ভাইরাসের প্রভাবকে বিপজ্জনকভাবে অস্বীকার করছে ভারতীয় পুঁজিবাজার
ভারতে করোনাভাইরাস বিপর্যয় সবার জন্যে আতঙ্কের হলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অথচ রাজধানীর নয়াদিল্লির হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে, জ্বলছে গণদাহের অজস্র চিতার আগুন। স্বাস্থ্যখাতের এই বিপর্যয় এরপর কোন শহরে মানবিক সঙ্কট চরম করে তোলে- তা নিয়েও উদ্বেগের শেষ নেই ভারতবাসীর। এই অবস্থায় পুঁজিবাজারের মন্দা চরমে ওঠারই কথা, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় মুনাফার প্রত্যাশায় উল্টো চিত্রই চোখে পড়ছে।
টানা ছয় মাস বিনিয়োগ প্রবাহ আসায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে স্থানীয় কোম্পানির বাজারমূল্য বা শেয়ারের দর। স্থানীয় অনেক লগ্নীকারী শেয়ার বিক্রি করতে চাইলেও তাদের আরও লাভের আভাস দিয়ে ঠেকাচ্ছেন তহবিল ব্যবস্থাপকেরা।
ভারতের শীর্ষ ৫০ কোম্পানির সমন্বিত গড় বাজারসূচক নিফটি ৫০ ভাইরাসের তাণ্ডবে সত্ত্বেও গত বুধবার এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করেছে। তবে মাঝারি ও বৃহৎ কোম্পানিগুলোর সার্বিক এমএসসিআই ইন্ডিয়া সূচকও স্ফীতি লক্ষ্য করেছে গত এক মাসে।
সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগ তহবিলগুলো পুঁজিবাজারে গ্রুপবদ্ধ একাধিক কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা করে থাকে, যাকে বলা হয় বাস্কেট ট্রেড। এর মাধ্যমে তারা নানা সংস্থার বিপুল পরিমাণ শেয়ার ধরে রাখে। চলতি বছরের জন্য যে আয়ের আভাস দেওয়া হয়েছিল ভারতের বাজারে বাস্কেট ট্রেডে এখন তার ২১গুণ বেশি মুনাফার আভাস দেওয়া হচ্ছে। উদীয়মান বাজার অর্থনীতির বৈশ্বিক সূচক এমএসসিআই ইমার্জিং মার্কেটস ইনডেক্সে যা অন্যতম আকর্ষণীয় প্রিমিয়াম। পুঁজিবাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আবার রুপির দরও বাড়ছে।
গত বুধবার বা বিগত ২৪ ঘন্টায় ৩ লাখ ৬০ হাজার নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়া সত্ত্বেও, বিনিয়োগকারীদের আশাবাদী বাণিজ্যের পেছনে কিছু বিষয় কাজ করছে। যেমন ভারতীয় অর্থনীতির গতি স্থির হলেও, গেল বছর লকডাউনের ফলে যেমন অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল- ততোটা হচ্ছে না। রয়েছে চলমান কোভিড-১৯ টিকাদান নিয়ে আশাবাদ, বছরের শেষ নাগাদ অর্ধেক জনসংখ্যা টিকা পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের নিজস্ব হিসাব অনুসারে, এপর্যন্ত ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ টিকার মাত্র এক ডোজ নিয়েছেন। অবশ্য, এটা জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশের চেয়ে বেশি এবং মুম্বাইয়ের মতো মহানগরগুলোয় টিকাগ্রহণের হার প্রায় দ্বিগুণ।
ডিজিটাল মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজ বিশাল সংখ্যক কর্মী গোষ্ঠী রপ্ত করে ফেলায়, অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনায় ইতিবাচক দিক যুক্ত হয়েছে। আসলে সঙ্কটের কারণে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় অনলাইনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা প্রযুক্তিগত অভ্যস্ততা এবং বিকাশে দ্রুত গতি এনেছে। সঙ্গে বিদেশি পুঁজির শক্তিশালী প্রবাহ ভারতীয় অর্থনীতিকে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে। বহিঃউৎসের লগ্নীর সুবাদে ভারতের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার সমমূল্যের, যা কিনা ২০১৩ সালের প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া, স্থানীয় উৎপাদকদের প্রণোদনা দেওয়া থেকে শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগও পুঁজিবাজারে একটি সমান ইতিবাচক আস্থা যোগ করেছে।
বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকদের ধারণা, উদীয়মান বাজারে অর্জিত মুনাফা অচিরেই উন্নত বিশ্বের বাজার মুনাফাকে ছাড়িয়ে যাবে। উন্নত দেশে সুদহার কম এবং কিছু স্থানে নেতিবাচক হওয়া যার প্রধান কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর বিশাল ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, যেখানে অব্যাহত ভোক্তাচাহিদা প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি।
এই চাহিদা দীর্ঘমেয়াদী বিবেচনায় সহজে প্রভাবিত হওয়ার নয়, বরং সঙ্কট কাটলে ফিরতে পারবে নিজস্ব গতিতে। একারণে ভারতের বৃহৎ শিল্পজোট রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও আর্থিক সংস্থা এইচডিএফসি ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে।
অবশ্য এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষুদ্র প্রতিযোগী চরম প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে এবং সবটাই শুভ লক্ষ্মণ নয়, মূল্যস্ফীতির উত্থান বাজারের সুদিনকে প্রভাবিত করতে পারে। ইতোমধ্যেই ভারতীয় প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধনের মাধ্যমে কমানো শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। কারণ সামান্য সরকারি সহায়তা পাওয়া জনগণের খরচের প্রবণতাকে হ্রাস করবে বাড়তি মূল্যস্ফীতি। আর একবার চাহিদা ঘাটতির মর্মান্তিক সেই পরিণতি দেখা দিলে বাজার মূল্যায়নে যে ধস নামবে সেই আগুনের আঁচ থেকে বড় প্রতিষ্ঠান বা বিনিয়োগকারী কেউই ছাড় পাবে না।
- সূত্র: রয়টার্স
- লেখক: রয়টার্স ব্রেকিংভিউজের মুম্বাই শাখার সহযোগী সম্পাদক, ইতোপূর্বে তিনি হংকং, দুবাই এবং লন্ডন শাখাতেও কাজ করেছেন।