বরেন্দ্রের মাটিতে কমলা
রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে কমলা চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষক মতিউর রহমান। রাজশাহী অঞ্চলের মধ্যে তিনিই একমাত্র কৃষক যিনি উষ্ণ তাপমাত্রার বরেন্দ্র অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কমলার চাষ করে বাজারজাতকরণ করছেন। শুধু তাই না, কমলার মাতৃগাছ থেকে কলমের মাধ্যমে লক্ষাধিক চারা উৎপাদন করে সারাদেশে বিক্রি করছেন। আমের দেশে কমলা চাষের এই সফলতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জামতলা এলাকায় মতিউর রহমান প্রতিষ্ঠিত 'মনামিনা কৃষি খামার' এ বর্তমানে সাড়ে পাঁচশো কমলার গাছ রয়েছে তার। তিনি ২০১৬ সালে দেশের বাইরে থেকে অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান, ম্যান্ডারিন ও চীনা জাতের কমলার গাছ এনে তার কৃষি খামারে লাগান। ২০১৯ সাল থেকে কমলা বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়। সে বছর তিনি ২ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেন। গাছে গাছে প্রচুর কমলা ধরলেও এবছর এখনো কমলা বিক্রি উপযোগী হয়নি। তবে তার প্রত্যাশা এ বছর কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করা যাবে।
গত রোববার (৯ নভেম্বর) মতিউর রহমানের মনামিনা কৃষি খামারে গিয়ে দেখা যায়, গাছে গাছে প্রচুর হলুদ রঙের কমলা ধরেছে। সেইসব কমলা দেখতে তার বাগানে জেলার উচ্চপদস্থ কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা প্রতিদিন পরিদর্শনে আসছেন। পরিপক্ক হলে অনেকেই খামার থেকেই কমলা কিনে নিয়ে যান। খামারেই প্রতি কেজি কমলা বিক্রি হয় দেড়শো থেকে ২০০ টাকায়।
কমলা উৎপাদনের পাশাপাশি মতিউর রহমান কমলার মাতৃগাছ থেকে এ বছর ৩০ হাজার কমলার চারা উৎপাদন করেছেন, এখান থেকেই তার ভালো আয় হবে বলে মনে করেন।
মতিউর রহমান বলেন, আগামী বছর ১ লাখ কমলার চারা উৎপাদন করে বাজারজাত করার লক্ষ্য রয়েছে। আকারভেদে প্রতি পিস কমলার চারা বিক্রি হয় ৮০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়। সারাদেশে থেকে কৃষকরা এসে তার কাছ থেকে চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। তার প্রত্যাশা এবছর গড়ে ৩০ লাখ টাকার কমলার চারা বিক্রি হবে।
মতিউর রহমান জানান, বর্তমানে আমি বিদেশি ছয়টি জাতের কমলা চাষাবাদ করছি এবং কমলার গাছ থেকে চারা উৎপাদন করছি। এবার আমার এসব গাছে প্রচুর কমলা ধরেছে কাজেই আমার প্রাথমিক পরীক্ষা সফল হয়েছে আমি বলতেই পারি। আমার প্রত্যাশা দেশে প্রচুর পরিমাণে কমলা উৎপাদন করে বিদেশেও রপ্তানি করা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সরফ উদ্দীন বলেন, কমলা বিদেশি ফল হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় যেকোনো জায়গা চাষাবাদ করা সম্ভব। বাংলাদেশে কয়েক ধরনের কমলার চাষাবাদ হলেও দুই ধরনের কমলা বেশি চাষাবাদ হয়। তা হচ্ছে বারি কমলা-২ ও বারি কমলা-৩। ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম ওজনের ছোট কমলাকে বারি কমলা-২ এবং ১৫০ থেকে ১৬০ গ্রাম ওজনের বড় কমলাকে বারি কমলা-৩ বলা হয়। এইসব কমলা দেশে উদ্ভাবিত না হলেও বিদেশের জাত যখন দেশে চাষাবাদ হয় তখন দেশীয়ভাবে সেসবের নামকরণ করা হয়। কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এসব কমলা চাষাবাদের জন্য চাষাবাদ পদ্ধতিও তৈরি করেছেন। বুকলেট ও লিফলেট আকারে তা প্রকাশও করা হয়েছে। কেউ যদি তা মেনে চাষাবাদ করে তাহলে অবশ্যই সফল হতে পারবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের কমলার চাষ হচ্ছে বলে জানান তিনি। রোগবালাই তেমন না থাকায় কমলা চাষে কৃষকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ারও কিছু নেই।
তবে কমলা চাষে ব্যাপক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। খুবই যত্মবান না হলে কমলা টিকিয়ে রাখা কঠিন। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে কমলা নষ্ট হয়ে যায়। আবার পানি জমে থাকলেও কমলার গাছ মরে যেতে পারে। তাই কমলা চাষে খুবই যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। যত্নের সাথে চাষাবাদ করলে কমলা বিক্রি করে লাভবান হওয়া সম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু কমলা না, মতিউর মাল্টা, পেয়ারা, আমসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিশ্র ফলবাগানেও সফল একজন কৃষক। ফলজ, বনজ ও ভেষজ মিলে তার ৭১ বিঘার পাঁচটি বাগানে ৬৬টি প্রজাতির গাছ রয়েছে। যার মধ্যে ১৫ বিঘা তার নিজের জমি। বাকি জমি লিজ নেওয়া।
মতিউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত 'মনামিনা কৃষি খামারে' মাল্টার গাছ রয়েছে সাড়ে তিন হাজার, পেয়ারার গাছ রয়েছে সাড়ে তিন হাজার, বিভিন্ন প্রজাতির আমের গাছ রয়েছে ২ হাজার। এছাড়া রামবুটান, অ্যাভোকাডো, ডুরিয়ানসহ নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় ফলের চাষও করেন তিনি। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছেন কমলা, মাল্টা, পেয়ারা ও আম।
মতিউর রহমানের তথ্যমতে, প্রতিবছর পেয়ারা ও আম বিক্রি করেন তিনি ৩০ লাখ টাকার, মাল্টা বিক্রি করেন ১৫ লাখ টাকার। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত নার্সারী থেকে কমলার চারাসহ প্রতিবছর ১ লাখ চারা উৎপাদন করে বিক্রি করেন। যার মধ্যে বেশিরভাগ কমলা ও মাল্টার চারা। যেখানে প্রতি পিস মাল্টার চারা বিক্রি হয় ৬০ থেকে ১২০ টাকা করে।
প্রতিবছর তিনি তার নার্সারী থেকে চারা বিক্রি করেন ৮০ লাখ টাকার, খরচ বাদ দিয়ে শুধু চারা বিক্রি করেই তার প্রতিবছর লাভ হয় ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ তার মনামিনা কৃষি খামার থেকে প্রতিবছর কমলা ৫ লাখ, মাল্টা ১৫ লাখ, পেয়ারা ও আম ৩০ লাখ এবং চারা ৮০ লাখ টাকার বিক্রি হয়। অর্থাৎ বছরে তিনি তার খামার থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার চারা ও ফল বিক্রি করেন।
মতিউর রহমান জানান, তার খামার দেখভালের জন্য তার অধীনে ২৫ জন লোক কাজ করে। শুধু তাইনা, তাকে এসব কাজে সহযোগিতার জন্য তার স্ত্রী, তার উচ্চ শিক্ষিত ছেলে, মেয়ে ও ছেলের বউও তাকে সহযোগিতা করেন। ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
মতিউর রহমান জানান, ২০০০ সালে তিনি ৭ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ফলদ বাগান শুরু করেন। এরপর সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ২০০৬ সালে তিনি জামতলায় ১৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন মনামিনা কৃষি খামার। মতিউর রহমান নামের আদ্যক্ষর 'ম', তার স্ত্রী নাসিমা রহমান থেকে 'না', তার মেয়ে উম্মে মুসলিমা মিতু থেকে 'মি' ও ছেলে নাইজার আহমেদ নাহিদ থেকে 'না' নিয়ে তিনি মনামিনা কৃষি খামার প্রতিষ্ঠিত করেন।
তিনি এই খামারে ২০১৪ সাল থেকে ফল বিক্রির পাশাপাশি নানা চারা উৎপাদন করে বিক্রি শুরু করেন।
মতিউর রহমান জানান, আমি সবসময় স্বপ্ন দেখেছি সবুজের। তাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি যদি ঠিক মতো সময় দিতে পারি, তাহলে গাছপালা আর ফল ফসলে চারদিক ভরিয়ে দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করবো। এই সংগ্রাম আমার নিজের সাথে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৃক্ষ রোপণে অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০১৫সহ স্থানীয় অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সয়েলস) ড. মো. বখতিয়ার হোসেন বলেন, মতিউর রহমানের চাষাবাদ পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার কারণে বরেন্দ্রের মতো অঞ্চলে তিনি কমলা ও মাল্টার সফল চাষ করতে পেরেছেন। জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য তার কমলা ও মাল্টার রঙ ও আকৃতি ভালো এসেছে। শুধু তাই না, তিনি সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পানির অপচয়রোধ করে স্প্রিংলার পদ্ধতিতে শুধুমাত্র গাছের গোড়াতেই পানি দেন। এছাড়া বিষমুক্ত ও জৈবসার পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যমসম্মত ও গুণগত মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন করেন। এইজন্য কৃষি গবেষণা কাউন্সিল থেকে প্রকাশিতব্য 'হ্যানড্রেড টেকনোলজি অ্যাটলিস্ট' বইয়েও তাকে নিয়ে প্রতিবেদন থাকছে।