চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে বরিশাল ছাড়ছে ফরচুন গ্রুপ
সস্তা শ্রমবাজার আর জমির কম দামের কারণে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম থেকে বরিশালে তার জুতা তৈরির ছোট কারখানাটি সরিয়ে এনেছিলেন মিজানুর রহমান। তারপর শুধুই সাফল্য।
পরের কয়েক বছরে রপ্তানি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় তার কোম্পানি ফরচুন শুজ । এমনকি চলমান কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও ১২০ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে স্থানীয় চাঁদাবাজদের দৌরাত্মে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পরে মিজানুরের জন্য। জীবন আর ব্যবসা বাঁচাতে আবারো কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
গাজীপুরের আশুলিয়াতেও ফরচুন শুজের একটি সচল কারখানা আছে। কারখানা ভবনেই খালি পড়ে আছে ১.৫৯ লাখ বর্গফুটের বিশাল জায়গা। বরিশাল বিসিকের কারখানাগুলো সম্ভবত সেখানেই পুনঃস্থাপন করা হবে।
তবে ভাড়া নিতে অন্য প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গেও তার আলোচনার কথা জানান আলোচিত উদ্যোক্তা।
''মহামারির কারণে আশুলিয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ওইসব কারখানার মালিকেরা আমাকে অত্যন্ত কমদামে তাদের ভবন ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। ভাড়া নিতে ইতোমধ্যেই দুই জন কারখানা মালিকের সঙ্গে আমার আলোচনাও হয়েছে,'' ফরচুন গ্রুপ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন।
ফরচুন শুজ বরিশালের বিসিক শিল্পাঞ্চল ছাড়া মাত্র জীবিকা বিপন্ন হবে ৫ হাজার কর্মীর। এদের সিংহভাগই হচ্ছেন আশেপাশের গ্রামে বসবাসকারী নারী। বাছাই করে চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি, তাদের দক্ষ পাদুকা কারিগর হিসেবে গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দিয়েছে ফরচুন।
অন্যদিকে, বিসিক হারাবে ৩শ' কোটি টাকা দামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। শিল্পখাতে বরিশালের মতো পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাফল্য অর্জন করেছিল তার একটি ছিল মিজানুরের কোম্পানিটি।
এর আগে গত শনিবারের এক অপ্রীতিকর ঘটনার প্রেক্ষিতে মিজানুরের সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত হয়। এদিন চাঁদা দাবি করে তার বাণিজ্যিক গ্রুপটির এক পরিচালকের উপর হামলা করে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট এক দল চাঁদাবাজ। তাদের দাবি মোতাবেক অর্থ দিতে রাজি না হওয়াতেই আক্রমণের শিকার হন ওই পরিচালক।
ওই ঘটনার পাঁচদিন অতিবাহিত হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। তাই ব্যবসা সহযোগী পরিবেশের অভাবেই বরিশালের বিসিক এলাকা ছেড়ে ঢাকার আশুলিয়ায় ফরচুন গ্রুপের সব কারখানা পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন মিজানুর।
বৃহস্পতিবার তিনি জানান, 'আগামী রোববারেই কারখানা সরানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেব।'
ঘোষণার চার মাসের মধ্যে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ হবে। আলোচিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হবে যাবতীয় প্রস্তুতি।
গত ২৪ অক্টোবর ফরচুন গ্রপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এমজে ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক শফিউল আলমের ওপর হামলার ঘটনায় কাউনিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।
কিন্তু, পুলিশ গত ২৬ অক্টোবর অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। মামলা দায়েরের পর অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো তৎপরতা চালায়নি, বলে আক্ষেপের সুরে জানান মিজানুর।
'ওই ঘটনার পর শিল্প সংক্রান্ত নানা উৎস থেকে আমাকে বিরক্ত করা হয়,' তিনি জানিয়েছেন।
ফরচুন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমানুর রহমান বলেন, 'কারখানা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আমরা সেখানে দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের জানিয়েছে। আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে তা সাধারণ কর্মীদের জানানো হবে।'
'বরিশাল ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এতে পরিচালনা খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি কারখানা পুনঃস্থাপনে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হবে,' তিনি যোগ করেন।
এব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন মানিক বলেন, ফরচুন কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একথা তাকে কেউ জানায়নি।
'এখন যেহেতু জানতে পারলাম, তাই আমরা এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের চেষ্টা করব। সমস্যাটি সমাধানে চেষ্টা করা হবে,' তিনি বলেছেন।
কর্মীদের ভাগ্যে কী আছে?
কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেদোয়ান বলেন, ''ফরচুন গ্রুপ চলে যাওয়ার অপ্রত্যাশিত খবর শুনে আমি মানসিকভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা খাই। প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে আমি সব কর্মীর দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছি, তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু, এখন কারখানা পুনঃস্থাপনের পর আমি তাদের চাকরির নিরাপত্তা দিতে পারব না, যা খুবই বেদনাদায়ক।
মুখ্য নির্বাহী জানান, বরিশালের স্থানীয় অর্থনীতিতে কোম্পানিটি একটি সম্পদ হিসেবে এতদিন কাজ করেছে। ব্যবসার সামাজিক দায়িত্ব পালন-সহ ত্রাণ সহযোগীতাও দেওয়া হয়েছে। মহামারিকালে কারখানার আশেপাশের এলাকায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের ত্রাণ বিতরণের কথা জানান তিনি।
কারখানাগুলোর উপর প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলেও রেদোয়ান উল্লেখ করেন।
কর্মীরা তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বিসিক শিল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন।
শ্রমিক নেতা শারমিন আক্তার বলেন, 'স্থানীয় প্রশাসন আর পুলিশের দুর্বলতার কারণে আমাদের কোম্পানি কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বলে জানতে পেরেছি।'
সুলতানা নামের এক কর্মী জানান, 'গত আট বছর ধরে কোম্পানিতে কাজ করছি। কারখানা সরিয়ে নিলে- পরিবার নিয়ে দুর্ভোগে পড়ব। বাড়িতে অসুস্থ মা'কে একা রেখে ঢাকা গিয়ে চাকরি করার উপায় নেই।'
কারখানার আরেক শ্রমিক নেতা ইভা বেগম জানান, বরিশালে কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ হলে এসব কর্মীর পরিবার অনাহারে দিন কাটাবে।
শারীরিকভাবে অক্ষম হলেও কোম্পানির টেকনিশিয়ান পদে আছেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, ব্রেইন স্ট্রোকের পর কাজ করতে না পারলেও গত দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন তিনি।
সিরাজুলের চেহারায় ছিল বিপর্যস্তের দশা। দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানান, কোম্পানি ঢাকা চলে গেলে, ভিক্ষে করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।
ফরচুন শুজ বরিশালের সর্ববৃহৎ শিল্পোদ্যোগ, এর ৯০ শতাংশ কর্মীই হচ্ছেন নারী। ফরচুন বরিশালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিলে তাদের অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়বেন।
প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া:
বরিশাল বিসিক অঞ্চলের উপ-মহাব্যবস্থাপক জালিস মাহমুদ বলেন, 'সব উদ্যোক্তার জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে আমি কাজ করছি। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হলে বিসিক এলাকা নিরাপদ হবে।'
যেকোনো মূল্যে ব্যবসার নিরাপদ পরিবেশ এবং তা উদ্যোক্তা সহযোগী রাখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন বরিশালের ডিসি আজিজুর রহমান। ব্যবসার পরিবেশ কাউকে নষ্ট করতে দেওয়া হবে না, বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
'বিসিক এলাকায় সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, আমি তা সমাধানের চেষ্টা করছি,' ডিসি আশ্বাস দেন।
এব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার দাবী করেন, 'বরিশাল শহর এবং বিসিক এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতি হয় এমন কিছুই ঘটেনি।'
বরিশাল সদরের সাংসদ এবং পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, 'তিনি কেন ফ্যাক্টরি সরিয়ে নিতে চান, সে সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির মালিকের উচিৎ সরকারকে জানানো। শ্রমিকদেরও এই মুহূর্তেই জানাতে হবে, যাতে তারা নিজেদের জীবিকা উপার্জন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।'
স্থানীয় সাংসদের বক্তব্য, 'কোম্পানি কর্তৃপক্ষ চাইলে আমি সব ধরনের সাহায্য করতেও রাজি আছি।'