কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করা উচিত!
১৯২৩ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন হেনরি কিসিঞ্জার, এখন তার বয়স ৯৮ বছর।
১৯৩৮ সালে জার্মানিতে হিটলারের ইহুদি নিধনের সময় পরিবারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ১৫ বছরের হেনরি কিসিঞ্জার। কিসিঞ্জারের পরিবারও ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিল। মার্কিন রাজনীতির এই ব্যক্তিত্ব ১৯৬৯ সাল থেকেই আমেরিকার রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে আর্বিভূত হয়।
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে তিনি ছিলেন। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৩, এই সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তার নানা কর্মকাণ্ডের কারণে তুমুলভাবে সমালোচিত-আলোচিত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিসমাপ্তির ঘটনায় চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব তার নেতৃত্বেই সম্পন্ন হয়েছিল। ওই সময়ে পাকিস্তান হয়ে গোপনে চীন সফর সেই দশকের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল। পরবর্তীকালে নিক্সনের ভ্রমণও সংঘঠিত হয়েছে কিসিঞ্জারেরই সময়েই।
১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, এবং তাকে এই নোবেল প্রাইজ দেওয়া নিয়েও প্রবল বিতর্ক দেখা দিয়েছিল: কিসিঞ্জারকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার বিরোধিতা করে সেই সময় নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। এতদিন পর কেন এই কিসিঞ্জারকে স্মরণ করছি!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও হেনরি কিসিঞ্জার প্রাসঙ্গিক নানাবিধ কারণে। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বর্বর হামলার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার প্রশাসন অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছেন। শেষের দিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধের পরিসমাপ্তির প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। কারণ তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে পরাজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ, সাথে ভারতীয় সৈন্যদের প্রচলিত যুদ্ধকৌশল পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। সেই সময় হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশের জন্ম যেন না হয়- সেই লক্ষ্যেই জন্যজাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বারবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করার কৌশল নেন। সোভিয়েত ইউনিয়নও তখন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য, কিসিঞ্জারের উদ্দেশ্য সোভিয়েত ভেটো প্রদানের মধ্য দিয়ে নস্যাৎ হয়ে যায়। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
বাংলাদেশের জন্মের পরেও কিসিঞ্জার বাংলাদেশের বিপক্ষেই ছিলেন, নানাভাবে তিনি বাংণলাদেশকে ভুগিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের পাট ও পাটের থলে রপ্তানির চুক্তির কথা বলে মার্কিন খাদ্য সহায়তা-সংক্রান্ত পিএল-৪৮০ বন্ধ করে দেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্টের ভাষ্য পিএল-৪৮০ আইনে উল্লেখ আছে, যারা কিউবার সঙ্গে ব্যবসা করে, তারা মার্কিন খাদ্যসহায়তা পায় না।
কিসিঞ্জারের বাংলাদেশকে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি বলার পেছনেও বাংলাদেশের অস্তিত্বকে খাটো করারই প্রচেষ্টা। আজ কিসিঞ্জার জীবিত, তার একটা সাক্ষাৎকার নেওয়া দরকার এদেশের গনমাধ্যমের। তার কাছে জানতে চাওয়া উচিত, আপনার সেই কথিত তলাবিহীন ঝুড়ি আজকে পৃথিবীর ৩৫তম অর্থনীতি এবং যে দেশটির বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা ৩২৫ বিলিয়ন এর অধিক, এই সক্ষমতা অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে ৫০০ বিলিয়ন পৌঁছে যাবে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যেই।
এখন সামনে সাম্রাজ্যবাদী চক্র নতুন কোনো ষড়যন্ত্র করে কিনা সেটা দেখার ব্যাপার। বাংলাদেশ যে সক্ষমতা অর্জন করেছে রপ্তানির ক্ষেত্রে এবং যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয়েছে তা হল- পোশাক শিল্প। এই পোশাক শিল্পের ক্রেতারাও পশ্চিমা বিশ্বের, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেও। একারণেই কেবলমাত্র পোশাক শিল্পের উপর যেন আমরা নির্ভরশীল না থাকি, সেদিকেও আরও মনোযোগী হতে হবে। পোশাকশিল্প শ্রমঘন একটি শিল্প। পোশাক শিল্পের বিকাশ যতটা ঘটেছে পাশাপাশি অন্য শিল্পগুলোর যথেষ্ট বিকাশ ঘটে নাই। আমাদের সরকারের এদিকটায় আরও নজর দিতে হবে, আরও নজর দিতে হবে আমাদের সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকেও। আমাদের গণতন্ত্র যেন আরও বেশি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। আমরা যেন কোন ধরনের পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের শিকার না হই- সেব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অস্তিত্ব বিরোধিতায় লম্বা একটা সময় কাটিয়েছে, ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তখন ক্ষমতায় ছিল কিসিঞ্জারের দল রিপাবলিকান পার্টি। প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেরাল্ড ফোর্ড। 'মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যা' নামক এক বইয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে এই ঘটনার নাড়ি-নক্ষত্র সব জানতো তা তুলে ধরা হয়েছে, মার্কিন দলিল থেকেই। বইটিতে পাওয়া যায় ১৫ আগস্ট ঘটনার নায়ক কর্নেল ফারুক হত্যকাণ্ড ঘটানোর আগেই মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। বইটির প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন। লেখক প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৩ নভেম্বর যে ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে, তখন অভ্যুত্থান রচনাকারী সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও পাল্টা আক্রমণের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটি অংশের দিক থেকে। এই ঘটনার পরই ১৫ আগস্ট ঘটনার সঙ্গে জড়িত কুশিলবদের তাৎক্ষণিকভাবে দেশের বাইরে প্রেরণে মার্কিন সহযোগিতা ছিল, বইটিতে এই তথ্যেরও উল্লেখ আছে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জেরাল্ড ফোর্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন, ১৯৭৫ উত্তর বাংলাদেশের সামরিক সরকারের বৈধতা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের ভাবতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার নিজের স্বার্থেই সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
পৃথিবীর অন্যান্য ভূখণ্ডসমূহের, জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় না তারা--এভাবেই তাদের কতৃত্ববাদ চালু আছে। আজকে দেখি নানান ইস্যুতে মার্কিন স্বার্থ একটু বিঘ্নিত হলেই বিভিন্ন দেশকে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়। এখানে একথা উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারকে কিন্তু কোন মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই ঘটনাকে প্রকারান্তে সমর্থনই করেছিল।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং সামরিক স্বার্থে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রশ্নেও নিশ্চুপ থাকছে। ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করছে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের অভিযোগ তুলে; কিন্তু যখন ইয়েমেনে গণহত্যা ঘটছে তখন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চুপ। বিস্ময়ের কিছু নেই আসলে- বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোনালী ইতিহাস বরাবরই এমন।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক