ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চিলি শাসন করেন। পিনোশের শাসনামলে গুপ্ত পুলিশ, বিশেষ করে দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিনা) এবং পরে জাতীয় তথ্য কেন্দ্র (সিএনআই), ভিন্নমত দমন এবং পিনোশের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে।
১৯৭৪ সালে পিনোশের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ডিনা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম থেকেই ডিনা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করেছে। ডিনা ছিল দেশটির রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করার হাতিয়ার। ম্যানুয়েল কনট্রেরাসের নেতৃত্বে ডিনা ব্যাপক নজরদারি, অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যা তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। বাম আন্দোলনের সদস্য, শ্রমিক নেতা, বুদ্ধিজীবী এবং পিনোশের সরকারের বিরোধিতায় জড়িত হিসেবে সামান্য সন্দেহ হলেই তাকেই লক্ষ্যবস্তু বানাত ডিনা।
ডিনার সদস্যরা ত্রাস ছড়ানোর জন্য নির্মম পদ্ধতি ব্যবহার করত। শক্তহাতে বিরোধীদের বা বিরোধী ভাবাপন্নদের দমন করত। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকেই ভিলা গ্রিমালডি এবং লন্ড্রেস ৩৮-এর মতো 'আয়নাঘরে' আটক করে নির্যাতন চালানো হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের অনেকেই প্রায়শই 'অদৃশ্য' ' বা 'গুম' করে ফেলা হতো। পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদের সন্ধানে হন্যে হয়ে উঠলেও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো উত্তরই পেত না।
সরকার চিলির দেশত্যাগী ভিন্ন মতাবলম্বীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য দেশের বাইরেও অপারেশনও চালাতো।
পিনোশের শাসনামলে আনুমানিক ৩,০০০ মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ নির্যাতিত বা বন্দি হয়েছে। নির্যাতনের অংশ হিসেবেই নারীদের যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। সরকারের এই কাজগুলো জনগণের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেয়। তার মুখবন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। ফলে প্রায় দুই দশক ধরে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে কার্যত স্তব্ধ করে দেয় পিনোশে।
১৯৯০ সালে পিনোশে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান এবং চিলি গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করে। রেটিগ রিপোর্ট এবং ভ্যালেচ রিপোর্টের মতো সত্য কমিশনগুলো তার শাসনামলে সংঘটিত ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথিপত্র তৈরি করে। ডিনা এবং সিএনআই-এর কিছু সাবেক কর্মকর্তা, যেমন ম্যানুয়েল কনট্রেরাস, তাদের অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। তবে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্যগত সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে পিনোশে গুরুতর শাস্তি এড়িয়ে যান। পিনোশের গুপ্ত পুলিশ চিলির ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
গেস্টাপো ছিল নাজি জার্মানির বিশেষ পুলিশ বাহিনি। এই সংস্থাটি জার্মানি এবং এর দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে নাজি বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করেছে। গেস্টাপো এবং সিকারহাইটসডিয়েনস্ট সংক্ষেপে এসডি- যৌথভাবে পুরো ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের গ্রেপ্তার অভিযান চালাতো। পরে তাদেরকে গণহত্যা শিবিরে পাঠানোর দায়িত্বও পালন করেছিল।
১৯৩৩ সালে নাজিরা ক্ষমতা গ্রহণ করলে তৎকালীন প্রুশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারমান গোয়েরিং প্রুশিয়ান নিয়মিত পুলিশ বাহিনী থেকে রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা ইউনিটগুলিকে আলাদা করে। হাজার হাজার নাজিকে তাদের পদে ভর্তি করে এবং ২৬ এপ্রিল, ১৯৩৩-এ নিজ ব্যক্তিগত কমান্ডের অধীনে গেস্টাপো হিসেবে তাদেরকে পুনর্গঠিত করে। । হাইনরিখ হিমলারকে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে গোয়েরিংয়ের গেস্টাপো বাহিনীর কমান্ডে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
গেস্টাপোকে নাগরিক অধিকারের ধার ধারতে হতো না। এ বাহিনীর 'প্রতিরোধমূলক গ্রেপ্তার' করার ক্ষমতা ছিল। গেস্টাপোর তৎপরতা প্রচলিত আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হতো না হাজার হাজার বাম বুদ্ধিজীবী, ইহুদি, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, রাজনৈতিক দল, পাদরি এবং ভিন্ন মতালম্বীদেরকে গেস্টাপো গ্রেপ্তার করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে চালান করে দেয়। বন্দিরা সেখান থেকে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে গেস্টাপো গেরিলা কার্যকলাপ দমন করেছে। পাশাপাশি বেসামরিক মানুষজনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।