বিশ্ব রাজনীতিতে ‘দিশেহারা’ যুক্তরাষ্ট্রকে কতোটা টিকিয়ে রাখতে পারবেন বাইডেন?
আগামী ২০ জানুয়ারি। দিনটি একই সঙ্গে যেমন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সারা বিশ্বের জন্যেও। কারণ এই দিনে চেয়ার বদল হবে বিশ্বক্ষমতার এক নম্বরে থাকা মানুষটির। পতন হবে 'পাগলাটে, ক্ষ্যাপা আর স্বেচ্ছাচারী' প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের, হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসবেন বয়সের সংখ্যাকে হার মানিয়ে এগিয়ে যাওয়া, অপূর্ব প্রাণশক্তিসম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব জো বাইডেনের।
২০ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে এক সামরিক প্রস্তুতি। বলা যেতে পারে অনেকটা ইরাক আফগান যুদ্ধ কিংবা পৃথিবীর অন্য প্রান্তের যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাবাহিনী যেভাবে নিজেদের প্রস্তুত করে সেভাবে দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্য এবং রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন ন্যাশনাল গার্ড সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। সেখানে এমন এক অবস্থা বিরাজ করছে যে ওয়াশিংটন ডিসিতে যেখানে ২০ হাজার ন্যাশনাল গার্ডের থাকা এবং ঘুমানোর কোন জায়গা নেই। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তারা বিভিন্ন ভবনের ফ্লোরে সশস্ত্র অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে, পরিকল্পনাহীনভাবে সশস্ত্র ন্যাশনাল গার্ড নিয়োগ কতটা সহায়ক হবে তা ২০ জানুয়ারিতে বোঝা যাবে।
ধারণা করা হচ্ছে ২০ জানুয়ারিতে জো বাইডেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করতে অথবা মার্কিন বিভাজনের রাজনীতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে ট্রাম্পের অনুসারীরা নতুন উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওইদিন দেশজুড়ে সশস্ত্র বিক্ষোভ হতে পারে এমন ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই দিয়েছে মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। নিরাপত্তা প্রস্তুতির ধরণ দেখে এটা এখন অনেকটাই অনুমেয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফের গৃহযুদ্ধের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।
দ্বিতীয়বারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইম্পিচমেন্ট নিয়ে যা আশা করা হয়েছিল, তা এবারও ঘটেনি। রিপাবলিকান দলের মাত্র ১০ জন রিপ্রেজেন্টেটিভ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসন করার জন্য ডেমোক্র্যাটদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। ধারণা করা হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে ঘটা নজিরবিহীন সেই ঘটনায় আরো অনেক রিপাবলিকানদের ডেমোক্র্যাটদের উদ্যোগের সঙ্গ যোগ দেবে, তবে তা ঘটেনি। তবুও প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হয়েছে ট্রাম্প। তবে সিনেটে তা আটকে থাকবে বলেই এখন পর্যন্ত ধারণা করা হয়েছে। মার্কিন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান দলের নেতা ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছেন, সিনেটে ইমপিচমেন্ট শুনানির জন্য বিশেষ অধিবেশন ডাকার কোনো সুযোগ এই মুহুর্তে নেই।
এই মুহুর্তে ট্রাম্পকে ইমপিচ করতে নেওয়া উদ্যোগ প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেশি বিভক্ত করছে এবং এই বিভক্তি একটি কমপ্লিট সিভিল ওয়ারের দিকে যায় কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে জো বাইডেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান এবং তাকে কেন্দ্র করে যে সামরিক প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে, তা বিশ্ববাসীকে আতঙ্কিত করে তুলছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পূর্বে কিছুদিন আগে ট্রাম্পের উপদেষ্টারা বিশ্বরাজনীতির নতুন কৌশলপত্র ঠিক করেছে। এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এখন এশিয়ার দেশ ভারত। মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘকালের অস্ত্র ব্যবসা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসছে। সেখানে সবসময় নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করতো। জায়গাটা ছিল বিশ্ব পরাশক্তিদের অস্ত্র বিক্রির প্রধান প্রাণকেন্দ্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান মুসলমানদের পরাজয়ের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ত্রিশের দশকে তেলের খনি আবিষ্কারের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব পৃথিবীর কাছে বাড়তে থাকে। সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সংকট সৃষ্টি হয়। ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে মতদ্বৈধতা বৃদ্ধি পায়। একদিকে ইহুদী এবং খ্রিষ্টানরা অবস্থান নেয় অন্যদিকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান। এর পরিণতিতে দীর্ঘকাল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র ব্যবসা একটি রমরমা অবস্থায় ছিল। সাম্প্রতিককালে ইসরাইলি সামরিক শক্তি, রাজনৈতিক শক্তি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকে অনেক শক্তিশালী হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে একটি সহঅবস্থান নীতির দিকে যাচ্ছে। মূলত সহাবস্থান নীতি যদিও কেবলমাত্র ওই দেশগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা গোষ্ঠীসমূহ নিজেদের প্রয়োজনেই করে তুলছে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে ইসরাইলের সঙ্গে সহাবস্থান ছাড়া তারা হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু এখনো মধ্যপ্রাচ্যের মূল জনগোষ্ঠী ধর্মীয় জায়গা থেকেই ইসরাইল বিরোধী অবস্থান নিয়ে রেখেছে। যদিও ইজরায়েলের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সহাবস্থান নীতিকে গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে না। ইজরাইল এখনো ফিলিস্তিন এবং গাজা উপত্যকায় তার বলপ্রয়োগের নীতি অব্যাহত রেখেছে। জো বাইডেনের প্রশাসন আগামীতে মধ্যপ্রাচ্যে কী ভূমিকা নেবে তা অনিশ্চিত।
জো বাইডেনের রাষ্ট্র পরিচালনার ভবিষ্যৎ সংকটময় করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন চিন্তা করে নতুন কৌশল ঘোষণা করেছে, যা প্রকারান্তরে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা ভারতে ফেরত নিয়ে আসার ইঙ্গিত। ভারত ইতোমধ্যেই সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। কয়েকদিন আগে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বিমান তৈরীর ঘোষণা দিয়েছে তারা। বিমান তৈরিতে ৪৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ভারতের গণমাধ্যম এবং ভারতের ধর্মীয় মৌলবাদীরা করতালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন। জো বাইডেনের প্রশাসন এই নতুন ধারণা আসলে কীভাবে গ্রহণ করবে সেটা একটা প্রশ্ন হবে।
আগামী দিনগুলো খুবই কঠিন হবে, যদিও ধরে নেওয়া যেতে পারে হয়তো শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে, কিন্তু চূড়ান্ত অর্থে মার্কিন প্রশাসনের এই বিভাজন বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। জো বাইডেনকে বেশিরভাগ সময় অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুকে মোকাবেলা করতে হবে। সন্দেহ মাথায় থেকেই যাচ্ছে ২০ শে জানুয়ারি কী ঘটবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে? আর একটা সিভিল ওয়ার শুরু হবে না মার্কিন সমাজ পারবে তাকে সামাল দিতে। ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ভবনে আক্রমণের সময় নিরাপত্তা গার্ডের নিষ্ক্রিয়তা আরো বেশি ভাবিয়ে তুলছে সারা বিশ্বকে।
মার্কিন সমাজের এই বিভাজন প্রকারান্তরে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে রাশিয়াকে। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে সমস্ত বিষয়গুলো ঘটছে তা মার্কিন প্রশাসন এড়িয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালের তাদের প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে বিষ প্রয়োগের ঘটনাসহ আরো বহু ঘটনায় মার্কিন রাজনীতি তেমন প্রত্যক্ষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি যা অতীতে সব সময় করতে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ সিভিল ওয়ার এ জড়িয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক ভয়ঙ্কর সংকট সৃষ্টি করবে। এই সংকটের বাইরে বেরোনোর কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। সাম্প্রতিককালের চীনের আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা যেভাবে পর্দার অন্তরালে হারিয়ে গেছেন তাতে অতীতে হয়তো মার্কিন প্রতিক্রিয়া দেখা যেত কিংবা ইউরোপের গণমাধ্যমের অন্যান্য অংশেও আরো বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। কিন্তু মার্কিন সামাজিক অবস্থার কারণে বিশ্ব আজ তার সমস্ত নজর মার্কিনীদের দিকে গভীরভাবে রেখেছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক