সুদিন ফিরছে আবাসন খাতে
দীর্ঘদিনের মন্দা কাটিয়ে সুদিন ফিরতে শুরু করেছে আবাসন খাতে। গত বছর থেকেই ১৬-১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি রয়েছে এ খাতের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের। ফলে ২০১২ সালের পর আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
নতুন করে অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট বাসা, কমার্শিয়াল বিল্ডিং নির্মাণের পাশাপাশি ঢাকার পাশ্ববর্তী বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প। পরিকল্পিত এসব আবাসন প্রকল্পে যোগ হচ্ছে নতুনত্ব।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমির রেজিট্রেশন ফি কমানো, ব্যাংক ঋণে ছাড়, সরকারি কর্মকর্তাদের হোম লোন ও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ এ শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচন করেছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরে ফ্ল্যাট বিক্রি ২০ শতাংশের মতো বেড়েছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, "২০১৩ সালের পর ফ্ল্যাটের দাম খুব একটা বাড়েনি। ২০১৩-১৭ পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রি অনেক কমে যায়। ফলে বিপুল সংখ্যক ফ্ল্যাট অবিক্রিত ছিল। তবে দুই বছর ধরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "শুধু রাজধানীতেই বছরে এক লাখ ২০ হাজার অ্যাপার্টমেন্টের প্রয়োজন হয়। সেখানে রিহ্যাবের সদস্যরা ২০-২৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছে। নিবন্ধন ফি ও স্ট্যাম্প ডিউটি কমানো এবং ঋণ পদ্ধতি আরও সহজ করা হলে খাতটি অনেক বিকশিত হবে। "
দেশে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল আবাসন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টার বিডি। গত ৫ বছরের তুলনায় এবার তাদের অ্যাপার্টমেন্ট বেশি বিক্রি হয়েছে। নির্মাণাধীন সব প্রকল্পের বিক্রি শেষ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। নতুন প্রকল্পের এরই মধ্যে বুকিং নেয়া শুরু করেছে তারা। চলতি বছর কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে ২০ শতাংশেরও বেশি।
ইনস্টার বিডির চেয়ারম্যান আরমান হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "লোকেশন ও স্পেশাল টাইপ আবাসনের কারণে গত দুই বছর ধরে ইনস্টারের চাহিদা বাড়ছে। চলতি বছর তা আরও বেড়েছে।"
লাক্সারি ও মিডিয়াম টাইপের অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা করে দেশের স্বনামধন্য আবাসন প্রতিষ্ঠানের একটি কনকর্ড। ১৯৭৩ সালে ব্যবসা শুরু করা এ কোম্পানিটি বড় বড় প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করলেও ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাদের ব্যবসা বেশ খারাপ ছিল। তবে ২০১৮ সাল থেকে কোম্পানিটি আবার ঘুড়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সময়ে কয়েকটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তারেকুল আলম বলেন, "২০১৮ সাল থেকেই ১৫-১৬ শতাংশ হারে তাদের ব্যবসা বাড়ছে। চলতি বছর তা আরও বেড়েছে। কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার কারণে বছর শেষে এটি আরও বাড়বে।"
আরেক বৃহৎ আবাসন প্রতিষ্ঠান নাভানা রিয়েল এস্টেট এর ব্যবসাও চলতি বছর অনেক বেড়েছে। আফতাবনগর ও রামপুরা, বারিধারা অঞ্চলে তাদের বিক্রি ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের উপব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ড) হাসিবুর রহমান বলেন, রামপুরা, আফতাবনগর বা বারিধারা প্রজেক্টে ১ কোটি টাকা বা তার কাছাকাছি দামের ফ্ল্যাটের চাহিদা অনেক বেড়েছে। নতুন লাক্সারি ফ্ল্যাটের চাহিদাও বাড়ছে। গুলশান ও বনানীর আপকামিং প্রজেক্টের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বুকিংও দিচ্ছে অনেকে।
একইভাবে ব্যবসা প্রবৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন ইস্টার্ন হাউজিং, ডোম-ইন-নো, র্যাংগস, বোরাক, শেলটেকসহ আবাসন খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে ভূমির রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো ও ব্যাংক ঋণের সীমা বাড়ানো হলে আবাসন খাতের মন্দা শিগগিরই কেটে যাবে বলে দাবি তাদের।
রিহ্যাবের তথ্য মতে, দেশে ৯০ এর দশকের পরই আবাসন ব্যবসা বড় হতে থাকে। ২০১০ সালের পূর্ব পর্যন্ত এ খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আসে। ওই সময়ই এর বাজার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে অতি বিনিয়োগ ও শেয়ার বাজারে ধ্বস এবং রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মন্দার কবলে পড়ে খাতটি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্দাভাব কাটিয়ে ২০১৭ সাল থেকে কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে ফ্ল্যাটের ব্যবসা।
কোথায় সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাট বিক্রি
আবাসন ব্যবসা এখনও ঢাকা কেন্দ্রিকই। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও খুলনা ছাড়া অন্য শহরগুলোতে আধুনিক ফ্ল্যাট নির্মাণ শুরু হয়নি।
ফ্ল্যাট কেনা-বেচা নিয়ে গবেষণা করেছে অনলাইন মার্কেট প্লেস বিক্রয় ডট কম ও বিপ্রপার্টি। তাদের তথ্য মতে, ফ্ল্যাটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। ক্রেতাদের ২৬ শতাংশই বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট খুঁজছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ক্রেতা মিরপুরে ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী।
এছাড়া, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারা, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, সিদ্ধেশ্বরী, শান্তিনগর, আফতাব নগর, কলাবাগান ও ইস্কাটনসহ বেশ কিছু জায়গায় ফ্ল্যাটের চাহিদা রয়েছে ক্রেতাদের।
যে কারণে স্বপ্ন দেখছেন বিনিয়োগকারীরা
৫% সরল সুদে বাড়ি কেনার জন্য প্রায় ২১ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে হোম লোন দিচ্ছে সরকার। আর আর ১০ শতাংশেরও কম সুদে হোম দিচ্ছে কয়েকটি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ কোনো প্রশ্ন ছাড়া ফ্ল্যাট ক্রয়ের সুযোগ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
আবাসন খাতে চলমান প্রবৃদ্ধি ও নতুন সম্ভাবনার পেছনে এ বিষয়গুলোকে বড় প্রণোদনা হিসেবে দেখছেন খাতটির উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি মধ্যবিত্তেরে সংখ্যা বৃদ্ধি ও শহুরে জনসংখ্যার ক্রমাবর্ধমান হার আবাসন খাত বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন রিহ্যাবের সহসভাপতি কামাল মাহমুদ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "ঢাকায় বছরে ৬ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। মানুষ অনুপাতে আবাসনের চাহিদার হিসাব মেলালে বছরে ১ লাখ ২০ হাজার অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা রয়েছে। ঢাকার বাইরে অন্য শহরগুলোতেও ফ্ল্যাটের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।"
আরও যেসব সুবিধা চায় ব্যবসায়ীরা
নতুন সম্ভাবনা তৈরি হলেও ভূমির রেজিস্ট্রেশন ফিসহ নানা খাতে অত্যধিক ব্যয়ের অভিযোগ তুলছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ আরও কমানোর প্রস্তাবও তাদের।
রিহ্যাবের প্রথম সহসভাপতি লিয়াকত হোসেন ভুঁইয়া বলেন, "আবাসন খাতে সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন ব্যয় ১৬ শতাংশ থেকে ৬-৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এটি হলে সাধারণ মানুষের ওপর আর্থিক চাপ কমবে, অনেকেই ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন।"
তিনি আরও বলেন, "৫-৭ শতাংশ সুদে ২০-২৫ বছরের জন্য গৃহঋণ পেলে সাধারণ মানুষ ভাড়ার টাকায় ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন সুবিধা আছে।"