পিতৃসত্য
শামীমার ধাক্কাধাক্কিতে মনে হয় যেনো ভূমিকম্প শুরু হয়েছে, এক্ষুনি ঘর ছেড়ে বাইরে দাঁড়াতে হবে খোলা আকাশের নিচে। নইলে ঘরের ছাদটাই ভেঙে পড়বে মাথায়। বাইরে তখন মেঘের আড়ালে দুষ্ট ছেলের মত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ভোরের সূর্য। প্রানপণে যে রোদ বিলাতে চাইছে, অথচ মায়ের কড়া শাসনের মতো মেঘ পরতে পরতে বাঁধা দিচ্ছে তাকে।
কথাটা বলতেই মুখ ঝামটায় শামীমা, যা না একখান ঘর, মাথায় পড়লে মাথাও শরম পাইবো। আসলেই ঘরটা খুব একটা ভালো নয় জেনেই ভাড়া নিয়েছে সে। ভাড়াওতো তেমনওই, আমানও পাল্টা মুখ ঝামটায়। আইসা যে একডা মাথা ঢুকানির ছাদ পাইছি, এইডাই বেশি। আমানের মুখ ঝামটায় খুব একটা বদলায় না দিনের রং। বরং আকাশে আরো গাঢ় মেঘ জমে। বৈশাখের প্রথম মেঘ। আকাশের এই পোচ পোচ কালো রঙ আমানের খুব প্রিয়। ছেলেবেলার স্মৃতিরা উৎপাত করে। কাঁচা আম, মরিচ মেশানো লবণ।পকেটে লুকানো ছুরি। কাদা মাখামাখি বাসায় ফেরা। আম্মার চড়-থাপ্পড়। কেউ যদি ফিরে যাওয়ার কথা বলে, মোটেই রাজধানী ঢাকা নয়। শৈশবে ফিরে যাবে সে।
ভাঁপ উঠানো ভাত আর সেদ্ধ আলু, কাঁচা মরিচ সরিষার তেল সাজিয়ে তাড়া দেয় শামীমা, নেন খাইয়া জলদি যান। তুফান ছুটতাছে।
সকালের মেঘ হিম বাতাস ছড়ায়। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করে। কত ইচ্ছের গলা টিপে ধরতে হয় জীবনের দায় মেটাতে!
বিছানা ছেড়ে খেতে বসে আমানউল্লাহ, আর শামীমার বকবক শুরু হয়। টিভিটা ছাড়লেই দেখি রোগী বাড়তাছে, শুনছি আবার লকডাউন দিবো সরকার। আইজ টাকাটা নিয়া ফিরলে, কাইলই ফ্রিজটা কিনমু। তারপর আর ওই মাইয়ার বাড়ির পথ ধরছো তো তোমার একদিন কী আমার একদিন! কোটি মানুষের একজন শামীমা। দিব্যি ভুলে গেছে তাণ্ডবের দিন। ফিরে গেছে প্রাত্যহিক অভ্যাসে।
ভাত খেতে খেতে ভেতরটা ধুক ধুক করে। সুনামগঞ্জ শহর থেকে ঘন্টা খানেক সময় লাগে সি এন জি অটোরিকশায় শাল্লা যেতে। গিয়ে যদি টাকাটা না পাওয়া যায়, শ, দুইশ ভাড়ার টাকাটাই মাটি। আশঙ্কাটা ভোরের সূর্যটার মতোই উঁকি দিয়েই আবার ত্রস্ত তাড়ার মেঘের অতলে হারিয়ে যায়।
বিধান বাবুর দরজায় লাগানো বিশাল তালাটা দেখে আমানউল্লাহর মাথায় বাজ পড়ে। সমাধানহীন ত্রিমুখী সমস্যা বজ্রপাতে ছাই হওয়া তালগাছের মতোই মূহুর্তে তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। অথবা তার নিজেকে মনে হয় একটা ব্রেকফেল গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা নিরুপায় ড্রাইভার। গভীর খাদে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আর বেঁচে উঠার কোন পথ নেই।
প্রাথমিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে হাতের মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বারকয়েক বিধান বাবুর নাম্বারটাতে ফোন দেয় সে। সুইচড অফ। বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে,আসার আগে একটা ফোন করে আসা উচিত ছিলো। ঘরে শামীমার ভয়েই দেয়া যেতো না ঠিক। কিন্তু সি এন জি স্ট্যান্ডে এসে দিতে পারতো।
ফোন করলেই বা কী হতো, না আসলে চলতো? হয়তো চলতো। তার দুইশ টাকা যাতায়াত ভাড়া বাঁচতো। এর বেশি তো তার সমস্যা কিছুই লাঘব হতোনা। বরং ফোন দিয়ে হতবিহবল হয়ে হয়তো শামীমার সামনে ঘটনাটা বলে বসতো আর ঘরে চরম অশান্তির শুরু হতো। এই মূহুর্তে যে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হলো সেই নিমজ্জন শুরু হতো আরো ঘন্টা কয়েক আগেই। শামীমা যে কথায় কথায় খোঁটা দিতো, হিন্দু ব্যাটার সাথে কেউ এত্তোগুলা টেকার রিস্ক নেয়,এরা সুযোগ পাইলেই ইন্ডিয়া যায়গা। আজ হাতেনাতে কথার সত্যতা পেয়ে আক্রমণের একটা শব্দও মাটিতে পড়তে দিতোনা। কিন্তু বিধান কাকারা গেলো কই!
বন্ধ তালার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকায় সে। ঠিক কোন ঘরটায় ঢুকে বিধানবাবুর খবর জিজ্ঞেস করা যায়। কাউকে না কাউকে তো জিজ্ঞেস করতেই হবে! প্রতিটি ঘরেই মৃত্যু নেমে আসার মতো নিস্তব্ধতা। ধ্বংসস্তুপের ফাঁকে ফাঁকে জীবন চালিয়ে যাওয়ার প্রাণহীন প্রাত্যহিকতা। উঠা, বসা ,খাওয়া জৈবিক আর আবশ্যিক তাড়া। এদেরকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা না করা সমান। তবু সেও নিরুপায়। একটা হদিস বের করার চেষ্টা তো করতেই হবে।
বাঁদিকের ঘরটায় ঢুকে সে। ঘরময় ভাঙা কাপ প্লেট, সোকেসের কাঁচ, স্টিল আলমিরার ভাঙা দরজা,ভাঙা ড্রয়ার, এবড়ো থেবড়ো কাপড়ের স্তুপ। দেয়ালে ঝুলানো দেবতার ছবির ভাঙা ফ্রেম। এর মাঝে হাঁটুরে লুঙ্গি পরে বসে আছেন যে বৃদ্ধ লোকটি, গলায় তুলসীর মালা। তাকেই কোন ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে আমানউল্লাহ, বিধান কাকারা কই গেছে জানেন? লোকটির স্থির চোখের পাতা মোটেই কাঁপে না এই প্রশ্নের ধাক্কায়। ত্রিকালজ্ঞ ঋষির মতো নির্বিকার তার বসে থাকা, মরা মাছের চোখের মতো নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। প্রশ্নটি শুনেছে কি শুনেছে না বুঝবার উপায় নেই। দ্বিতীয়বার একটু জোরে প্রশ্নটি করে আমানউল্লাহ। এবার ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ যেন মহাকালের সিঙ্গা বাজায়, জানিনা কই গ্যাছে, কইয়া যায় নাই। শুনছি ইন্ডিয়া গেছেগা।
ঠিক এই আশঙ্কাটাই ছিলো মনে মনে। এখন কোম্পানিকে সে কি জবাব দেয়, কি জবাব দেয় বউকে, জীবনটাই বা বাঁচায় কীভাবে! শোনা যাচ্ছে দ্বিতীয় দফা লকডাউন আসছে। এ যাত্রা এই চাকরিটা যদি যায় কই যাবে সে আবার চাকরি খুঁজতে? এতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় সাঁতার না জানা বালকের মতো হাবুডুবু খেতে খেতে মেয়েটা, নন্দিনীর কথা মনেই পড়ে না আমানউল্লাহর। অথচ ঘরে মেয়েটাকে নিয়েই নিত্য অশান্তি। কিন্তু প্রধান তিনটি সমস্যা তার ভাবনাকে তৎক্ষনাৎ এমন এক সমাধানহীন জটিল ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়, জীবন তার কাছে এক ঘুলঘুলাইয়ার মতো বোধ হয়। অপ্রধান সমস্যাটার কথা মনে পড়েনা তার। সেবারভতো যাই হোক মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলো, রাজধানী থেকে বাড়ি ফিরে একটা চাকরিও জুটে গিয়েছিলো। এবার বোধহয় উপায় নেই আর।
সেদিনটার কথা ভুলতে পারেনা শামীমা। ঘোর শত্রুর জীবনেও যেনো এরকম দিন না আসে। যেদিন অফিস থেকে ফিরে আমান বললো, আমাদের বোধহয় বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আমার চাকরিটা নাই। শামীমা কথাটা তেমন গায়ে মাখেনি। ঢাকা শহরের পাঁচ বছরের দাম্পত্যে এই নিয়ে তিনবার চাকরি ছাড়তে আর নতুন চাকরি ধরতে দেখেছে আমানকে। এবারও সেরকম কিছুই ভেবেছিল সে। কিন্তু এবার যে মহামারী সব উল্টেপাল্টে দিয়েছে, চাইলেও আমানের আর কোন চাকরি জুটবে না বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হয়েছে শামীমার। মাত্রই সংসারটা ঘুচিয়ে এনেছিলো সে। রঙিন টিভি কেনা হয়েছে। বেতের ডিভান দিয়ে এক টুকরো ড্রয়িংরুম। একটা ফ্রিজ না কিনলে আর চলছে না। এর ওর বাসায় মাছ মাংস রেখে আসে। মুখে না বললেও সবাই যে কমবেশি বিরক্ত হয় স্পষ্ট বুঝা যায়। কাজের বুয়া ছাড়া একা হাতে সব কাজ সামলাচ্ছে আজ একবছর ধরে। চোখ বন্ধ করে বুয়ার বেতনটা আলাদা করে রাখে সে। ফেসবুকে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে এটা ওটা সামনে আসে, শাড়ি, চুরি, ফ্রাইংপ্যান। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখে শামীমা। খুব তাড়াতাড়ি একটা ফ্রিজ না কিনলেই নয়।
আর এসময় কিনা একদিন সত্যি সব গুটিয়ে ট্রাকে উঠে বাড়ি চলে আসতে হলো তাদের! গ্রাম তো নামেই। বাকি দুই ভাই আগেই সব বিক্রি টিক্রি করে খেয়েছে। এদের করুণার দৃষ্টির সামনে অযাচিত ভিক্ষুকের মতো দাঁড়ানো ছিল ধর্ষিত হওয়া মূহুর্তের মতো দুঃসহ। কারো আপদ হওয়ার চেয়ে চাকরিহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জীবন বয়ে বেড়ানোও যেন এর চেয়ে হালকা। দুজনের উঠতে হয়েছে ভাড়া বাসায়।
নাহিদের কাছে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে গিয়েছিলো আমানউল্লাহ। শামীমার পীড়াপীড়িতে। একসাথে পড়েছে নাহিদ আর আমান শহরের হাইস্কুলটাতে। লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র নাহিদ এখন শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। স্কুলে বাজে ছাত্র বলে যার সাথে কোনদিন কথাই বলে নি তার কাছে চাকরির জন্য যাওয়া যতোই অসম্মান আর আত্মগ্লানির হোক, উপায় ছিলো না আমানের।
নাহিদ তাকে ফেরায়নি বটে। বেশ কয়টা বহুজাতিক কোম্পানির এজেন্সি তার। কসমেটিক্স, ইলেকট্রনিকস। ইলেকট্রনিকসের কোম্পানিতেই সেলস ম্যানেজার হিসাবে তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। মাসে লক্ষাধিক টাকার টার্গেট। এই টার্গেট ফুলফিলের উপর বেতন। নাহিদের ব্যবহার ছিলো পুরাই পেশাদার বসের মতো। কোন পরিচিত হাসি বা বেহিসাবি আন্তরিকতা ,কোথাও বিন্দুমাত্র প্রশ্রয়ের সুযোগ ছিলনা একদা সহপাঠী আমানউল্লাহর প্রতি।
একেতো মহামারীর ধাক্কাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি মানুষ, তায় আবার এসব সৌখিন জিনিস পত্র কেনা। তবু চাকরিটা পেয়ে হণ্যে হয়ে ঘুরছে সে শহরের আনাচেকানাচে, জনে জনে। যদি কেউ কিনে।
বিধান কাকার সাথে একদিন ফার্মেসিতে দেখা। খেয়াল করেনি আমান। দোকানদারকে স্বাভাবিক ভাবেই বলছিল, এক প্যাকেট কনডম দেন। পাশ থেকে তখনই কথা বলে উঠলেন বিধান কাকা। কেডা, আমাইন্না নি? আরে কাকা আপনে! তড়িঘড়ি বিধান কাকাকে বাইরে ডেকে এনে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে বাসার ঠিকানা চেয়ে নিজে রিক্সা ডেকে দিয়ে নিজেকে লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছিল আমানউল্লাহ। যেন হঠাৎ মুরুব্বির সামনে খোলা চুলে ধরা পড়ে যাওয়া নতুন বউ সে। মাথায় কাপড় তুলে তড়িঘড়ি সম্ভ্রম বাঁচিয়ে রক্ষা!
যেই সেই লোক নন বিধানবাবু। তার আব্বা আজিজউল্লাহর খাতিরের মানুষ, বলা যায় একমাত্র খাতিরের মানুষ। ছোটবেলা দেখেছে শাল্লা থেকে সুনামগঞ্জ শহরে এসে আব্বার দোকানে বসে পত্রিকা পড়ে আড্ডা দিতেন এই বিধান কাকা। আমানের আব্বার ছিল রাজনীতির নেশা। বিধান কাকারও, ফলে তার সাথেই রাজ্যের আলাপ জমতো তার। বিধান কাকা আওয়ামী লীগের পসমর্থক ছিলেন। আর এই আওয়ামীলীগের আমলেই কিনা তাকে দেশ ছাড়তে হলো! আচ্ছা সে কি সত্যি দেশ ছেড়ে গেছে? নাকি দেশের ভেতরেই কোথাও আত্মগোপন করে আছে। সব কয়টা ফোন বন্ধ। মেয়ে নন্দিনীর ফোনটাও। বেশ কয়েকবার ফোন করেছে আমান।
নন্দিনীর সাথে তার প্রেম নয়। হতোও না কোনদিন। নন্দিনী সুনামগঞ্জের সরকারি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ে। একেতো মুসলিম, সামান্য সেলসম্যানের চাকরি, তায় আবার বিবাহিত। আমানের প্রেমে পড়ার মতো বোকা মেয়ে নয় নন্দিনী। নন্দিনী কেন, এ যুগের কোন মেয়েই এরকম বোকা হয়না। তবু নিয়মিত যেতে যেতে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো নন্দিনীর সাথে। হিন্দু মেয়েদের কোন জড়তা থাকেনা। কী সুন্দর হেসে মিশে কথা বলে। মাত্রতো কয়েক মাস। অথচ মনে হতো কতো পরিচিত। আমান ভাই পেয়ারা খান, বলে প্লেট থেকে এক টুকরো তুলে লবণ লাগিয়ে নিজেও এক টুকরো মুখে পুরতো নন্দিনী। একই প্লেটে সে আর নন্দিনী। অথচ সারাজীবন শুনে এসেছে হিন্দুরা মুসলমানের ছোঁয়া লাগা কিছু খায়না। এমন আন্তরিক ব্যবহারে প্রশ্নটা বেখাপ্পা বেমানান হতো বুঝেই আমান কোনদিন এসব প্রশ্ন তুলে বিব্রত করেনি নন্দিনীকে।
এমন সহজ একটা সম্পর্কে একদিন শাড়ি গয়নায় সেজে বিয়ে খেতে গিয়েছিলো নন্দিনী, আর কী কুক্ষণে যে আমান ওদের বাসা থেকে বের হতে হতে মেসেজটা লিখছিলো নন্দিনীকে, তোমাকে পরীর মতো লাগছে নন্দিনী। নিজের বাসায় ঢোকার আগে সেটা ডিলিট করতে ভুলে গিয়েছিলো সে। সেটাই পড়ে গিয়েছিলো শামীমার চোখে, আর যায় কই, তারপর থেকে রক্ষে নেই। শামীমার কথার হুলে অতিষ্ঠ দিন, অতিষ্ঠ রাত, সারাদিন সন্দেহের অনুসরণ, মোবাইল চেক, উফ কী অসহ্য। আমান ঠিক করে রেখেছিল আজ লেনদেন শেষ হয়ে গেলে আর এই বাড়ির পথ মাড়াবে না সে।
পেনশনের টাকায় লক্ষাধিক টাকার ইলেকট্রনিক কিনেছিলেন বিধান কাকা। কিছু ইনস্টলমেন্টে। সেই টাকা আনতেই যেতে হতো প্রতিমাসে নিয়ম করে। আর বউ কড়া নজরদারিতে রাখতো, কোনদিন যায় কখন যায়, কতোক্ষন থাকে।
অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে টাকাগুলো জমিয়েছিলো শামীমা। একটা ফ্রিজ কিনবে। এই টাকাটা দিয়ে দিয়েছে বিধান কাকার গত দুই মাসের ইনস্টলমেন্ট। শাল্লার হিন্দুপাড়ায় এই আক্রমণে সব হারানোর পর ইনস্টলমেন্টের টাকাটা দেয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না বিধান কাকা। বিধ্বস্ত, পরাজিত, বিভ্রান্ত। এ অবস্থায় এই পুলিশ আসে তো এই র্যাব। এই মন্ত্রি ,মিনিস্টার, ডিসি -এস পি,এন জি ও। স্বচ্ছাসেবী সংস্থা। দম নেই এদের। এর মধ্যে টাকাটা চায় কি করে। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা সমস্ত জিনিস লুটপাট, ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে গেছে হার্মাদের দল। আদৌ কি আর বাকি টাকা দিতে পারবেন বিধানকাকা ! তবু একফাঁকে অশ্রু মুছতে মুছতে চণ্ডিগাছতলায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে তার হাত দুটি ধরে কথা দিয়েছিলেন, বাবা আমান তোমারে আমি বিপদে ফালাইতাম না।
এ পাড়াটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন হিন্দুপাড়া বলেই। ঘরে উপযুক্ত তিনটা মেয়ে। চাইলে তিনটাকেই একসাথে বিয়ে দেয়া যায়। পাত্রপক্ষ নানারকম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। পেনশনের টাকায় ঘর সাজিয়েছেন তিনি, পাত্রপক্ষের সামনে যেন মান না যায়। রঙিন টিভি, ফ্রিজ। নতুন একসেট মালয়েশিয়ান কাঠের সোফা। সব তখন ধ্বংসস্তুপ। সবাই আসে। দলে দলে। সামনে পিছনে ক্যামেরা বুম, বড় বড় কথা। কিন্তু যাদের গেছে তারা জানে এই কথার ফুলঝুরিতে কিচ্ছু ফিরবে না তাদের, না সারা জীবনের সঞ্চয় ঘরের অস্থাবর সম্পদ, না হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস আর মর্যাদা। তাদের নিঃস্বতা আসলে নিয়তিতে লেখা হয়ে গেছে অমোচনীয় কালিতে। তবু বিধানবাবু বলেছিলেন, এক তারিখে সঞ্চয় ব্যাংক থাইক্যা ইন্টারেস্ট উঠাইমু বাবা, দুই তারিখে আইসা নিয়া যাইও। আমান এই নুয়ে পরা লাউগাছের মতো পরাজিত লোকটাকে বলতে পারেন নি পরপর দুইটা ঈনস্টলমেন্ট বাকি পড়ে আছে, এইবার তারিখমতো জমা না দিতে পারলে তার চাকরি নিয়েই টান পড়বে।
সেদিন বাড়ি ফিরে অনেক অনুনয় করে শামীমার জমানো টাকাগুলো কোম্পানিতে জমা দিয়ে চাকরিটা বাঁচিয়েছিলো সে। দুই তারিখে আসলটাতো মিলবেই, সাথে সেলারিটাও। হিসাবটা বুঝমত পড়ায় বিশেষ আপত্তি করেনি শামীমা। তার উপর ঘটনা যে মিথ্যা নয়, টিভি খুলেই দেখতে পায় সে। নন্দিনীর কথা তোলে খোঁটাও দেয়নি কয়েকদিন। বরং রাজনীতিবোধহীন আক্ষেপে অধৈর্য হয়েছে, এইডা কেমুন কথা! মগের মুল্লুক পাইছে নি! আজ কি জবাব দেবে সে শামীমাকে? কোম্পানির কাছেই বা জবাবদিহি করবে কী?
ফিরতি পথ ধরে আমানউল্লাহ। মাথাটা নষ্ট পানির মটরের মতো থ মেরে আছে, জীবনের যতদূর চোখ যায় সমাধানহীন আশাহীন ধূ ধূ রুক্ষ মরুভূমি। ততক্ষণে সকালে ধেয়ে আসা কালো মেঘের দল উধাও। ফকফকা সূর্যের আলো। বৈশাখের মেঘের দল, গিরগিটি নেতাদের মতো। রং পাল্টাতে সময় লাগেনা।
একদল পুলিশের মুখোমুখি হতে হতে পাশ কাটিয়ে যায় আমান। এরা প্রতিদিন দলে দলে এসে করে কী? অথচ সময়কালে কারো সাহায্য পেলোনা এই কয়ঘর হিন্দু! বিধান বাবুর ঘরটা পাড়ার এককোণে, এক অলুক্ষণে বিষাদে দাঁড়িয়ে আছে যেন পুরো পাড়ার ভবিষ্যতের মতো।
পুলিশের দলটি সরে গেলে বাসার পেছনে ঢালু বিছরা থেকে কোন নারীকণ্ঠ ডাক শোনা যায়, আমান ভাই, খাড়ওইন। মূহুর্তে তার মনে হয়, কে এটা নন্দিনী? না নন্দিনী নয়। এই মেয়েটিকে সে চিনেনা। এগিয়ে এসে হাতে একটা খাম গুঁজে দেয় মেয়েটি। নন্দিনী দিদি দিয়া গ্যাছে। খামের ভেতরে আঁটতে না পেরে হাঁসফাঁস করছে কতোগুলো কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট। নন্দিনীরা কই গ্যাছে, জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ তুলে আমান দেখে মেয়েটা এক দৌড়ে কোথায় লুকিয়ে গেছে ধ্বংসস্তুপের আড়ালে।