ঢাকার একজন বাইকার মিনিটপ্রতি ৬ বার লেন পরিবর্তন করেন
ঢাকার রাস্তায় বাইকারদের ট্রাফিক আইন অমান্য করা বর্তমানে নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায়ই তারা রাস্তার লেন পরিবর্তন করেন, রাস্তায় সিগন্যালে থেমে থাকা যানবাহনের পাশ কাটিয়ে সামনে এগুনোর জন্য তারা সাপের মতো আঁকাবাঁকা গতিতে বাকিদের পাশ কাটিয়ে জ্যামের সম্মুখপ্রান্তে পৌঁছান। অনেকসময় হেলমেট ছাড়াই চালকদের বাইক চালাতে দেখা যায়, বিশেষত ছোট রাস্তাগুলোতে। শুধু ঢাকাই নয়, পুরো দেশেরই সার্বিক চিত্র অনেকটা এরকম।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তায় একজন বাইকার প্রতি মিনিটে অন্তত ৬ বার লেন পরিবর্তন করেন। একারণেই বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যই দায়ী বাইকাররা।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে সারাদেশে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার ৯৭ জন, আহত হয়েছেন ৪২৩ জন।
২০২০ সালে সারাদেশে ৩৫৫৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে, তার মধ্যে ৩০ শতাংশই ছিল বাইক দুর্ঘটনা। ২০১৬ সালে সারাদেশে বাইক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৩৩৬। গত ৫ বছরে সারাদেশে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। গত বছর ওয়াশিংটনে ট্রান্সপোর্টেশন রিসার্চ বোর্ডের ১০০তম বার্ষিক সভায় উপস্থাপিত গবেষণায় এ তথ্য জানানো হয়।
গবেষণাটিতে আরও দেখা যায়, ট্রাফিক আইন মেনে না চলার কারণে প্রায় অর্ধেক বাইকারই গুরুতর দুর্ঘটনার আশঙ্কায় রয়েছেন। বাইকারদের ঘনঘন লেন পরিবর্তনের প্রবণতাকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে এমন পূর্বাভাস দেয়া হয় গবেষণাটিতে। ঢাকা শহরের ৪৫১জন বাইকারের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। এদের অনেকেই গড়ে প্রতি মিনিটে ২-৬ বার লেন পরিবর্তন করেন।
গবেষণাটির নেতৃত্বে থাকা বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো হাদিউজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা এসব তথ্য জানতে পেরে বিস্মিত হয়, এবং গবেষকদের এবিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানান।
"মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দিয়েছি আমরা," বলেন তিনি। মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরি ও বাইকারদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরামর্শও দেন গবেষকরা। বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর ব্যাপারে বাইকারদের মধ্যে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের বাইকারদের মধ্যে সচেতনতা প্রসারের ব্যাপারে জোর দেন তারা।
রমনা ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট শেখ ইমরান হোসেন টিবিএস-কে বলেন, আশেপাশের অন্যান্য যানবাহনের অবস্থান বিবেচনা না করেই বাইকাররা যেভাবে বেপরোয়াভাবে বাইক চালান, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
"প্রায়ই তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং এরফলেই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিদিনই রাস্তায় বাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু রাস্তায় জায়গা আগের মতোই আছে। কারণেই বাইকাররা তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তাড়াহুড়ো করে বাইক চালান।" বলেন তিনি।
এদিকে প্রতিনিয়তই বাইক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বেশিরভাগ আহত ব্যক্তিরাই ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং দুর্ঘটনার শিকার হিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের বাকি জীবন দুর্ঘটনার ফল ভোগ করতে হয়।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) তথ্যানুযায়ী ট্রাইক আইন ভঙ্গ করে বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোই বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। বাইক দুর্ঘটনায় মৃত ও আহত বেশিরভাগ রোগীর বয়সই ৩০-৪০'র মধ্যে।
নিটোরের পরিচালক ডা. আব্দুল গনি মোল্লাহ টিবিএস-কে বলেন, তাদের ৩৫-৪০ শতাংশ রোগীই বাইক দুর্ঘটনার শিকার। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ দুর্ঘটনার ফলে হাত-পা হারান, বাকিরা সারাজীবন দুর্ঘটনার ভার বয়ে বেড়ান।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩১ লাখ মোটরসাইকেল আছে। তন্মধ্যে ১৩ লাখ চালকেরই লাইসেন্স নেই।
বুয়েটের এআরআই'র সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, বাইক চালানোর সময় বাইকাররা মানসম্পন্ন হেলমেট পরেন না। মাত্র ১০ শতাংশ চালক ও চালকের পেছনের আরোহীদের মাত্র ২ শতাংশ মানসম্পন্ন হেলমেট পরিধান করেন। শুধু হেলমেট পরিধানই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
এআরআই'র পরিচালক ড. মো হাদিউজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনার শিকার বেশিরভাগ রোগীই মস্তিষ্কের আঘাতের কারণে মারা যান, একারণেই হেলমেট ব্যবহার করা এতো জরুরি। "কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হেলমেটের মান যাচাইয়ের জন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাই কাজ করছে না। ফলস্বরূপ, নিম্নমানের হেলমেটে বাজার ছেয়ে গেছে, ক্রেতারাও এসব হেলমেট কিনে উপকৃত হচ্ছেন না।"
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের (আরএসএফ) তথ্যানুযায়ী, বাইকাররা নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণেই ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ এসব দুর্ঘটনার জন্য বাইকাররাই দায়ী। অন্যদিকে পেছন থেকে অন্যান্য যানবাহনের ধাক্কা বা চাপা দেয়ার ফলে ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মুখোমুখি সংঘর্ষ, বাইক পথচারীদের ধাক্কা ও চাপা দেয়ার ফলে ঘটে ১২ শতাংশ দুর্ঘটনা।
নিরাপদ সড়ক চাই'র প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এখনও যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। "গ্রামাঞ্চলের বাইকাররা হেলমেট ব্যবহারই করেন না, শহুরে বাইকাররা হেলমেট পরলেও তা নিম্ন মানসম্পন্ন। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে একটি বাইকেই ৩-৪ জনকে উঠতে দেখা যায় যার ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে," বলেন তিনি।
"বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরীক্ষা নেয়া ছাড়াই বিআরটিএ লাইসেন্স দিয়ে দেয়। এব্যাপারটি বন্ধ করতে হবে। একইসাথে লাইসেন্স ছাড়া বাইক বিক্রি বন্ধ করতে হবে।" যোগ করেন তিনি।
ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, "বাইক চালানো ও ট্রাফিল আইনের ব্যাপারে বাইকারদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাবও আছে। বেশিরভাগ বাইকারই তরুণ প্রজন্মের, দ্রুত গতিতে বাইক চালানোর ঝোঁক থাকে তাদের। ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যাও আরও বাড়তে থাকে।"
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর যথাযথ বাস্তবায়ন, নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি, ফুটপাথ স্থাপন ও হাইওয়েতে অবৈধ স্থাপনার জায়গা পুনরুদ্ধারের ব্যাপারেও জোর দেন তিনি।
বিআরটিএ'র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, তারা সবার জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। "সব নিয়ম মেনেই আমরা লাইসেন্স দিয়ে থাকি। জনগণকে সড়ক নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন করারও চেষ্টা করছি আমরা।" বলেন তিনি।