পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিখণ্ডিত করতে চাইছে বিজেপি
বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে বিজেপি কতটা বেপরোয়া তা তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপে স্পষ্ট। এখন তারা ভাবছে পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিখণ্ডিত করার কথা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গকে আলাদা করা গেলে দ্বিবিধ লাভ। উত্তরবঙ্গ বিজেপির ঘাঁটি। এখানে সহজে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে। অন্য লাভটি হলো বড়। বিজেপির ধারণা পশ্চিমবঙ্গকে ভাঙ্গা গেলে শাসকদল তৃণমূল তার শক্তি হারাবে। সর্বভারতীয় রাজনীতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ 'দখল' করা বিজেপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড মোকাবেলা ও কোভিড রোগী ব্যবস্থাপনায় বিজেপি সরকার এমনিতেই বেকায়দা অবস্থায় আছে। তার উপর কোভিডের কারণেই উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকাররের সীমাহীন ব্যর্থতা ও মূর্খতা বিজেপির জনপ্রিয়তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। দলটি এখন রাজ্যভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে। এখানকার বিধানসভা নির্বাচনের ফল বিপর্যয়ের কারণে বিজেপির সামগ্রিক পরিকল্পনা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা কাটানোর নানা কৌশল খুঁজছেন তারা। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর আলীপুরদুয়ারে বিজেপি জয়লাভ করেছে। এখানকার বিধায়করা এই এলাকাগুলো 'বৈষম্যের শিকার' এমন প্রচারণা সামনে আনছে। ভৌগলিকভাবে উত্তরবঙ্গ বেশ দূর প্রান্ত। বাংলাদেশের একেবারে গা ঘেঁষা অঞ্চল। পশ্চিবঙ্গের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিজেপির এটা এখন নুতন রাজনৈতিক তত্ত্ব। পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যদি বিজেপির প্লান ১ হয় তাহলে প্লান ২ হলো পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করা।
২৩ জুন ছিল ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যুবার্ষিকী। ৬৮ বছর আগে ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন মাত্র ৫১ বছর বয়সে এই রাজনীতিকের মৃত্যু হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর জন্ম ১৯০১ সালের ৬ই জুলাই কলকাতায়। তাঁর পিতা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। স্যার আশুতোষ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন(১৯০৬ থেকে ১৯১৪)। অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনষ্ক স্যার আশুতোষ আমৃত্যু শিক্ষা বিস্তারে ভুমিকা রেখেছেন। স্যার আশুতোষের সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুদিনটি স্মরণে রাখতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা কর্মসূচী হাতে নেয়। বিশেষ করে আজকের ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীর ঘোর সমর্থক ছিলেন। তিনি প্রথম হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল 'ভারতীয় জনসংঘ' গঠন করেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর সর্বভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। ১৯১৫ সালে হিন্দু মহাসভা গঠিত হয়। লক্ষ্য, একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে আজকের ভারতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে বিকাশ, তার সূচনা এখানেই। শ্যামাপ্রসাদের বপন করা বীজ আজ মহীরূহ।
১৮৮৫ সালে ব্রিটিশদের হাত ধরে যখন কংগ্রেসের জন্ম হয় তার ১০০ বছর আগ থেকে ব্রিটেন চার্চকে রাজনীতি থেকে আলাদা করেছে। রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্ম এখন সেখানে কোন ভূমিকা রাখে না। ধর্মনিরপেক্ষতা এখন উদীয়মান রাজনৈতিক দর্শন। ফলে ইংরেজদের হাত ধরে জন্ম নেয়া কংগ্রেসের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে বিকশিত হতে থাকে। যে কারণে, হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কংগ্রেসের কখনই নৈকট্য তৈরি হয়নি। কিন্তু '৪৬ এ দৃশ্যপটের বদল ঘটে। কলকাতার দাঙ্গা হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসকে পরস্পরের কাছে নিয়ে আসে। ভারতের অখন্ডতা রক্ষার বিপরীতে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাস, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ক্রমেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরিণতি '৪৭ এ ভারত ও পাকিস্তান। '৪৭ এ ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ৬ কোটি মানুষ পাকিস্তান অংশে পড়ে। এর বাইরে থাকে আরও ৬ কোটি মানুষ যারা ভারত অংশে অবস্থান করছিলেন।
১৯৪৬ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা বাস্তবায়নের জন্য ভারতীয় সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলি অফ ইন্ডিয়া নির্বাচনে মুসলিম লীগ ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়। কংগ্রেসের পাল্লা ভারী। মুসলিম লীগ দাবি করতে থাকে, কেবল সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে নয় বরং আলোচনার মাধ্যমে একটা ন্যায়সংগত মীমাংসায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা। কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে মুসলিম লীগের দাবি উপেক্ষিত হয়। পরিণতি ছেচল্লিশের দাঙ্গা। একদিকে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী অন্যদিকে মুসলিম লীগের নেতারা। সেই ভয়াবহ দাঙ্গার পরিণতিতে যে নুতন রাষ্ট্র ভারতের জন্ম হয় তার প্রথম মন্ত্রিপরিষদের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।
ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিপরীত সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যায় কম হলেও থেকে যান। অভিযোগ উঠতে থাকে, দু'দেশেই সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে। এবং এই অভিযোগের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। দুই দেশের সংখ্যালঘুদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। ভয়ানক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলাপে উভয়ই এ সমস্যা নিরসনে উদ্দ্যোগী হয়। নিজ নিজ দেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এবং ছাড়াও ধর্ম দ্বারা মানুষকে বিভাজন করা যাবে না। আইনের সুরক্ষা সকল মানুষের জন্য সমান, এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন দুই নেতা। ১৯৫০ এর এপ্রিলে উল্লেখিত বিষয়ের আলোকে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা "নেহেরু- লিয়াকত চুক্তি" নামে পরিচিত। এই চুক্তি মেনে নিতে না পারার কারণে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। শ্যামাপ্রসাদরা মনে করেন হিন্দুদের জন্য ভারত এবং মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। এর বাইরে আর কিছূ নাই। এখানে হিন্দু মুসলমানের মিলমিশ করে বসবাসের কোন সুযোগ নেই। ধর্ম দ্বারাই সব কিছু নির্ধারিত হবে। হিন্দু মহাসভার এই কট্টর হিন্দুত্ববাদী মনোভাবে প্রকাশ ঘটে ২০১৯ এর শেষে ভারতের লোকসভায় পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে। বিলটি নিয়ে আলোচনা চলাকালীন বিরোধীরা অভিযোগ করে এই বিল ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতার মনোভাব পরিপন্থি। বিরোধীদের এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোকসভায় কংগ্রেসকে পাল্টা আক্রমণ করে বলেন, '১৯৫০ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি ব্যর্থ হয়েছে, তাই আজ প্রতিবেশী দেশে থাকা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া ভারতের নৈতিক ও মানবিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।'
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু দিবসে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি রক্তদান অনুষ্ঠান করেছে। অন্যদিকে নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ও তার ভাস্কর্যে মালা প্রদান করেছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী একজন চরম সাম্প্রদায়িক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে মাল্যদান একটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া কিছু নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকে কলকাতা রাজনীতিতে বেশ কিছু চমকপ্রদ ঘটনা আছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাবা স্যার আশুতোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। স্যার আশুতোষের ঘরেই জায়গা হয়েছিল পূর্ব বাংলার সন্তান আবুল কাশেম মুহাম্মদ ফজলুল হকের। আশুতোষের বাসভবনে অবস্থান করে ফজলুল হক তাঁর জীবন গঠন করেছিলেন। স্যার আশুতোষ তাঁকে এতটাই স্নেহ করতেন যে, ফজলুল হকের ১৯৩৩ সালে কলকাতার মেয়র হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। অত্যন্ত বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী শ্যামাপ্রসাদ খুবই মেধাবি ছিলেন। ১৯২১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ভারতীয় ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ১৯২৪ সালে বি.এল পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন। ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ভাইস-চ্যান্সেলর পিতাকে শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করেন। পিতার মত তিনিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (১৯৩৪-১৯৩৮) হন। এই রকম একটি পরিবারের সন্তান শ্যামাপ্রসাদ কি করে তীব্র সম্প্রদায়িক হলেন, সে প্রশ্ন আজো মানুষের মুখে। আজকের পশ্চিমবাংলার সামগ্রিক রাজনীতিতে বিজেপি শ্যামাপ্রসাদকে যেভাবে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে যেটা ভারতের সামগ্রিক অসাম্প্রদায়িক চেতনা যা ভারতের অখন্ডতার প্রতীক, তা হুমকির সম্মুখীন করবে। ১৯৫০ সালে নেহেরু কেবিনেট ত্যাগ করার আগে শ্যামাপ্রসাদ কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করেন। পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণপন্থী প্রজা পরিষদ গঠন করে "এক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে আরেকটা প্রজাতন্ত্র থাকতে পারে না" এই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। '৫৩ সালের ১১ মে গ্রেফতার হন এবং ২৩ জুন কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু 'রহস্যজনক' এবং এর পিছনে কংগ্রেসের 'হাত' আছে, এমন একটি প্রচারণা শুরু থেকেই আছে যদিও কংগ্রেস বরাবর এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।
ভারতের রাজনীতি থেমে নেই। ছোট বড় নানা প্রচেষ্টা চোখে পড়ে। সকলেই এ অবস্থার পরিবর্তন চাইছেন। মহারাষ্ট্রে শারদ পাওয়ারের বাসভবনে নয়টি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। লক্ষ্য একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলা। বৈঠকে কংগ্রেস অংশ নেয়নি। কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে অপরাপর দলগুলোর দ্বিধা রয়েছে। যদিও সর্বভারতীয় আঙ্গিকে কংগ্রেসকে বাদ রেখে কোন প্ল্যাটফর্ম করার অর্থ দাঁড়ায় বিজেপিকে সহায়তা করা।