শক্তিশালী উত্তরণ প্রবণতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে ভাইরাসের বৈশ্বিক উত্থান
কোভিড-১৯ সংক্রমণ নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার ঘটনায় ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে আরও গভীর বিভাজনের হুমকিতে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবগুলো ছড়িয়ে পড়লে বা ভোক্তা চাহিদার উৎস হ্রাস পেলে অবশ্য বিশ্বের সার্বিক প্রবৃদ্ধিও ক্ষতির মধ্যে পড়বে।
মহামারি শুরুর পর গত সপ্তাহেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হন। চলতি সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ার করে বলেছে, ইউরোপ ছাড়া বিশ্বের অন্য সর্বত্র সংক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। এই বৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে ভারত ও ব্রাজিলের বিপুল দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা। আর্জেন্টিনা ও তুরস্কেও ভাইরাসের বিস্তার আশঙ্কাজনক।
ইতোপূর্বে বিশ্ব অর্থনীতির ইতিবাচক পুনরুদ্ধার নিয়ে যে শক্তিশালী প্রবণতার আশা করা হয়েছিল এই পরিস্থিতি তার উপর ফেলেছে সংশয়ের কালো ছায়া। বলাবাহুল্য, এমতাবস্তায় সমতার মাধ্যমে সকলকে টিকাদানের ব্যর্থতায় জীবাণুর নতুনতর ও মারাত্মক অভিযোজনের হুমকিকে অত্যন্ত বাস্তব করে তুলেছে। অভিযোজিত ভাইরাসের ধরনের প্রাথমিক শিকার এখন উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো হলেও- অচিরেই যে তা মহামারির আঘাত কাটিয়ে ওঠার পথে থাকা উন্নত দেশের মাথাব্যথার কারণ হবে না- এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
তা যদি নাও হয়, ধনী ও দরিদ্র দেশে দুই রকমের উত্তরণ গতি টিকাদানে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যাশিত রপ্তানিকে সীমিত করবে, যার ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা যাবে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্রে। গত মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানায়, চলমান স্বাস্থ্য সঙ্কটের দ্রুত অবসান না করা গেলে ২০২৫ সাল নাগাদ উত্তরণ পরবর্তী প্রবৃদ্ধি ৯ লাখ কোটি ডলার কম হবে।
মহামারি হানা দেওয়ার আগেই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশে অবদান রাখতো উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি সমূহ। কারণ এসব দেশে বাস করে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৮৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক চলতি সপ্তাহে এই দেশগুলোকে বলে, তারা যেন উত্তরণ গতি হারানোর সম্ভাব্য ঝুঁকি মাথায় রেখে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।
সতর্কবাণীর ভিত্তিও সবল- যেমন; বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতি ভারতে যখন সদ্য শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির আশা জেগেছিল, তখনই হানা দেয় সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ, যা রুখতে গিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের চলাচল নিষেধাজ্ঞা ও লকডাউনে বিপর্যস্ত হচ্ছে জীবিকা ও অর্থনীতির চাকা। অচলাবস্থার ফেরে পড়েছে ভারতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র মুম্বাই নগরীর মতো স্থান। গত সপ্তাহে প্রতিদিন সেখানে গড়ে ২ লাখের বেশি নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ে।
ব্যাংকিং সেবাদাতা সংস্থা স্কোটিয়াব্যাংক- এর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতি বিষয়ক প্রধান বিশেষজ্ঞ তুলি ম্যাককাল্লি বলেন, "সংক্রমণ সংখ্যা বৃদ্ধি আসলে বিশ্ব অর্থনীতির সামনে বাস্তবতার সঙ্গে প্রত্যাশাকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে; আর তাতে দেখা যাচ্ছে মহামারি সহসাই অবসান হওয়ার ধারেকাছেও নেই।"
তিনি আরও বলেন, নিম্ন আয়ের অনেক দেশ কোভিড সৃষ্ট নানাবিধ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে এবং তাদের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক হাল ফেরার আগে দীর্ঘপথ বাকি।"
ব্লুমবার্গের ভ্যাকসিন ট্র্যাকার অনুসারে, ১৭০টি দেশে এপর্যন্ত দেওয়া হয়েছে টিকার ৯৪ কোটি ৪০ লাখের বেশি ডোজ। আসলে এ পরিমাণ ডোজ ন্যায্যতার মাধ্যমে দেওয়া হলে তাতে বিশ্বের ৬.২ শতাংশ মানুষ টিকা পেতেন। কিন্তু, সেটা না হওয়ার কারণ হলো ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বৈষম্য, উচ্চ আয়ের দেশগুলো ২৫গুণ দ্রুতগতিতে টিকাদান চালাচ্ছে স্বল্প আয়ের দেশের তুলনায়।
জাপানি আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নোমুরা হোল্ডিংস ইঙ্কের বৈশ্বিক বাজার গবেষণা শাখার প্রধান রব সুব্রামণ বলেন, "আমার কাছে এই অবস্থাকে ভাইরাসের অভিযোজন গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টিকাদানের প্রতিযোগিতা বলে মনে হচ্ছে। অনেক মানুষই জানেন না, ১৯১৮ সনের স্প্যানিশ ফ্লু যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হয়ে তারপর ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লেও, সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে কিন্তু উদীয়মান বাজারগুলোই পড়েছিল। বর্তমান হাল যেন ইতিহাসের পুনঃরাবৃত্তির-ই অশনি সংকেত"
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত