ম্যারাডোনার সাফল্য আকাশ ছোঁয়া, কিন্তু বিপজ্জনকভাবে অন্ধকার তাকে গ্রাস করেছিল
ভোরের আলো সবে ফুটবে ফুটবে করছে, তবু এরমধ্যেই গত বৃহস্পতিবার আর্জেন্টিনায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে তৈরি হয় অপেক্ষমাণ জনতার ঢল। নানা গণমাধ্যমের খবর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১০ লাখ ভক্ত-অনুরাগী সেদিন বিশ্ব ফুটবলের মহানায়ক দিয়াগো ম্যারাডোনাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন। আজ শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) তাকে সমাহিত করা হয়।
তবে বৃহস্পতিবার প্রাসাদের অভ্যন্তরে রাখা ম্যারাডোনার কফিন শেষ নজর দেখতে আসা মানুষের ভিড় এক মাইলেরও বেশি লম্বা ছিল বলে জানিয়েছে সিএনএন।
হবেই বা না কেন! এইতো সেই আর্জেন্টিনা- ম্যারাডোনার প্রিয় জন্মভূমি। এইতো সেই বুয়েন্স আয়ার্স, এ নগরেই তো আছে তার সাধের ক্লাব-বোকা জুনিয়ার্স। ক্লাব ফুটবলে তার প্রথম অভিষেক তো সেখানেই। তাইতো পড়ন্ত বিকেলেও শেষ হয়নি শ্রদ্ধা নিবেদন। রাতভর শহরের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হয় কিংবদন্তির অজস্র ম্যুরাল। দেয়ালচিত্রগুলো হয়ে ওঠে প্রার্থনা কেন্দ্রের মতো, যার সামনে দাঁড়িয়ে বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য মন্ত্রপাঠ চলেছে সারা রাত।
আর বোকা জুনিয়ার্স! তার প্রতি আঙ্গিনা ভরে ওঠে জ্বলন্ত মোমবাতির আলোয়। কংক্রিটের মসৃণ মেঝে ঢাকা পড়ে যায় ফুলের শয্যায়।
আর্জেন্টিনোরা শুধু প্রার্থনা করেননি, প্রয়াত জাতীয় বীরের জীবনকে উদযাপনও করেছেন। উপন্যাসের ট্র্যাজেডির মতো ম্যারাডোনার জীবনের নাটকীয় উত্থান-পতনের স্মৃতিচারণ করেন তারা।
বোকা জুনিয়ার্সের বিখ্যাত হোম গ্রাউন্ড- লা বোম্বোনেরা স্টেডিয়ামে কোনো আলো জ্বলেনি। শুধু ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত বক্সে জ্বলছিল একটি বাতি।
গত বুধবার ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর থেকে এভাবেই শোকের মাতম চলছে আর্জেন্টিনা জুড়ে। প্রত্যেকেই যেন অনুভব করছেন খুব কাছের কোনো প্রিয়জন হারানোর বেদনা।
ইতোপূর্বে, গত বৃহস্পতিবার থেকেই তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ। তবে এই তিনদিন কিছুই নয়, ম্যারাডোনার অনুপস্থিতি আরও বহুকাল অনুভব করবে আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনো সাংবাদিক মারসেলা মোরা ই আরাজো সিনএনএন' স্পোর্টসকে বলেন, ''আমাদের জাতীয় পরিচয়ে অনেকভাবেই ঐক্য যোগ করেছে ফুটবলের সংস্কৃতি। সমাজবিজ্ঞানীদের আরও বহু বছর এই বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ বুঝতে গবেষণা করতে হবে।''
''যে ক্রীড়ার মাধ্যমে মানুষ নিজের পরিচয় খোঁজে, এবং পৃথিবীতে সেই ক্রীড়ার সবচেয়ে বিখ্যাত যে খেলোয়াড়- স্বাভাবিকভাবেই তিনি জাতীয় প্রতীকে পরিণত হন। এজন্যেই ম্যারাডোনা ছিলেন আমাদের জাতীয় সম্পদ। তার মৃত্যুতে সমগ্র দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো,'' আরাজো বলছিলেন।
তার ভাষায়, ''ম্যারাডোনাকে নিয়ে সবার কম-বেশি আবেগ আছে। তার বিতর্কিত জীবন নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু, সবকিছুর পরও তিনি আর্জেন্টাইন জাতীয় পরিচয়ের একদম কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন।''
দিনশেষে তাই ম্যারাডোনাই হচ্ছেন আর্জেন্টিনার 'গোল্ডেন বয়', তার প্রজন্মের সব থেকে সেরা খেলোয়াড়। আর ফুটবল ইতিহাসের সব সেরাদের একজন।
১৯৮৬ সালে আর্জেটিনার বিশ্বকাপ জয়ের আগেই জাতীয় আইকন হয়ে উঠেছিলেন তিনি, কোয়ার্টার ফাইনালে নিজ পারফরম্যান্সের বদৌলতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে। ফকল্যান্ড যুদ্ধে পরাজয়ের শোধটা সেদিন ম্যারাডোনা নিয়েছেন, এমন উপলদ্ধি হয়ে আর্জেন্টিনোদের। ওই জয়ই ছিল দেশটির ইতিহাসে তার নাম চির-অম্লান রাখার যোগ্য।
তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপাধি ছিল 'ফুটবল ঈশ্বর'।
ম্যারাডোনার জীবন নিয়ে অনেক গল্পগাঁথা রচনা হয়েছে। চলেছে সংবাদের বিশ্লেষণ। কিন্তু, তার হাজারো ভুল-ত্রুটির মধ্যে অনুরাগীরা হয়তো নিজেদের প্রতিচ্ছবিই দেখেছে।
বুয়েন্স আয়ার্সের দরিদ্র ভিলা ফিওরিটো এলাকায় জন্ম দিয়াগোর। তিনি নিজের চেষ্টায় দারিদ্র্য থেকে উঠে আসেন, কিন্তু নিজের শেকড়কে কখনো ভোলেননি। এই একটি অপবাদ তার ঘোর সমালোচকও দিতে পারবে না।
আরাজো বলেন, ''নিজ যোগ্যতায় সাবলীল। অথচ সব-সময় ভুল করার ঝুঁকিতে থাকা এক ব্যক্তিত্ব। অনেক ভঙ্গুর, শোকে কাতর। আবার সেই মানুষটিই অসাধারণ মেধাবী, বিধাতার আশীর্বাদধন্য- মনে হয় ঠিক যেন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা নায়ক। আমরা সকলেই আসলে কিছুটা তার মতো। ম্যারাডোনা তাই সকল মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি সকলের।''
''মানুষের মতো ভুল করার গুণটিই তার সবচেয়ে বড় আবেদন। অতি-মানবের মতো কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই গুণ দেখা যায় না। কিন্তু, ম্যারাডোনা তাইতো ছিলেন। তাই তার ভুলত্রুটি যেন আমাদের আশ্বস্ত করে বলে; মানুষ যখন ভুলতো চলার পথে হতেই পারে।''
- সূত্র: সিএনএন