স্মৃতির দুর্গাপূজা
এ কথা সকলেই মানবেন যে, বাংলার সংস্কৃতির ওপরে এই বাংলার লৌকিক দেবী দুর্গারই একমাত্র সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। কখনো তিনি পার্বতী, কখনো তিনি চণ্ডী, কখনো যোগমায়া, কখনো অম্বিকা, কখনো মহিষাসুরমর্দিণী, কখনো নারায়ণী, কখনো মহামায়া, কখনো কাত্যায়নী, কখনো দুর্গতিনাশিনী ইত্যাদি।
এই প্রাচীন জনপদের শাক্তধর্মের দুর্গাদেবীর এই বিভিন্ন রূপের সঙ্গে বাংলার কে পরিচিত নয়? তার এই বিচিত্র রূপের কারণেই তিনি সবারই আরাধ্য হয়েছেন। এই সূত্রে আরও বলা প্রয়োজন, সংস্কৃতিগতভাবে দুর্গাদেবীর আগমন সংক্রান্ত উৎসব উদযাপনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরেই অধিকার রয়েছে।
শৈশব আর কৈশোরে তো আর এত-শত দার্শনিক বিষয়আশয় বুঝতাম না! তবে ঠিকই লক্ষ করতাম, আমার আশপাশের সকলেই ষষ্ঠী থেকে শুরু করে মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমীর নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এটাও বলতে হবে, স্বরসতী পূজার উৎসবেরও সর্বজনীনতার চরিত্র ছিল, যদিও স্বরসতী পূজার সাড়া পড়ত কম। তবু আমরা, মুসলিম সংস্কৃতির পরিবারের সন্তানরাও তখন দলবেঁধে বইখাতা, দোয়াত-কলম আর ফুল নিয়ে মণ্ডপে গেছি দেবীর আশীর্বাদ ভিক্ষে করতে।
আমরা সবাই যে ভালো ছাত্র ছিলাম, এমনটা নয়! স্বরসতী দেবীকে পূজা দেওয়ার বেলায় কেউ আমাদেরকে বারণ করেননি কখনও—না পূজার সংগঠকেরা, না আমাদের পরিবারের বড়রা।
দেবী দুর্গা বাদে আর কোনো দেব-দেবীর বন্দনায় বিশাল, সর্বব্যাপি সর্বজনীন উৎসব আমরা দেখিনি; শিবঠাকুরের বন্দনাতেও নয়। যে কারণে বা যেভাবেই দুর্গোৎসবের প্রচলন হয়ে থাকুক না কেন, এটাই লক্ষণীয় যে, তাতে বরাবরই সর্বজনীনতার চর্চা হয়েছে, হচ্ছে আজও। এই সর্বজনীনতাই আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটা মস্ত বড় উদারতার দিক।
পালবংশ, সেনবংশ, তুর্কি-শাসন, পাঠান-শাসন, মুঘোল-শাসন বা ইংরেজ-শাসনের কালেও আমরা আমাদের লোকজ সংস্কৃতি-প্রকাশের আচার অটুট রাখতে পেরেছি। এই চেতনাই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের হৃদয়ের সর্বজনীনতার চর্চার উৎস।
মনে পড়ছে, দেবীপক্ষের শুরুর দিনে আকাশবাণীতে মহালয়া পাঠ করতেন শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র—'যা দেবী সর্বভূতেষু/শক্তিরূপেণ সংস্থিতা/ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।' সত্তরের দশকের কথা সেটা। আমার বাবা ফখরুল ইসলাম তখন আকাশবাণীর একনিষ্ঠ শ্রোতা, আমার মা ফরহাতুন্নেসাও তা-ই।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তিই বলে দিত: আশ্বিন এল বলে; এবার শিউলিফুলের গন্ধ ছুটবে চারদিকে; আবারও নীলাকাশে অলস গতিতে ভেসে বেড়াবে সাদা মেঘের ভেলা। আর তখন বুঝতে আর বাকি রইত না, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আগমনী সঙ্গীত যখন শুরু হয়ে গেছে, তবে আর ন'দিন পরেই ষষ্ঠী!
ষষ্ঠী মানেই আবারও পাড়া কাঁপিয়ে দিয়ে উঠবে ঢাকের আওয়াজ—ড্যাং ড্যাং ড্যাং, নাক ডেঙাড্যাং ড্যাং…; সঙ্গে বাজবে কাসরঘণ্টার আওয়াজ। আর মণ্ডপ থেকে মাইকে সারাদিন বাজতে থাকবে বাংলা আর হিন্দিভাষার জনপ্রিয় সব গান, যেগুলোর কিছু কিছু আকাশবাণী এবং রেডিও সিলনের অনুরোধের আসরে শোনা যেত তখন। ষষ্ঠী মানেই আমি বারোয়ারি দুর্গাপুজার মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াব, আরতিদান দেখব; কখনো বাবার সঙ্গে, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে, কখনো-বা একাই।
১৯৬৯ সালে আমার বয়স ছয় বছরের মতো। তখনকার স্মৃতি বিশেষ একটা মনে পড়ে না। তবে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা-মা এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা থেকে বুঝেছিলাম, ভিন্ন সংস্কৃতির পাকিস্তানিদের আগ্রাসনের কালে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়াটা প্রায় রাষ্ট্রদোহীতার সামিল ছিল আর পূজা-আর্চ্চা নিয়ে মাতামাতি করাটাকে কখনোই মদদ দেওয়া হয়নি তখন।
মনে পড়ে, মুক্তিসংগ্রাম চলার সময় আমি 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি' গাইতে পারিনি! ব্যাপারটা ছিল এমন: দেয়ালেরও কান আছে কিন্তু! দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের চরেরা শুনে ফেললে জানটাও চলে যেতে পারে!
সাবধানবাণীটা তখন ভালো মতোই বুঝতে পেরেছিলাম, কেননা ততদিনে দখলদার পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড স্বচক্ষে দেখে ফেলেছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর এসব উটকো আতঙ্ক দূর হয়ে গেল। বিজাতীয় একটা সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে এই আতঙ্ক বাঙালির মনে গেড়ে বসেছিল দেশবিভাগের পর থেকেই। রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামও করতে হয়েছে আমাদেরকে বিজাতীয় একটা সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তাই এখন, দূর থেকে, ১৯৭২ সালে দুর্গাপূজাকে সার্বজনীনতার মাপে অসাধারণ বলে মনে হয় আমার। তখন আমার আট বছর বয়স। সার্বজনীনতা ব্যাপারটা যে কী, তা তখন বুঝতাম না বটে!
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ন'মাসেই আমার মতো শিশুদেরকে অনেকটাই পরিপক্ক বানিয়ে ফেলেছিল। দৃষ্টি প্রসারিত হয়েছিল আমার রাতারাতি। ১৯৭১ সালে সনাতন ধর্মের মানুষদের ওপরে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যরা যে বিশেষ নিগ্রহণ চালিয়েছিল, তা দেখে দেখে তখন বুঝতে শুরু করেছি—সাম্প্রদায়িকতা একটা কুশ্রী বিষয়; ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্বটা নিয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠরা কথাবার্তা বললে তা বুঝতেও খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না।
এভাবেই লক্ষ করলাম, ১৯৭২ সালের দুর্গাপূজা আগের চাইতে ভিন্ন—মণ্ডপে মণ্ডপে উপচে পড়ছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ। এই নব-উন্মাদনার আরেকটা কারণ ছিল বৈকি: ১৯৭১ সালে তো সর্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করাই সম্ভবই হয়নি, যা হয়েছে তা চুপিসারেই! মানুষ তখন প্রাণ রক্ষা করতেই ব্যতিব্যস্ত থেকেছে বেশি এবং সেটাই স্বাভাবিক ছিল উপদ্রুত একটা পরিস্থিতিতে।
১৯৭২ সালে বারোয়ারি দুর্গাপূজার সেই উন্মাদনার মাত্রা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল অবধি, দুর্গাপূজার সময়ে পাবনা আর ঢাকার (এ দুটো জায়গাতে আমি থেকেছি সেই সময়টায়) মণ্ডপগুলোতে ভেঙে পড়ছিল ধর্মনির্বিশেষের মানুষের ঢল। ১৯৭১ সালে উপদ্রুত একটা দেশে থাকা মানুষের মনে জমাট বেঁধে থাকা অবদমন তখন সুযোগ পেলেই নানা দিকে, নানা অনুষ্ঠানে স্ফূরিত হচ্ছিল। তেমন স্বতঃস্ফূর্ততাই তো আসলে স্বাধীন মনের প্রকাশ!
মুক্তিসংগ্রাম আমাদের মনকে এভাবেই উন্মুক্ত করেছিল! ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পরে সেই উন্মাদনায় ভাটা পড়ে যায়। এ কথা মানতেই হবে, মধ্যবিত্ত এলিটদের বড় অংশটাই ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল দেশের মুক্তি জন্য, কল্যাণের জন্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে এটাও ভুললে চলবে না, এই মধ্যবিত্ত এলিটদেরই একটা অংশ ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল; প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা দিয়েছিল দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে। সেই শক্তির চক্রান্তেই এবং সরাসরি অংশগ্রহণে ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছিলেন সপরিবারে।
বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও ক্ষমতাবান হয়ে উঠল। বাঙালির স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক আচার অনুসরণে বাধা এলো আবারও, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও। আর মুক্তিযুদ্ধের নায়কের নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে মন ভেঙে গিয়েছিল আপামর মানুষের; আতঙ্কিতও হয়েছিল তারা সকলেই! কিন্তু স্বাধীন মনের লক্ষণ এই যে, সে নির্ভয়ে তার সংস্কৃতির আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেবে, একাত্ম হবে স্বাভাবিকভাবে। তাই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর থেকে ১৯৯০ সালে স্বৈরতন্ত্রের পতন অবধি সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বারোয়ারি দুর্গাপূজার সার্বজনীনতায় চরম আঘাত এসে পড়েছিল। তারপরও মানুষ দুর্গোৎসবকে ঘিরে তাদের সর্বজনীনতা প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হয়নি।
ততদিনে বঙ্গবন্ধু-হত্যা পরবর্তী আতঙ্ক প্রশমিত করতে শিখে নিয়েছে মানুষ। অবদমনের জীবনের বৈশিষ্ট্য এটাই, মানুষ তখন নানা দিকে তার নিজের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়—তার লেখায়, তার গানে, তার আচারাদিতে, তার উৎসবে।
যুদ্ধ করে অর্জন করা নতুন দেশ—বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে দুর্গাপূজা হয়েছিল। আমার বাবা তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ান। সেই গ্রীষ্মের বন্ধে যথারীতি ঢাকায় ছুটি কাটতে এসেছিলাম আমরা। পরে দুর্গাপূজার বন্ধে কেন যেন, অল্প ক'দিনের জন্য হলেও, আবারও পাবনা থেকে ঢাকায় আসা পড়ল আমাদের।
আম্মার পৈতৃক নিবাস সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম মহল্লায়। সেটা তাই আমারও বাসা। জামে মসজিদের সামনে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের যে মাঠটা আছে, সেটা পার হলে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল। তখন মস্তবড় একটা খালের ওপরে মৌচাক মার্কেট তৈরি হচ্ছে কেবল। বয়েজ স্কুলের পূর্বদিকের দেয়ালের সঙ্গে সরু একটা পথ, খালের ধারেই। সেই পথ ধরে সংক্ষেপে সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়ি মন্দিরে যাওয়া যেত তখন, চাইলে সেখান থেকে সোজা শান্তিনগর। নইলে ঘুরোপথে সিদ্ধেশ্বরী রোড ধরে পশ্চিমে এগিয়ে কালীবাড়ি রোডে ঢুকে অনেকটা হাঁটলে পৌছানো যেত মন্দিরটায়।
খাটনি বাঁচানোর জন্য তাই অষ্টমীর দিন বয়েজ স্কুল মাঠ থেকে সংক্ষিপ্ত পথটা ধরেই মণ্ডপে গিয়েছিলাম। বিকালে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠটায় ফুটবল খেলার সময় একটু দূরের মণ্ডপের মাইকে ভেসে আসছিল লতা মুঙ্গেস্করের বিখ্যাত বাংলা গান—'ও প্রজাপতি! প্রজাপতি! পাখনা মেল।' ফুটবল খেলাতে তাই মনই বসছিল না!
বিকাল গড়িয়ে গেলে খেলা শেষ হয়েছিল। আমার বন্ধু লাকিকে সঙ্গে নিয়ে আমি ছুটেছিলাম কালীবাড়ির মণ্ডপে। সেই প্রথম আমার মনে শারদীয় দুর্গোৎসবের দোলা লেগেছিল!
বয়েজ স্কুলের পূর্বদিকের খালপাড়ের সরু পথটা ধরে চটজলদিই আমরা সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়ির মণ্ডপে পৌঁছে গেলাম। খালপাড়ের পথটা শেষ হলেই কালীবাড়ি রোডের শুরু। চৈত্রসংক্রান্তি আর দুর্গোৎসবের সময় সেখানে পসরা সাজিয়ে বসত দোকানিরা। সেদিনও সেখানে টুকরিতে খেলনার বাজার বসেছে—ট্যাপা পুতুল, ডুগডুগি, সিলভার রঙের ছোট ছোট হাণ্ডিপাতিল, কাঠের পিঁড়ি-বেলুন, প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি। পকেটে তো আর পয়সা-টয়সা ছিল না! কেনা হলো না কিছুই (পরের দিনে, মানে নবমীর দিনে, আব্বার সঙ্গে সেখানে গিয়ে কিনেছিলাম অনেকগুলো খেলনা!)।
আমি দেখছি, মন্দিরে ঢুকছে আর বের হচ্ছে অসংখ্য মানুষ—তাদের বেশির ভাগকেই চিনি না। তো, মন্দিরের চত্বরের দক্ষিণ দিকে প্রতিমার অধিষ্ঠান হয়েছে। এত মানুষ ভিড় করে আছে সেখানে, আমি প্রতিমার সামনের দিকটায় পৌঁছাতেই পারছি না! ততক্ষণে আরতি দেওয়া শুরু হয়ে গেছে, জোর তালে বাজছে ঢোল আর কাসরঘণ্টা, ধূপের মাতাল করা সৌগন্ধ ছুটেছে। আর আমি ছন্দে-ছন্দে-তালে দুলছি, দুলছি। আমার শঙ্কা হচ্ছে—যাহ্! আজ আর মনে হয় আরতিদান দেখা হবেই না! এত্ত মানুষ চারদিকে!
একটু পরে মানুষজন ঠেলে প্রতিমার কাছাকাছি যেতে পারলাম; গায়ে গায়ে লাগানো ভিড়ের মাঝে দাঁড়াতে পারলাম এক কোণায়। তখন কেউ একজন জলন্ত ধূপে ভরা ধুনচি তার দাঁতে চেপে ধরে নানা ভঙ্গিমায় নাচছে ঢাকঢোলের তালে তালে। আমি থ হয়ে তার শারীরিক কৌশল দেখছি! আর থেকে থেকে চোখ চলে যাচ্ছে অপূর্ব দুর্গা প্রতিমার দিকে। সিংহবাহিনীর চারপাশে পাশে আসন নিয়েছেন দেবী সরস্বতি, লক্ষী, কার্তিক, গণেশ, শিব আর দেবীর পায়ের নিচে পড়ে আছে মন্দের প্রতীক—মহিষাসুর। আর দেব-দেবীদের বাহনদের দিকেও আমার চোখ চলে যাচ্ছে বারবার—সিংহ, ময়ূর, পেঁচা, হংস আর ইঁদুর। কী সুন্দর ছিল সেই মূর্তিগুলো! চোখে এখনো ভাসছে, এতদিন পরেও!
আরতি শেষ হওয়ার পর মন্দিরের চত্বরে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি জানতাম, একটু বিরতি দিয়ে আবারও মাইকে বেজে উঠবে লতা-কিশোর-মুকেশ-আশা-রাফির হিন্দি আর বাংলা গান। আমাদের বাসাটা মন্দির থেকে একটু দূরে বলে বাসা অবধি এসব গান স্পষ্ট করে পৌঁছায় না। কিন্তু গান তো শুনতেই হবে আমাকে!
একটু আপেক্ষার পরে ফের বাজতে শুরু করল আমার প্রিয় গানগুলো—চিঙ্গারি কোয়ি ভারকে, চালো দিলদার চালো, কাহি দূর যব দিন ঢাল যায়ে, কাঞ্চিরে কাঞ্চিরে, না জিয়া লাগে না, দাম মারো দাম, হারে রামা হারে কৃষ্ণা, রে মাম্মা রে মাম্মা রে... ইত্যাদি। কিন্তু আমার সবচাইতে প্রিয় গান—কিশোর কুমারের সুপার হিট 'ফুলঁও কাটারো কা সাবকা ক্যাহ না হ্যায়' আর বাজছে না!
গানটা শোনার জন্য মন্দিরের চত্বরে আমি একা একা দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই! এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দেরিতে বাসায় ফেরার জন্য নির্ঘাৎ বকা খাব আম্মার কাছে—সেটা ভেবে আমি আকুল হাচ্ছি, কিন্তু প্রিয় গানটা না-শুনে নড়তেই পারছি না! চেয়ে-চিন্তে যে ভোগ এস্তেমাল করা যায়—সে কথাও মাথায় আসছে না তখন!
মনে পড়ছে, মিনিট কুড়ি পরে 'ফুলঁও কাটারো কা' বেজে উঠল। মন দিয়ে গানটা শুনলাম আমি আনন্দ নিয়ে, আর ভাবলাম—এই না হলে হয়! তখন সংকল্প করছি, ছোট মামাকে বলব, সে যেন কোলকাতা থেকে 'হারে রামা হারে কৃষ্ণা' মুভির গানগুলোর ভাইনাল রেকর্ড আনানোর ব্যবস্থা করে।
কালিবাড়ি রোড ধরে ফেরার পথে হাঁটতে কষ্টই হচ্ছিল আমার! মনে হচ্ছিল যেন মানুষের পায়ের চাপা খেয়ে মারাই যাব! ১৯৭২ সালের বারোয়ারি দুর্গাপূজায় এমনই বিশাল মাত্রার জনসমাগম হয়েছিল!
১৯৭২ সালের সার্বজনীন দুর্গাপূজার মতো এত ভিড় হয়েছিল ঐ একই বছরের শুরুতে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৯৭১-এর মার্চেই শহীদ মিনারে ট্যাঙ্কের গোলা দাগিয়েছিল। ট্যাঙ্কের গোলার আঘাতে তখন শহীদ মিনার ভেঙে খানখান হয়ে পড়ে আছে মাটিতে (যেটা আমি দেখেছিলাম ১৯৭২ বা ১৯৭৩ সালের কোনো একটা সময়ে। ঠিকঠাক মনে পড়ছে না।)। মামা-খালা আর চাচাতো-ফুফাতো ভাইদের কাছে সে উন্মাদনার গল্প শুনেছিলাম অনেক পরে।
১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রকাশটা স্পষ্টই ছিল। কাজেই তখনো বারোয়ারি দুর্গাপূজার সময়ে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। আমরা তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ক্যাম্পাস থেকে জেলাপাড়ায় চলে গেছি।
এখানে পাবনা শহরের বৈশিষ্ট্যটা একটু বলে রাখি। ঐতিহাসিকভাবেই সেই শহরে মূলত কালী মন্দির ছিল পাড়ায় পাড়ায়; কখনো এক পাড়াতেই কমপক্ষে দু'টো করে মন্দির ছিল, এখনো তা আছে বটে। তো, গোবিন্দবাড়ির মন্দির আমাদের বাসা থেকে খু্ব একটা দূরে ছিল না। এর ফলে সুবিধা যেটা হলো: বাসায় বসেই আমি লতা-কিশোর-মুকেশ-আশা-রাফির নতুন নতুন সব হিন্দি আর বাংলা গান শুনতে পাচ্ছি। বাসায় বসে স্কুলের পড়া পড়ছি বটে, কিন্তু পড়াতে মন বসছে না কিছুতেই, স্কুলেও মন উড়ুউড়ু; কেননা আমি বিভোর হয়ে প্রতীক্ষা করছি, কখন বিকাল হবে, আর আরতিদান দেখতে ছুটব গোবিন্দবাড়ীর মণ্ডপে।
যথারীতি গোবিন্দবাড়ির মণ্ডপের বারোয়ারি দুর্গাপূজার আয়োজনে গিয়ে আরতি প্রদান দেখছি; আমার শরীর দুলছে ঢাকের মুর্চ্ছনায়। তখন আরেকটা মজা হচ্ছে: বাবা আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে রিকশায় চেপে দুর্গাপূজা উদযাপন করতে চলেছেন এডওয়ার্ড কলেজ আর জয়কালিবাড়ীর মণ্ডপে।
বাবার সঙ্গে মণ্ডপে যাওয়ার লাভটা ছিল খুবই প্রত্যক্ষ: প্রতিমা দর্শনের পরে তিনি আমাদেরকে কিনে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের খেলনা, ডালাকুলা আর বাঁশি, বিন্নি ধানের খই, ছাঁচে বসানো মিছরি, কদমা ইত্যাদি। সেই আনন্দ ধরে রাখার মতো ছিল না! এছাড়া আমরা কাশফুল দেখতে তো যাচ্ছিই পাবনা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদীর ধারে। আমাদেরকে কাশফুল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন হাসান মামা। রাজবাড়ির মানুষ ছিলেন তিনি।
তবে বারোয়ারি দুর্গাপূজার সময়টায় যখন ঢাকায় থাকা পড়ত, তখন আমার মণ্ডপ-ভ্রমণ সংকুচিত হয়ে যেত। কৈশোরে ঢুকে গেলেও দূরে যাওয়ার অনুমতি আমার ছিল না। (আম্মা বলত, চারদিকে অজস্র ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে; ঢুকিয়ে রাখবে মাটির বড় একটা হাঁড়ির ভেতর; তারপর নুলো বানিয়ে বায়তুল মোকারারম বা গুলিস্তানে ভিক্ষে করতে বসিয়ে দেবে। ব্যাপারটা আতঙ্কের ছিল বৈকি!)
কাজেই সবেধন সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়ির মণ্ডপেই যেতে হচ্ছে আমাকে। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন বা জগন্নাথ হলে যে পূজার উদযাপন চলছে মহাসমারোহে, সেটা তো দৈনিক ইত্তেফাক বা দৈনিক বাংলাতেই দেখা যাচ্ছে! তবে কী করা যায়?
অনেক সাধ্যিসাধনার পরে উন্নতি একটা ঘটল বটে—একবার শাঁখারীবাজারের মণ্ডপগুলোতে ছোট মামা আমাকে নিয়ে গেলেন, আরেকবার আজিমপুরার কলোনিতে বড় চাচার বাসায় বেড়াতে গেলে কলোনির দক্ষিণের দেয়ালের দিকের মণ্ডপে দুর্গাপূজা দেখা গেল।
শাঁখারীবাজারে গিয়ে তো আমার চোখ চড়কে উঠল! পুরো রাস্তাটা জুড়ে ঝলমলে বাতি জ্বলছে নানা রঙের, দু'দিকেই! সিদ্ধেশ্বরীর কালীবাড়ির মণ্ডপে কিন্তু এত আলো জ্বলত না তখন। উত্তেজনা নিয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে খুব ধীরে ধীরে মামার সঙ্গে আমি শাঁখারীবাজারের টানা পথটা ধরে হেঁটেছিলাম। মনে পড়ছে, মামা তার বোনদের জন্য শাঁখার আংটি কিনেছিলেন; আমার জন্য বাঁশি আর ডুগডুগি। আর যা হয়, বাঁশি আর ডুগডুগির আওয়াজের যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন বাসার বয়োঃজ্যেষ্ঠরা।
এ কথা আজ বলতেই হবে, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে স্বৈরতান্ত্রিক অবদমন শুরু হলেও দুর্গোৎসবের সর্বজনীনতার চেহারার কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি। নানা সম্প্রদায় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলার মানুষজন প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে পূজা উদযাপন করতে গেছে। আজ মনে হয়, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সেটা আসলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত একটা বিদ্রোহই ছিল, সংঘবদ্ধ না হলেও।
স্কুল পর্যায়ে পাবনায় থাকার সময়ে আমরা, মানে যারা সনাতন ধর্মের কাঠামোর বাইরে ছিলাম, সনাতন ধর্মের বন্ধুদের সঙ্গে আরতি দিয়েছি। আরতিদানের পরে একসঙ্গে ভোগও খেয়েছি মজা করে। আমাদের পাড়ার গোবিন্দবাড়ির মণ্ডপে ষষ্ঠী থেকে শুরু করে নবমী পর্যন্ত বিভিন্ন পাড়ার বিভিন্ন বয়সের কত-শত মানুষের সঙ্গে যে দেখা হয়েছে তখন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! হু! মনেও দোলা দিয়ে গেছে কোনো কিশোরী, কোনো তরুণী! কিন্তু, কি পাবনায় বা ঢাকায়, মণ্ডপে কোনো মেয়েকে উত্যক্ত হতে দেখিনি কোনোদিন! বরং দেখেছি, মণ্ডপে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে অনেকের ভেতরেই।
আশির দশকের শুরুর সেই সময়টার কথা বলি। দশমী চলে এলে আমার ভীষণ দুঃখ হতো এই ভেবে যে—যাহ্! মাস্তি সব শেষ হয়ে গেল! আর কোনো উৎসবের আনন্দ রইল না জীবনে! এখন তো আর পড়াশোনা করা আর স্কুলে মাঠে খেলা ছাড়া আর কিছুই করা হবে না! উৎসব বলতে যে আমেজ, সাজসজ্জা, জাঁকজমক, প্রাণের স্ফূরণ আর বিশালত্ব বোঝায়, তা সর্বজনীন দুর্গোৎসব ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানে ছিল কি?
ছিল না। কাজেই নবমী শেষ হলেই আমি মুষড়ে পড়তাম। বিজয়ার দিনে মুখ কালো করে মণ্ডপের চত্বরে বসে থাকতাম।
ঢাকায় থাকার সময়ে আমাকে রামপুরা খালে প্রতিমা বিসর্জন দিতে যেতে দেওয়া হয়নি কোনোদিন। আমি যখন স্কুল শেষ করছি, তখন বিসর্জন-যাত্রায় অংশ নেওয়ার অনুমতি পেলাম। সেটা পাবনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি। মনে পড়ছে, বিকালে গোবিন্দবাড়ির সামনে পাঁচ-টনি একটা ট্রাকে প্রতিমা তোলা হচ্ছে। গড়িয়ে গড়িয়ে পাবনা শহরের আব্দুল হামিদ রোড ধরে শীতলাই বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে ট্রাক। শীতলাই বাড়ির পেছনের ইছামতির অংশে প্রতিমাকে বিসর্জন দিয়ে হবে। অসিত, ডিগনা, সুলতান, রেজা, খোকা, মুকুল, তুষার—আমার এসব বন্ধুর সঙ্গে ঢোলের তালে তালে ট্রাকের পিছে পিছে নাচতে নাচতে চলেছি। ট্রাকের মাইক থেকে ধ্বনি উঠছে—দুর্গা মাই কি! জয়! তার সাথে গলা মেলাচ্ছি আমরা সকলেই। রাস্তার আশপাশের বাসাগুলোর জানালা থেকে তখন বিসর্জনযাত্রা দেখার জন্য উপচে পড়ছে মা-ঝিরা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মানুষজন, যাদের অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে সামিল হচ্ছে পদযাত্রায়।
শীতলাই বাড়ির পেছনের ইছামতি নদীর অংশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নেমে পড়ছে। আমরা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দিচ্ছি; ক্লান্ত, অবসন্ন মনে পাড়ায় ফিরছি তারপর। বিজয়ার দিনে বিসর্জনযাত্রায় যোগ দিতে কেউ আমাদেরকে বারণ করছে না; বলছে না যে সনাতন ধর্মাবলমম্বীভিন্ন আর কেউ অংশ নিতে পারবে না! এমনই ছিল আমাদের সেই সময়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
এই চেতনা আমরা বুকের রক্ত ঢেলে অর্জন করেছিলাম বিজাতীয় পাকিস্তানবিরোধী ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানসহ সুদীর্ঘ সব আন্দোলন এবং মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে!
ঢাকা, ২৩ অক্টোবর ২০২০
- লেখক: কথাসাহিত্যিক