বিরান পাহাড়কে সবুজ বনে রূপ দিতে দুই যুগ ধরে লড়েছেন যে প্রকৃতি যোদ্ধা
একসময় লোকে তাকে পাগল ডাকত। নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই বহুবার তিনি উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে এই মানুষটি একক প্রচেষ্টায় আড়াইশ হেক্টর অনুর্বর পর্বতাঞ্চলকে অরণ্যে পরিণত করেছেন। নিজ গৃহের চারধারে বট আর ডুমুর গাছের আচ্ছাদনে প্রকৃতিকে দিয়েছেন এক নতুন রূপ। এক সময়ের অবহেলিত এই মানুষটি এখন জননায়কে পরিণত হয়েছেন।
ইন্দোনেশিয়ার বৃক্ষপ্রেমী সাদিমানের গল্প যে কাউকে অবাক করবে। নিজ প্রচেষ্টায় তিনি হারিয়ে যাওয়া এক মৃত জঙ্গলকে জীবনদান করেছেন। সাদিমানের প্রচেষ্টার শুরু ১৯৯০ সাল থেকে। তবে জঙ্গলের কাহিনীর সূত্রপাত আরও আগে, ১৯৬০ সালে। সে সময় এক ভয়াবহ দাবানলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শত শত হেক্টর পাইন জঙ্গল আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর থেকেই অঞ্চলটি অনুর্বর বিরানভূমিতে পরিণত হয়। কয়েক দশক ধরে ওনোগিরি অঞ্চলের ডজনখানেক গ্রাম খরা এবং দুর্ভিক্ষের সাথে লড়াই করে। কিন্তু এরপরেই মৃত জঙ্গলের চিত্রপটে ভিন্নধর্মী এক নায়কের আবির্ভাব ঘটে। নিজের এবং সম্প্রদায়ের সকলের মঙ্গলের কথা ভেবে সাদিমান নতুন করে জঙ্গলের ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।
মধ্যবয়সী গবাদি পশুপালক সাদিমান প্রথমবারের মতো অনুধাবন করেন যে, গ্রামের আশেপাশে গাছপালা না থাকার কারণেই খরা এবং বিশুদ্ধ পানি সহজলভ্য নয়। দুঃখজনকভাবে, তিনি একাই দীর্ঘ সময় ধরে এই সমস্যা নিয়ে পড়ে ছিলেন। কর্তৃপক্ষ কিংবা স্থানীয় কারও এবিষয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তার থেকেও বাজে বিষয় ছিল যে, মানুষজন তাকে পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। এমনকি তার প্রচেষ্টাকেও নিরর্থক বলেও ঘোষণা দেন তারা।
সত্যি বলতে, একজন মানুষ শত শত হেক্টর জঙ্গল ফিরিয়ে আনবেন এমন কথা শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু, আমরা পৃথিবীর বহু জায়গায় এর আগেও এমন বহু উদাহরণ দেখেছি। সাদিমানও এই কঠিন কাজটি করে দেখিয়েছেন। শুধু করে দেখালেন বললে ভুল হবে, কেননা তিনি রাতারাতি স্থানীয় একজন নায়ক বনে গেলেন। তবে, এই অর্জনটির জন্য তাকে এক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
সাদিমান নিজের টাকায় বটের চারা কেনা শুরু করলেন। কখনো কখনো চারা কিনতে, নিজের গবাদি পশুও বিক্রি করতে শুরু করলেন। গ্রামের মানুষ এসময় তাকে 'মাথাখারাপ লোক' বলে ডাকা শুরু করল। তারা বুঝতে পারছিল না যে, কেন কেউ এরকম একটি কাজ করতে যাবে। অনেকে ভাবত গাছগুলো আসলে ভূতের আড্ডাখানা। তবে ক্রমাগত বাধা এবং সঙ্গীদের থেকে উপহাসের শিকার হওয়ার পরও সাদিমান থেমে ছিলেন না।
প্রায় প্রতিদিন ইন্দোনেশিয়ান এই কৃষক অনুর্বর পাহাড়ি অঞ্চলে বট এবং ডুমুরের চারা রোপন করতে শুরু করলেন। তিনি জানতেন, এই গাছ দুটি পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে বেশ উপকারী। সাদিমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, যথেষ্ট পরিমাণ বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে খরা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে। বলাবাহুল্য যে তার ভাবনায় কোনো ভুল ছিল না…
ধারণা করা হয়, ২৫ বছরে সাদিমান নিজ হাতে প্রায় এগারো হাজার গাছ রোপন করেছেন। তবে, ফলাফল লাভে তাকে আরও এক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সাদিমানের লাগানো হাজার হাজার গাছ পরিণত অবস্থায় পৌঁছালে, সেই অঞ্চলে অন্যান্য গাছপালাও জন্মাতে শুরু করে। শীঘ্রই নতুন সব কিশলয়ে ছেয়ে যায় মৃত এই জঙ্গল।
ওনোগিরি অঞ্চলের কৃষকরা একসময় পানির সংকটে যেখানে বছরে মাত্র একবার ফসল ফলাতে পারতেন, সেখানে এখন নিশ্চিতভাবেই বছরে দুই থেকে তিনবার ফসল তুলতে পারেন। সাদিমানের বৃক্ষগুলো এ অঞ্চলে পানির স্বল্পতা দূর করেছে।
নিয়মিত বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় পর মানুষ গাছ লাগানোর উপকারিতা বুঝতে সক্ষম হল। মাথাখারাপ মানুষ থেকে সাদিমানকে ঘিরে হঠাৎ করেই শুরু হল নানা উদযাপন। তিনি পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সরকারের তরফ থেকে ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের প্রদানকৃত সর্বোচ্চ সম্মাননা- 'কালপাতারু' গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে সাদিমান 'কিক অ্যান্ডি হিরোজ' অ্যাওয়ার্ড পান।
সময়ের সাথে, ২৫ হেক্টর ঘন বনভূমিটি 'হুতান সাদিমান' বা সাদিমানের জঙ্গল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বনভূমিটি ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র। সাদিমানের এই জঙ্গল পরবর্তীতে স্থানীয় অনেককেই বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষ রোপনের জন্য অনুপ্রাণিত করে। একজন মানুষের আত্মপ্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়ের দরুণ কতটুকু অর্জন করা সম্ভব তার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে এই অরণ্য।
- সূত্র: অডিটি সেন্ট্রাল