এবছর কিছু ব্যাংকার বোনাস পাওয়ার দাবি রাখেন
আগামী বছর মূলধনের ব্যবধান কীভাবে রক্ষা করা উচিৎ অচিরেই সেই সংক্রান্ত দিক-নির্দেশনা জারি করবে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি)। কিন্তু জুলাই থেকেই শীর্ষ কর্মকর্তাদের লভ্যাংশ প্রদান এবং শেয়ার পুনঃক্রয়ে কার্যত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্থগিত আছে তাদের বেতনভাতা বৃদ্ধির মতো জরুরি পরিবর্তন।
এব্যাপারে ইসিবির পুনঃপর্যালোনায় শেয়ারের লভ্যাংশ প্রদান আংশিকভাবে চালু করা হতে পারে। তারপরও অবশ্য ব্যাংকারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা অনেক কঠিন হবে।
কারণটা অবশ্যই মহামারি। ইতোপূর্বে, মহামারি মোকাবিলায় নেওয়া একাধিক বার্ষিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বন্ড ক্রয়ের মাত্রা বাড়ানো হয়।
ফলে পুঁজিবাজার লাভ করে ফলদায়ক প্রণোদনা। বন্ডের মতো স্থায়ী আয়ের শেয়ার থেকে ২০২০ সালে মুনাফার অংকটাও বাড়ে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলোতে।
অবশ্য সকল বন্ডে বিনিয়োগ নিরাপদ নয়, জরুরি মুহূর্তে করা ক্রয়ের দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকিও আছে। তাই ব্যাংকারদের অযাচিতভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে এমন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আসবে বলেও নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
গত গ্রীষ্মে ইউরো জোনের ব্যাংকারদের উদ্দেশ্যে লেখা এক নোটে ইসিবি সতর্ক করে: বৈশ্বিক সঙ্কটের মাঝে আর্থিকখাতের কর্মীদের নানা প্রকার সেবা অনুসারে বেতনভাতা দেওয়ার ঝুঁকি খাটো করে দেখা উচিৎ হবে না।'
তবে ঝুঁকি থাকলেও কর্মীদের বাড়তি অর্থ দিয়ে ক্ষতিপূরণে ব্যাংকগুলোর চেষ্টাকে বাধা দেওয়া ইসিবির উচিৎ হবে না। তাতে করে দক্ষ কর্মীরা যেমন পুরস্কৃত হবেন, তেমনি কর্মস্পৃহাকেও মূল্যায়ন করা হবে। ওয়ালস্ট্রিটের শীর্ষ বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো ইউরোপীয় বাজারে যে ভূমিকা রাখছে, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
ক্রিশ্চিয়ান লাগার্দের নেতৃত্বাধীন ইসিবি স্বীকার করে নিয়েছে যে, জেপিমরগ্যান চেজ অ্যান্ড কো.- এর মতো বৃহৎ মার্কিন ব্যাংক ইউরোপের বন্ড বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করেছে। অর্থাৎ, ঝুঁকি অনেকখানি বহন করছে ওয়ালস্ট্রিট। এই বিষয়টি সহজে উপেক্ষা করা উচিৎ হবে না। ইসিবি বিধি-নিষেধ দিলে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এসব দক্ষ ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের সুযোগ পাবে মার্কিন ব্যাংকগুলো। ফলে নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারবে ইসিবি।
রাজনৈতিক জটিলতা এড়াতে ইউরোপের ব্যাংকগুলো তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ডিফারেড পে বা তাদের বর্ধিত আয় পরবর্তীতে প্যাকেজ ব্যবস্থায় দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদানের চাইতে কোম্পানি শেয়ার পুরস্কার দেওয়াটা হবে সঠিক পদক্ষেপ। আর পুরস্কৃত শেয়ারের মালিকানা কমমূল্য পেয়ে লাভবান হচ্ছেন, ব্যাংকারদের মধ্যে অন্তত এটুকু সান্তনা তো কাজ করবেই।
স্থায়ী আয়ের উৎসে (বন্ডে) বিনিয়োগ চলতি বছর প্রায় সবখানেই উচ্চগতি লাভ করে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এ ধরনের উৎসে বিগত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি আয় বেড়েছে। কোয়ালিশন ডাটা'র মতে, প্রায় এক যুগের মধ্যে শীর্ষস্থান অতিক্রম করে ফেলার কাছাকাছি ছিল এ সাফল্য। অথচ তারপরও কী পরিমাণ এ ব্যবসা করা উচিৎ সেটা নিয়ে ভেবেই নিজেদের অংশীদারিত্ব সীমিত রেখেছে ইউরোপের ব্যাংকগুলো।
সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে মার্কিন ব্যাংকগুলো। দেশটির বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চলতি বছরে বৈশ্বিক বন্ড বাজারের আরো ৩ শতাংশ পয়েন্ট দখল করেছে। ওয়ালস্ট্রিটের সেরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী আয়ের ব্যবসা পরিচালনায় যখন দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বাড়াচ্ছে, ঠিক তখনই ইউরোপের ব্যাংকগুলো বন্ড বাজার সংক্রান্ত কর্মীর সংখ্যা ৫ শতাংশ কমিয়েছে। যদিও, এটাই শেষ নয়, সামনে মেধা শক্তিক্ষয়ের আরো বড় ঝুঁকি রয়েই গেছে।
ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের তুলনায় অনেক বিবেচক সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই নিয়েছে যুক্তরাজ্যের নিয়ামক কর্তৃপক্ষ ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন অথরিটি- পিআরএ। ঝুঁকি পর্যালোচনার দুটি পরীক্ষার পর পর তারা কিছু কিছু ব্যাংকে কর্মীদের লভ্যাংশ প্রদান শুরু করার অনুমতি দেবে বলে জানিয়েছে।
অবশ্য, পিআরএ নগদ অর্থের মাধ্যমে বোনাস দেওয়ার প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে দেওয়া উচ্চ সতর্কতা থেকে সরে আসেনি। পাশাপাশি, ব্যাংকগুলোর দেওয়া বাড়তি বেতন ও উপরি পরিশোধের উপর তীক্ষ্ম নজর রাখবে সংস্থাটি।
শেয়ারহোল্ডারদের পে-আউট ও বোনাসে একই পন্থা অনুসরণ করতে পারে ইসিবি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মূলধন রক্ষণশীল পদ্ধতির পাশাপাশি ঋণ বাজারকে সচল রাখতে পূর্বের কিছু বাধ্যবাধকতা শিথিল করে ইসিবি। ইতোমধ্যেই উন্নত বিশ্বে বিতরণের উপযোগী টিকা বাজারে চলে এসেছে আর টিকাদানের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের স্বাভাবিক গতিও ফিরে আসবে। তাই আবারও মূলধন ও তারল্যের কঠোরতর সংজ্ঞায় ফিরে যেতে পারেন নিয়ন্ত্রকেরা। তখন ডিভিডেন্ট রিটার্ন আর শেয়ার পুনঃক্রয়ের সুবিধা লাভক্ষতির অংকে চুলচেরা বিশ্লেষণের পর অনুমোদন পাবে। তাছাড়া, নির্ভরযোগ্য অনুমান এবং বিনিয়োগের বিপরীতে প্রদত্ত সুদের ঊর্দ্ধগতির রেখাচিত্র সেক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হবে।
তবে মনে রাখা দরকার, সব ব্যাংক আকারে ও ব্যবসায় সমান নয়, আর সেইভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। যেমন; স্পেনের বিবিভিএ এসএ, ইতালির সানপাওলো এসপিএ এবং নেদারল্যান্ডসের ইঞ্জ গ্রিওপ এনভীর মতো বড় ব্যাংকিং সংস্থা বিপুল অর্থের স্তূপের ওপর বসে আছে। সেখান থেকে কিছুটা অবশ্যই শীর্ষ কর্মী শেয়ারহোল্ডারদের ফেরত দেওয়া প্রয়োজন।
- লেখকদ্বয়:
মার্কাস অ্যাশওর্থ: ইউরোপীয় বাজার বিষয়ক ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক
জনাথন টাইস: ব্লুমবার্গের হয়ে ইউরোপের ব্যাংকিং খাত কাভার করেন