স্থানীয় সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশের পোশাক খাত আমদানিকৃত সুতা, ফেব্রিকের দিকে ঝুঁকছে
পোশাক প্রস্তুতকারকরা, বিশেষত নিট পোশাকের উৎপাদনকারীরা ক্রমেই আমদানি করা সুতা ও ফেব্রিকের দিকে ঝুঁকছেন। অথচ স্থানীয়ভাবে এ শিল্পের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ, এই অবস্থায় দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি টেক্সটাইল খাতের প্রতিকূলতা বেড়েই চলেছে।
সতর্ক করে এই শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, আমদানি উৎসের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা স্থানীয় মিলগুলোর টিকে থাকাকেই বিপন্ন করতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাম্প্রতিক তথ্যেও উঠে এসেছে এই সংকটের মাত্রা। এতে দেখা যায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সুতা আমদানি ৩৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ২২৮ কোটি ডলারের রেকর্ড অঙ্কে। এছাড়াও, নিট পোশাক কারখানাগুলোর ফেব্রিক আমদানি ৩৮ শতাংশ বাড়ে, যা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে আরও ২৫৯ কোটি ডলার।
এসব আমদানির বড় অংশই করা হয় প্রতিবেশী ভারত থেকে, যা স্থানীয় সরবরাহকারীদের ওপর বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার চাপ আরও বাড়ায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় টেক্সটাইল শিল্পের ব্যাপক প্রসার ও বিনিয়োগ হয়েছে, তারপরেও এই ধরনের প্রবণতা যেন এক ধাঁধা।
করোনা মহামারির পরে স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প মালিকরা তাঁদের কারখানাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে প্রায় ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু, বর্তমানে শিল্পটি আমদানি উৎসের ক্রমবর্ধমান চাহিদাসহ, উৎপাদন পর্যায়ে নানামুখী চাপের মধ্যে থাকায়— এই বিনিয়োগের সুফলও মিলছে না।
এদিকে আমদানিতে ঝোঁকার জন্য আমদানি উৎসের প্রতিযোগী মূল্যের সুবিধাকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন পোশাক কারখানা মালিকরা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের কথাই, সম্প্রতি তারা ৪৮ লাখ ডলারের সমপরিমাণ পোশাকের ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এসব পোশাক উৎপাদনের জন্য প্রতিবেশী ভারত থেকে রিসাইকেল করা পলিয়েস্টার কটন আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিটি। রিসাইকেল করা তুলা ও পলিয়েস্টার তন্তু থেকে এই ফেব্রিকটি তৈরি করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো পর্যন্ত আমদানি করা এই ফেব্রিকের জন্য কোম্পানিটির খরচ হবে প্রতি কেজিতে ২ ডলার ১৯ সেন্ট। কিন্তু স্থানীয় স্পিনিং মিল থেকে ওই সুতা কিনতে হলে দাম পড়ে ২ ডলার ৪৫ সেন্ট।
এমবি নিট ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, "আমরা হিসাব করে দেখেছি, ৮০০ টন সুতা আমদানিতে আমাদের সাশ্রয় হবে ২ লাখ ৮ হাজার ডলার। কিন্তু স্থানীয় ইয়ার্ন (সুতা) কিনলে— ১.৩ শতাংশ ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) হিসাব করে, কর কর্তনের পর ৫৬ হাজার ডলার পাওয়া যাবে। ওই অর্থ বাদ দিলেও আমাদের সাশ্রয় হতো ১ লাখ ৪৮ হাজার ডলার।"
"তাহলে কোন যুক্তিতে আমি স্থানীয় টেক্সটাইল মিল থেকে ইয়ার্ন কিনতে যাব" – বলেন তিনি।
মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এরও সভাপতি। তিনি আরো বলেন, "আগে এমবি নিট মোট চাহিদার ২০ শতাংশ সুতা আমদানি করত, এখন প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি করছি।"
গত বছরে আমদানি করা সুতার ৮০ শতাংশই ভারত থেকে আনা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
একই কথা বলেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান– ফকির ফ্যাশন লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ। তিনি বলেন, "আমদানিকৃত প্রতি কেজি ইয়ার্নে আমাদের প্রায় ২০ সেন্ট করে সেভ হয়। ভারত থেকে আমদানি আমাদের জন্য ভায়াবল হচ্ছে। এক বছর আগে যেখানে আমাদের চাহিদার কমপক্ষে অর্ধেক সুতা স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করতাম, এখন তা কমে ৩০ শতাংশ হয়েছে।"
অবশ্য আমদানি বাড়লেও স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর বিক্রি কী পরিমাণ কমেছে, কিংবা প্রকৃত অর্থেই কমেছে কিনা, এমন তথ্য জানাতে পারেনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন- বিটিএমএ। তবে বিটিএমএ'র তথ্য অনুযায়ী, দুই বছর আগেও নিটওয়্যার রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ সুতা স্থানীয় মিলগুলো সরবরাহ করতো।
স্থানীয় টেক্সটাইল মিল প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না কেন
টেক্সটাইল মিল মালিকরা জানিয়েছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, বর্ধিত মজুরির কারণে দুই বছরের ব্যবধানে তাঁদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ, অন্যদিকে গ্যাসের সরবরাহও কমে গেছে। এই সময়ের মধ্যে টেক্সটাইল মিলগুলো নিজেদের সক্ষমতা বাড়ালেও — উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারছে না।
অন্যদিকে স্থানীয় সুতা ব্যবহারে দেওয়া নগদ প্রণোদনা আওয়ামী আমলে উল্লেখযোগ্য হারে কমানো হয়েছে। নগদ প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ এবং বিশেষ প্রণোদনা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আবার এসব প্রণোদনার অর্থ পেতে এক বছর সময় লেগে যায়, ১০ শতাংশ কর কর্তনের 10% কর্তনের পর আবার বাড়তি খরচও করতে হয়। এসব কারণে পোশাক রপ্তানিকারকরা স্থানীয় সুতা ব্যবহারে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছেন না।
আবার স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো দর কমাতে পারছে না, কারণ গত দুই বছর আগে শিল্পের গ্যাসের মূল্য সর্বোচ্চ ১৭৯ পর্যন্ত বাড়ানো এবং নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, ব্যাংক ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়া ও শর্ত কঠিন হওয়ার ফলে।
এর বাইরে প্রতিবেশী ভারত থেকে চোরাইপথে, এবং সরকারের নীতিগত দুর্বলতার পাশাপাশি বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ সুতা দেশের বাজারে প্রবেশ করছে বলেও অভিযোগ টেক্সটাইল মিল মালিকদের।
লিটল স্টার স্পিনিং মিল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলুম টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ৩০ কাউন্ট সুতার প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ এখন ৩ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমরা বিক্রি করি ৩ ডলার ১০ সেন্ট থেকে সাড়ে ৩ ডলার দরে। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় কোনো কোনো মিল মালিক এর চেয়েও কমে দরে বিক্রি করে— লোকসান ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।"
আমদানিকারকরা জানান, একই সুতা ভারত থেকে আমদানি করলে ২ ডলার ৯০ সেন্ট দর পড়ছে। যে কারণে স্থানীয় মিল থেকে কেনায় আগ্রহী হচ্ছেন না তারা।
আলম যিনি বিটিএমএ'র-ও একজন পরিচালক আরও বলেন, গত এক বছরে ৩০টির বেশি টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী এক বছরে এই বন্ধের সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে।
তার নিজের কারখানাও মাত্র ৪০ শতাংশ সক্ষমতায় উৎপাদন করছে উল্লেখ করে তিনি জানান, বর্তমানে দেশের স্পিনিং মিলগুলোর অর্ধেক সক্ষমতায় অব্যবহৃত রয়ে যাচ্ছে।
এমবি নিটের হাতেম বলেন, "সরকারের ভুল পলিসির কারণে বাংলাদেশের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প টিকতে পারবে না। আবার আমদানিনির্ভর হবে। আগের সরকারের সময়, পরিকল্পিতভাবে দেশের টেক্সটাইল শিল্পকে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এটি করা হয়েছে।"
বিটিএমএ'র হিসাব অনুযায়ী, দেশে স্পিনিং, ফেব্রিক, ডায়িং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং মিলসহ টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা প্রায় ১,৯০০টি, যেখানে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ২২ বিলিয়ন ডলার।
বিজিএমইএ'র হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশের কিছু বেশি। এরমধ্যে নিটওয়্যার রপ্তানি হয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।
ভারত কি ডাম্পিং মূল্যে রপ্তানি করছে?
তুলার নিজস্ব উৎপাদন বা জোগান থাকায় বাংলাদেশের চেয়ে সুতা উৎপাদনে বাড়তি সুবিধা পায় ভারত। এরপরেও দুই দেশেই উৎপাদন খরচের ব্যবধান কম, বা প্রতি কেজিতে প্রায় ৩ ডলার।
এজন্যই প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে ভারতের সুতা রপ্তানিকারকরা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছে?
বিটিএমএ'র সহসভাপতি সালেউধ জামান খান বলেন, টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিকারকদের বাড়তি আর্থিক ও নীতিগত সুবিধা দেয় ভারতের সরকার। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার পর্যায়ে তারা এসব সুবিধা পায়, ফলে প্রতিযোগিতায় তারা এগিয়ে থাকে।
আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "ভারতের টেক্সটাইল রপ্তানিকারকরা একটি নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টের সুবিধা পায়, যেখানে রপ্তানি মূল্যের ৩.৮৮ শতাংশ বা প্রতি কেজিতে ১১ রুপির সুবিধা—এরমধ্যে যেটি কম সেটি দেওয়া হয়। এই সুবিধাটি রেমিশন অব ডিউটিজ অর ট্যাক্সেস অন এক্সপোর্টেড প্রোডাক্টস (আরওডিটিইপি) নামে পরিচিত।"
এছাড়াও, ভারতের রপ্তানিকারকরা টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানির ওপর ২ শতাংশ শুল্ক ছাড় পায়। সবমিলিয়ে এই প্রণোদনাগুলি তাদের মোট রপ্তানি মূল্যের প্রায় ৬ শতাংশ।
ভারতের বাণিজ্যিক পোর্টালে বলা হয়েছে, রপ্তানিকৃত পণ্যে প্রদত্ত কর ও শুল্ক যেন রপ্তানিকারকরা ফিরে পান সেজন্য আরওডিটিইপি স্কিম তৈরি করা হয়েছে। এটি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হয়েছে। এছাড়া, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সরকারও টেক্সটাইল উদ্যোক্তাদের বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকে।
সালেউধ জামান, যিনি এনজেড টেক্সটাইল লিমিটেডের-ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিযোগ করেন যে, 'এসব প্রণোদনার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে ডাম্পিং মূল্যে সুতা বিক্রি করছে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা।'
এর বিপরীতে ভারতের সুতার উপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের দাবি জানান তিনি। যদিও তিনি তার এই দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দেননি।
কোনো দেশ যখন অন্য দেশের বাজারে তাদের নিজস্ব বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য রপ্তানি করে, তখন তাকে ডাম্পিং বলা হয়।
'ব্যবসার ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, সে চেষ্টা করতে হবে'
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকরা মাত্র ১২ শতাংশ ট্যাক্স দিচ্ছেন, যেখানে স্বাভাবিক করহার ২৭.৫ শতাংশ।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ করতে চলেছে, এই অবস্থায় করদাতাদের অর্থ দিয়ে পোশাক বা টেক্সটাইল শিল্প মালিকদের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেওয়া টেকসই হবে না।
তাই প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তার বদলে— ব্যবসার ব্যয় কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, "তবে তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট, বন্দর, ব্যাংকিং, কাস্টমসহ অন্যান্য পাবলিক সার্ভিস সহজ করাসহ— এসব উপায়ে খরচ কমিয়ে আনার মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সক্ষম করা যেতে পারে।"